সিলেট ১৩ই জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৯শে পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ২:১৬ অপরাহ্ণ, জুন ১৮, ২০২৪
সৌম্যেন্দ্রনাথ আসলে কী ছিলেন, কেন তিনি তলিয়ে গেলেন বিস্মৃতির অন্তরালে-এ নিয়ে ভাবতে বসলে শেষ পর্যন্ত এক ধরনের নিরাসক্ত নির্বিকার আত্মদর্শনে নিজেকে সমর্পন করা ছাড়া উপায় থকে না। সত্যিই তো শুধু সৌম্যেন্দ্রনাথ নিয়েই বা একথা ভাবছি কেন, আরও তো কম প্রতিভাবান মানুষ আমাদের বিস্মৃতির অন্ধকারে তলিয়ে যাননি। ক’জনই বা মনে রেখে চর্চা করি শিশিরকুমার ভাদুড়ি বা বিজন ভট্টাচার্যকে। প্রগতির যে পথিকেরা গত শতাব্দীর গণজীবনকে আমাদের মূল স্রোতের সঙ্গে মেলাতে চেয়েছিলেন- তাঁদের ক’জনের নামই বা আমরা মনে রেখেছি। আসলে আমাদের মধ্যবিত্ত বাঙালি মন ও মানসিকতা চিরকালই ঘটনা ও চরিত্রের গ্রান্ড ন্যারেটিভকেই খুঁজেছে, মাইক্রো ন্যারেটিভকে সে গণ্য করতে শেখেনি। এটাও ঘটনা যে, আমাদের ইতিহাস সম্পর্কে উদাসীনতা প্রায় প্রবাদের পর্যায়ে। আর যে ইতিহাসকে আমরা- চর্চা-যোগ্য ও প্রয়োজনীয় বলে মনে করি, সেই ইতিহাসের নির্মাণে থাকে ক্ষমতাসীনের নিয়ন্ত্রণ, প্রাতিষ্ঠানিক শক্তির আধিপত্য। ঘটনা ও চরিত্রের চলমান স্রোতের ভিতর থেকে কে, কতটুকু থাকবেন, কীভাবে থাকবেন, কতটা বাড়াই-বাছাই-এ বাদ পড়বেন অথবা উপযোগমতো পরিবর্তিত আকারে আসবেন, সে-সবের নির্মাণ প্রক্রিয়া ক্ষমতাশালীদের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়। সুতরাং প্রশ্নটা ঘুরিয়ে ভাবলে, সৌম্যেন্দ্রনাথ বা তাঁর মতো কোনো-কোনো মানুষ কেন বিস্মৃতির আড়ালে তলিয়ে গেলেন নয় বরং প্রশ্নটা হওয়া উচিত কীভাবে ইতিহাসের চলমান অধ্যায়ে তাঁদের ধুলোচাপা দেওয়ার বন্দোবস্ত হল।
সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম ঠাকুর পরিবারে ১৯০১-এ। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড়ো ছেলে দ্বিজেন্দ্রনাথের নাতি, সেই হিসেবে রবীন্দ্রনাথেরও নাতি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে তিনি চিরদিন ‘রবিদা’-ই বলতেন। সম্পর্কের এই মধুর-বন্ধন রবীন্দ্রনাথ মেনেও নিয়েছিলেন। যাই হোক, ঠাকুরবাড়ির পরিবারের সাংস্কৃতিক আবহে বেড়ে ওঠা সৌম্যেন্দ্রনাথ ক্রমশ ওই সাংস্কৃতিক আবহকে ছাড়িয়ে হয়ে উঠেছিলেন বিদ্রোহী। তাঁর জীবনের ওঠা-পড়ার পর্বগুলি খতিয়ে দেখলে এক-একটা থিসিস, অ্যান্টিথিসিস পেরিয়ে বোধহয় কোনো এক সিনথিসিস খুঁজে পাওয়া সম্ভব।
শৈশব-কৈশোরে পেয়েছেন ঠাকুরবাড়ির শিল্প-সাহিত্য সংগীতের নান্দনিক পরিবেশ। পেয়েছেন দিনেন্দ্রনাথের গানের সাহচর্য, ওস্তাদ শ্যামসুন্দর মিশ্রের গানের তালিম। পেয়েছেন সংগীত ও অভিনয়ের রবীন্দ্রনাথকে। ঠাকুরবাড়ির রুচি, সৌন্দর্যের বোধ এসবই তাঁর শিশুমনের মানসগঠন করেছে যেটাকে তিনি বলেছেন– ‘এসথেটিক আবেষ্টনী’। এই ‘এসথেটিক আবেষ্টনী’ই একসময় তাঁর কাছে হয়ে উঠবে ‘এসথেটিকস্ দুর্গ’, যখন তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজের অর্থনীতির সাম্মানিক ছাত্র। ১৯২০-২১ সাল গান্ধীজির অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের উত্তাল হাওয়া সৌম্যেন্দ্রনাথকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। গান্ধীর রাজনৈতিক আদর্শ, জাতীয়তাবাদ ও দেশমুক্তি সাধনার স্বপ্ন তখন তাঁকে পেয়ে বসেছে। ঠাকুরবাড়ির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং রবীন্দ্রনাথের অসহযোগ-বিরোধী অবস্থান-কোনো কিছুই তাঁকে ‘বিদ্রোহী’ হয়ে ওঠা থেকে আটকে রাখতে পারেনি। অসহযোগ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লেন তিনি।
আবার খুব দ্রুতই এই গান্ধীবাদী আদর্শ থেকে বেরিয়ে এলেন। এবার তাঁকে আকৃষ্ট করল গান্ধীবাদের বিপরীত প্রান্তে থাকা মার্কসবাদ, সোস্যালিজম। কমিউনিজম ও মার্কসবাদ নিয়ে অনেক পড়াশোনা করলেন। ১৯২৬-এ সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়ে গেলেন কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে। ‘গণবাণী’ পত্রিকায়, ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’-র বাংলা অনুবাদ— ‘সাধারণ স্বত্ত্ববাদীর ইস্তাহার’ লিখলেন। ১৯২৭-এ শ্রমিক-কৃষক দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হলেন। বামপন্থী আন্দোলনের তীব্র র্যাাডিক্যাল চিন্তা-চেতনা থেকে এই সময় তিনি সশস্ত্র বিপ্লবীদের সঙ্গেও যুক্ত হয়েছিলেন ও জোড়াসাঁকোর বাড়ির গোপন এক কুঠুরিতে বিপ্লবীদের বোমা তৈরির ব্যাপারেও সাহায্য করছিলেন। কিন্তু পুলিশের গোয়েন্দাবিভাগের নজরে পড়ায় সৌম্যেন্দ্রনাথ গ্রেফতার হতে পারেন- এমন আশংকা দেখা দিলে খুব দ্রুত তিনি পাড়ি দিলেন কমিউনিস্ট রাশিয়ায়। মস্কোর কমিনটার্নে ভারতবর্ষে কমিউনিস্ট প্রভাব সম্পর্কে এবং ভারতবর্ষের রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে রিপোর্ট পেশ করবার দায়িত্ব বর্তালো সৌম্যেন্দ্রনাথের উপর।
রাশিয়ায় তখন স্ট্যালিনের একচ্ছত্র একাধিপত্য। সৌম্যেন্দ্রনাথ কমিউনিস্ট রাশিয়াকে চিনতে শুরু করলেন। চিনলেন স্ট্যালিনকে, ট্রটস্কিকে। তবে সবথেকে যাঁর কাছাকাছি এলেন ও কমিউনিজমের পাঠ নিলেন— তিনি হলেন কমিউনিস্ট পার্টির পলিটব্যুরোর সদস্য ও কমিনটার্নের অধিনায়ক নিকোলাই বুখারিন। রাশিয়াতে সৌম্যেন্দ্রনাথের অবস্থান ছিল স্ট্যালিনের একনায়কতন্ত্রের বিরোধী। ফলে স্ট্যালিনের বিরোধিতা করে তাঁর পক্ষে রাশিয়ায় থাকা খুব একটা নিরাপদ ছিল না। মস্কো ছেড়ে তিনি বার্লিনে এলেন ১৯২৮-এর শেষে। এখানে থাকাকালীন দেখলেন হিটলারের স্বরূপ ও নাৎসিবাহিনীর উত্থান। ১৯৩১-এ জর্মান পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে হিটলারকে হত্যার ষড়যন্ত্রের অভিযোগে। অবশ্য অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তিনি জেল থেকে ছাড়া পেয়ে যান। যাই হোক এই পর্যায়ে ফ্যাসিবাদ-বিরোধী সংগ্রামে সৌম্যেন্দ্রনাথ ছিলেন সক্রিয় প্রচারক।
১৯৩৪-এ দেশে ফেরার পরও সৌম্যেন্দ্রনাথের কাজকর্মে খুব একটা স্থিরতা দেখা গেল না। কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে মতাদর্শ ও নীতিগত নানা প্রশ্নে মতভেদের কারণে ১৯৩৪-এ তিনি দল ছাড়লেন ও নতুন দল গঠন করলেন— ‘কমিউনিস্ট লিগ অফ ইন্ডিয়া’। দলের মুখপাত্র হিসেবে পুনঃপ্রকাশ শুরু হল গণবাণী পত্রিকার। এই পর্বে সৌম্যেন্দ্রনাথ চট্টগ্রামে পুলিশী অত্যাচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে জনমত গঠনে আন্দোলন শুরু করলেন। ১৯৩৫-এ সুভাষচন্দ্রের গ্রেফতারির প্রতিবাদ করে এক বছরের জন্য জেলে গেলেন। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে আন্দামান রাজবন্দিদের উপর পুলিশের অত্যাচার ও অমানবিক আচরণের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করলেন। তাছাড়া ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশ ঘুরে অত্যাচারিত শ্রমিক ও কৃষকদের আন্দোলনে সৌম্যেন্দ্রনাথ তাঁর দল নিয়ে যোগ দিয়েছেন। ১৯৩৯-এ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামের আহবান জানিয়ে গণসংগ্রামের প্রস্তুতি নেন। গান্ধীজির ভারতছাড়ো আন্দোলনে যুক্ত হয়ে সশস্ত্র আন্দোলনের জন্য অনুগামীদের প্রস্তুত হতে বলেন। ফলে ১৯৪২-এ ব্রিটিশ পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে, ১৯৪৫ পর্যন্ত বিভিন্ন জেলে তিনি বন্দি ছিলেন। ১৯৪৬-এ জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর সৌম্যেন্দ্রনাথ সমকালীন হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা-প্রতিরোধ ও দাঙ্গা-বিরোধী মনোভাব গড়ে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৪৭-এ সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে দেশভাগেরও তিনি তীব্র বিরোধিতা করেন।
সৌম্যেন্দ্রনাথের এই পর্যায়ের জীবনধারা অনুসরণ করে পাঠক নিশ্চয় তাঁর অস্থির ও বেগবান কর্মপদ্ধতির ভিতর থেকে এই সমন্বয়ী চিন্তায় পৌঁছতে পেরেছেন যে তিনি আসলে আপসহীন এবং হয়তো আবেগময় রোমান্টিক। রাজনৈতিক প্যাঁচ পয়জার ও সাংগঠনিক মার-প্যাঁচের হিসেবি বুদ্ধি ও সুযোগসন্ধানী মনোভাব তাঁর ধাতে ছিলই না। বরং তিনি অকপট, স্পষ্ট এবং সাহসী—খানিকটা বেপরোয়া। ফলে এই ধরনের মানুষদের পরিণতি যা হবার ক্ষমতাসীন আধিপত্যকামী শক্তির প্রধান টার্গেট হন এঁরাই। সৌম্যেন্দ্রনাথ সারাজীবনে তাই-ই হয়েছেন। স্বাধীন ভারতবর্ষে সরকার-বিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগে প্রথম গ্রেফতার হওয়া ও কারারুদ্ধ হওয়া ব্যক্তি তিনিই। চাইলেই তিনি ক্ষমতাসীন পার্টির স্নেহচ্ছায়া পেতে পারতেন। স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে বড়ো দলের ব্যানারে দাঁড়িয়ে ভোটে জিতে অনায়াসেই সংসদে যেতে পারতেন। নিদেন পক্ষে কমিউনিস্ট পার্টির আদি সংগঠক হিসেবে পার্টির মোটাগোছের পদ তিনি পেতেই পারতেন।
কিন্তু না, সৌম্যেন্দ্রনাথ যে-কোনো মতাদর্শ অথবা রাজনৈতিক আইডিওলজির থেকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন মানবিক বোধ ও সত্যকে। তাই ১৯৫১-৫২ তে পূর্বপাকিস্থানে হিন্দুদের প্রতি অত্যাচারের বিরুদ্ধে তিনি যেমন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের পাশে দাঁড়ান, তেমনি উদ্বাস্ত উচ্ছেদ বিলের বিরুদ্ধেও আন্দোলন সংগঠিত করেন। ১৯৫৫-তে বিধান রায় সরকার বাংলা বিহার সংযুক্তি প্রস্তাবের বিল আনলে তার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামেন তিনি। ৬২-র চিন-ভারত যুদ্ধে চিনা আগ্রাসনের বিরুদ্ধেও তার অবস্থান ছিল পুরোভাগে। এসব ক্ষেত্রে কোথাও কোনোভাবে হিসেবি বৃদ্ধি অথবা সুযোগসন্ধানী মনোভাবের লেশমাত্র সৌম্যেন্দ্রনাথের ছিল না। ভাবতে অবাক লাগে, প্রতিষ্ঠান অথবা ক্ষমতাতন্ত্রের চক্ষুশূল হওয়া এই মানুষটি জীবনে বার বার ক্ষমতাসীনের হাতে মার খেয়েছেন, জেলে গিয়েছেন কিন্তু তাঁর পথ ও আদর্শ থেকে তিনি একটুও সরে আসেননি। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার যে স্বপ্ন বুকে নিয়ে যাবতীয় অত্যাচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে তিনি সংগ্রামে নেমেছিলেন- সারাজীবন সে আদর্শ থেকে সরে আসেননি। তাঁকে হতোদ্যম করতে পারেনি কোনো নেতিবাচক প্রবণতাই। সংসদীয় রাজনীতির ইতিবাচকতায় তাঁর বিশ্বাস ছিল। তিনি এটাও মানতেন যে, মানুষের অধিকার অর্জনের সংগ্রামে সংগঠন বা মঞ্চ খুবই জরুরি। অথচ প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল বা পার্টির সঙ্গে সমঝোতার পথে তিনি যাননি কখনও, বরং ‘একলা চলো-রে’ নীতি নিয়ে নিশ্চিত হার জেনেও প্রতিটি সংসদীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন এবং হেরেছেন। বাংলার ইতিহাসে এ হেন সৌম্যেন্দ্রনাথের সত্যিই কোনো দোসর খুঁজে পাওয়া দুস্কর। সুভাষ মুখোপাধ্যায় দলীয় মতাদর্শগত বিচ্যুতি ও পার্টির সর্বময় কর্তৃত্বের বিরোধিতা করে দল ছেড়েছিলেন। তিনিও সংসদীয় রাজনীতির বিশ্বাস থেকে- মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সংগঠন বা মঞ্চের অপরিহার্যতা অনুভব করেছিলেন। কিন্তু পার্টি ছেড়ে তিনি সৌম্যেন্দ্রনাথের মতো একা লড়াইয়ে নামেননি বরং মঞ্চ খুঁজতে গিয়ে তাঁর মনে হয়েছিল ‘কন্যাসম’ মমতার কথা। রাজনৈতিক আইডেনটিটি-টা বড়ো কথা নয়, মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁদের অধিকার রক্ষার জন্য আন্দোলন ও সংগ্রামটাই আসল। সেটা যেভাবেই, যে-পথেই হোক না কেন—গ্রহণযোগ্য। সৌম্যেন্দ্রনাথ কিংবা সুভাষ মুখোপাধ্যায়- দু’জনেরই এই বিশ্বাস ছিল। সে অর্থে তাঁরা ছিলেন একই পথের পথিক।
—
আজ একবিংশ শতকের মিডিয়া ও প্রতিষ্ঠান-নিয়ন্ত্রিত সময়ে দাঁড়িয়ে কী সমাজ কী রাজনীতি, চূড়ান্ত এক আপসকামী সুবিধাবাদ সর্বস্বতায় আত্মসমর্পণকেই আমরা নিয়তি বলে মেনে নিয়েছি। ডুব দিয়েছি প্রযুক্তিসর্বস্ব ভোগের মধ্যে। ওই ভোগবাদ আর আপসকামী সুবিধাবাদের নিরুপায় অঙ্কেই পুরোনো ইতিহাসকে বিচার করতে অভ্যস্ত হচ্ছি। বিফলতার দায় চাপিয়েছি বিগত শতকের বামসর্বস্ব রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও বুদ্ধিজীবীদের অদূরদর্শিতার প্রতি। ইতিহাসের এই দায়ভার যেন শুধু তাঁদেরই। বিগত শতকের দিকে যখন ফিরে তাকাই, যাচাই করার চেষ্টা করি উনিশ শতকীয় রেনেসাঁর আলোকবর্তিকা আর বিশ শতকীয় গণতন্ত্রের তুল্য মূল্য সাফল্য-ব্যর্থতা, অনেক প্রশ্নই তখন ভীড় করে আসে। ঔপনিবেশিক প্রভুদের দয়া-দাক্ষিণ্যে, তাঁদের সক্রিয় সহযোগিতায়, ইউরোপীয় চিন্তা-চেতনার সোনার কাঠির স্পর্শে এক আলোকবর্তিকায় জেগে ওঠা উনিশ শতকের বাঙালি আসলে তো মুষ্টিমেয় এক শিক্ষিত সমাজ মাত্র। তাঁদের শিক্ষা-দীক্ষা ও মননের পিছনে থাকা ইউরোপীয় যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞান আসলে আমাদের লোকসাধারণের প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্যের বিপ্রতীপে অবস্থান করে। যুক্তি ও বিজ্ঞানের পরাকাষ্ঠায় তাঁরা লোকসমাজে প্রচলিত যা-কিছু সংস্কৃতি, তাকে প্রত্যাখ্যান করে তবেই স্থাপন করেছিলেন ওই আধুনিকতাকে। উপনিবেশ-সঞ্জাত আলোকবর্তিকাতেই তাঁরা উপনিবেশিক প্রভুদের বিরুদ্ধে গড়ে তুললেন জাতীয়তাবোধ—-আমাদের দেশপ্রেম এবং স্বরাজবোধের পরাকাষ্ঠা। সেই দেশপ্রেমের তথা জাতীয়তাবাদের প্রধান মাধ্যমই হয়েছিল হিন্দুধর্ম ও হিন্দু সংস্কৃতি। সে হিন্দুধর্ম এবং সংস্কৃতি লোক সমাজের বৃহত্তর বৈচিত্র্যকে স্বীকার করেনি বরং তার আগ্রাসনের মুখে বলিপ্রদত্ত হয়েছিল তথাকথিত নিম্নবর্গ ও অশিক্ষিত সাধারণের সংস্কৃতি। হিন্দু জাতীয়তাবাদের ইতিহাস ঘাঁটলে বোঝা যায় তৎকালীন জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দ তাঁদের ভিক্টোরীয় নীতিবাগীশ বিশুদ্ধতায় কেমন করে শিক্ষিত নাগরিক সংস্কৃতির বাইরের বৃহত্তর বাঙালি সংস্কৃতিকে ‘অপর’ হিসেবে চিহ্নিত করে, তাকে ব্রাত্য করেছিল। যেন বাঙালির এই নবজাগ্রত পবিত্র জাতীয়তাবোধের পরিসরে ‘অপর’ বাঙালির ‘স্কুলরুচি’র সংস্কৃতির কোনো স্থান হতে পারে না। অথচ ‘হিন্দু’-এই আইডেনটিটির মাহাত্ম্য ও শ্রেষ্ঠতায় ওই ‘অপর’-দেরও স্থান আছে। সেক্ষেত্রে তাঁদেরকে ছেড়ে আসতে হবে নিজস্ব লোকাচার, ছেড়ে আসতে হবে তাঁদের প্রজন্মবাহিত স্থূলরুচির যাবতীয় কালচার। ধর্ম এবং দেশপ্রেমের বেসিক চরিত্রই ছিল তাই—নিঃশর্ত আনুগত্য। নিঃশর্ত— আসলে কিন্তু শিক্ষিত ভদ্রসমাজের শর্তসাপেক্ষে। জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দের ইচ্ছাক্রমেই তাঁদেরকে হতে হবে দেশের জন্য নিবেদিত প্রাণ। দেশমাতৃকার পায়ে দিতে হবে আত্মবলিদান।
উনিশ শতকীয় রেনেসাঁর ট্র্যাজেডি যদি কিছু থাকে, তাহলে সেটা এটাই যে বাংলার বৃহত্তর লোক সমাজের সঙ্গে মুষ্টিমেয় শিক্ষিত আলোকপ্রাপ্ত নাগরিক সমাজের সুগভীর বিচ্ছেদ। সে বিচ্ছেদের শিকড় এতটাই গভীরে প্রোথিত হয়েছিল যে পরবর্তী শতাব্দীর আলোকপ্রাপ্ত উত্তরাধিকারীর গোটা একটা প্রজন্মকেই ওই বিচ্ছেদ মিটিয়ে ওদেরকে কাছে টানার কাজে নিজেদের উৎসর্গ করতে হয়েছিল। আমি ইঙ্গিত করতে চাইছি বিশ শতকের মার্কসবাদী কমিউনিস্ট আন্দোলনের উত্তাল ত্রিশ ও চল্লিশের বছরগুলির দিকে। আর সেই বামপন্থী আন্দোলনের শুরুর দিন থেকেই যুক্ত হয়ে গিয়েছিলেন ঠাকুরবাড়ির কালাপাহাড় সৌম্যেন্দ্রনাথ।
১৯২৫-এ যখন মুজফফর আহমদের নেতৃত্বে বাংলায় কমিউনিস্ট আন্দোলনের সাংগঠনিক সূত্রপাত ঘটে, সৌম্যেন্দ্রনাথ কিছু দিনের মধ্যেই তার সঙ্গে যুক্ত হন। প্রথম পর্বের এই সাংগঠনিক কাজকর্মে মুজফফর আহমদ, সৌম্যেন্দ্রনাথ ছাড়াও প্রথম সারিতে ছিলেন নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত, হেমন্ত সরকার, নজরুল ইসলাম, নলিনী গুপ্ত প্রমুখরা। ‘ওয়ার্কাস্ অ্যান্ড পেজেন্টস’ দলের এই কার্যকলাপই ১৯২৭-এর ডিসেম্বরে ‘ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি’-তে রূপান্তরিত হয়। ততদিনে সৌম্যেন্দ্রনাথ আশ্রয় নিয়েছেন রাশিয়ায়। যাই হোক, ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির ওই সাংগঠনিক কাজকর্ম ও প্রাথমিক অস্থিরতা পেরিয়ে তিনের দশকে তা জনপ্রিয়তার চরমে পৌঁছল। বিশ্বজুড়ে ঘটে চলা ঘটনাপ্রবাহ বিশেষত ফ্যাসিবাদের নগ্ন আগ্রাসন ও সাম্রাজ্যবাদের লোলুপ পদচারণার বিরুদ্ধে বামপন্থীদের আন্দোলন বাংলায় তাদের জনপ্রিয়তার ভিত্তি মজবুত করে। বাংলার প্রায় অধিকাংশ বুদ্ধিজীবী ও শিল্পী-সাহিত্যিক হয় প্রগতি লেখক সংঘ কিংবা ১৯৪২-এ গড়ে ওঠা ফ্যাসিবিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘের সদস্য। প্রগতিশীলতার যে মানদণ্ড সেদিন তাঁরা রেখেছিলেন,তাতে প্রতিশ্রুতি ছিল গণজীবনের সঙ্গে সংযুক্তির। খেটে খাওয়া কৃষক ও শ্রমিক, সর্বহারা মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁদের অধিকার অর্জনে সোচ্চার হওয়ার দাবি।
অথচ চারের দশকের শুরুতেই বিয়াল্লিশের আগস্ট আন্দোলন এবং তেতাল্লিশের ভয়াবহ মন্বন্তর বামপন্থী কর্মী-বুদ্ধিজীবীদের ভয়াবহ এক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করল। প্রান্তিক জেলাগুলির গ্রাম-গঞ্জে পুলিশি দমননীতিতে পিষ্ট হওয়া মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁদের সংঘবদ্ধ করে তুলতে গিয়ে কর্মীরা বুঝলেন বিচ্ছেদটা কোথায়। ‘নবান্ন’ নাটকের প্রথম অঙ্কে যুধিষ্ঠির নামে একটি চরিত্র আছে যে কংগ্রেসি নেতা। ঘোড়ায় চড়ে হঠাৎ-হঠাৎ গ্রামের মাঝে উদয় হয়ে সে যে-ভাষায় অত্যাচারিত কৃষকদের আন্দোলনে একজোট হয়ে সংগ্রামে নামতে ভাষণ দেয়- তা ওই খেটে খাওয়া মানুষদের কাছে প্রায় বিদেশি ভাষার নামান্তর। বিজন ভট্টাচার্য দেখাতে চেয়েছিলেন কংগ্রেসি নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সাধারণ মানুষের আত্মিক এবং মৌখিক দূরত্ব কতখানি। আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে গ্রামে গিয়ে এই অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই বামপন্থী বুদ্ধিজীবী পার্টিকর্মীদের হয়েছিল।
কলকাতার আলোকপ্রাপ্ত, নবজাগরণের উত্তরাধিকারী বামপন্থী বুদ্ধিজীবী পার্টিকর্মীরা তখন থেকেই উপলব্ধি করেছিলেন বিচ্ছেদের গহ্বর কোন গভীর প্রোথিত। পরের বছর, যখন তেতাল্লিশের ভয়াবহ মন্বন্তরে গ্রাম উঠে এসেছে কলকাতার ফুটপাতে। কলকাতার রাজপথে যখন জীবন্ত কঙ্কালের নির্জীব নড়াচড়া, যখন ‘ফ্যান দাও’ চিৎকারে কান পাতা দায়, যখন রাস্তায় ফুটপাতে মৃত্যুর মিছিল, তখন রিলিফের নামমাত্র সরঞ্জাম নিয়ে বামপন্থী কর্মীরা যে সেবা-শুশ্রূষা করেছিলেন, সেই তাঁদের ওই উপলব্ধির মুখোমুখি দাঁড় করায়। এ বিচ্ছেদের গহ্বর কীভাবে মিটবে। এই পর্বেই বিষ্ণু দে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত সম্পর্কে প্রবন্ধ লিখে বিগত শতকে শিক্ষিত বাবু আর অশিক্ষিত সাধারণের বিচ্ছেদের ইতিহাস মনে করিয়ে দিচ্ছেন। বলেছেন ওই বিচ্ছেদ মেটানোর মরীয়া তাগিদের কথা। গত শতাব্দীতে সেই বিচ্ছেদের কোনো সমাধান ঐতিহাসিক কারণেই সম্ভব ছিল না। কিন্তু নতুন শতাব্দীর এই বিড়ম্বিত সময়ে যখন ‘হয়তো বা নিরুপায়। ‘হয়তো বা বিচ্ছিন্নের যন্ত্রণাই বর্তমানে ইতিহাস’ (জল দাও। ‘অন্বিষ্ট’, বিষ্ণু দে), তখন জমাজ-জীবনের মরীয়া তাগিদ যেন তাঁদেরকে শেকড়ে ফেরার, শিকড়ে জল দেওয়ার আহ্বানে উদ্বেলিত করে। অন্বিষ্ট-র ‘জল দাও’ কবিতার এই পঙ্ক্তিগুলি সেই ঐতিহাসিক মিলন সম্ভাবনাকেই মনে করায়:
তোমার স্রোতের বুঝি শেষ নেই, জোয়ার ভাঁটায়,
এ-দেশে ও-দেশে নিত্য উর্মিল কল্লোলে
পাড় গ’ড়ে পাড় ভেঙে মিছিলে জাঠায়
মরীয়া বন্যার যুদ্ধে কখনো বা ফল্গু বা পল্বলে
কখনো নিভৃত মৌন বাগানের আত্মস্থ প্রসাদে
বিলাও বেগের আভা আমি দূরে
কখনো-বা কাছে পালে-পালে
কখনো বা হালে
তোমার স্রোতের সহযাত্রী চলি, ভোলো তুমি পাছে
তাই চলি সর্বদাই
যদি তুমি ম্লান অবসাদে
ক্লান্ত হও স্রোতস্বিনী অকর্মণ্য দূরের নির্ঝরে
জিয়াই তোমাকে পল্লবিত ছায়া বিছাই হৃদয়ে
তোমাতেই বাঁচি প্রিয়া
তোমারই ঘাটের গাছে
ফোটাই তোমারই ফুল ঘাটে-ঘাটে বাগানে-বাগানে।
জল দাও আমার শিকড়ে। [‘জল দাও’। অন্বিষ্ট]
চল্লিশের উত্তাল দিনগুলিতে কমরেড সহযোদ্ধারা ওই মরীয়া তাগিদ থেকেই তো নগরের রাজপথ ছেড়ে, মিছিলের শ্লোগান ছেড়ে গ্রামে নেমে এলেন সহনাগরিকদের কাস্তে-ধরা লাঙল-ধরা, গুচ্ছ-গুচ্ছ ধানের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা বলিষ্ঠ হাতগুলিকে স্পর্শ করতে। [‘এখন ভাবনা’/ ফুল-ফুটুক, সুভাষ মুখোপাধ্যায়] এই ভাবনারই শরিক পদাতিক কবি সুভাষ ‘প্রিয় ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য’ উপলব্ধি করে পার্টি মুখপত্র ‘জনযুদ্ধ’র জন্য রিপোর্টাজ লিখতে উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম সারা গ্রামবাংলা চষে বেড়ালেন। বিবাহের পর নবদম্পতি মিলে খিদিরপুরের ব্যঞ্জনহেড়িয়ায় শ্রমিক বস্তিতে শ্রমিকদের সঙ্গে দু’বছর কাটালেন। সাংস্কৃতিকভাবে সেই বিচ্ছেদ কাটিয়ে মিলনের চেষ্টাতেই গণনাট্য কলকাতার মঞ্চ ছেড়ে থিয়েটারকেই নিয়ে গেল গ্রামে-গঞ্জে, তক্তা বেঁধে, পিছনে পর্দা খাটিয়ে মানুষের সঙ্গে সংযুক্তির নতুন অধ্যায় শুরু করতে পেরেছিল ‘নয়ানপুর’ ‘শহীদের ডাক’, ‘সংকেত’, ‘ভাঙা বন্দর’, ‘বাস্তুভিটা’ প্রভৃতি প্রযোজনা।
বাংলায় বামপন্থী আন্দোলনের এই পর্যায়টিকেই আমি উনিশ শতকীয় রেনেসাঁর বিশ শতকীয় উত্তরাধিকার বলতে চাইছি। যেন প্রথমটির ব্যর্থতার দায়ভার থেকেই দ্বিতীয়টির তথা উত্তরাধিকারীর আলোকবর্তিকার সূচনা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিচ্ছেদের গহ্বরকে পূরণ করবার সাধনা। সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন রেনেসাঁর ওই উত্তরাধিকারীদের একজন। বামপন্থী আন্দোলনের শুরুর দিকে তিনি সক্রিয়ভাবে ছিলেন কিন্তু তিনের দশকে বার্লিন থেকে ফিরে আসার পর কমিউনিস্ট পার্টির মূল স্রোত থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নেন ও স্বতন্ত্র দল প্রতিষ্ঠা করে গণসংযোগের চেষ্টাতেই বাকি জীবনটা কাটিয়েছেন। যদিও তিনি খুব সফল হয়েছেন—সেটা একেবারেই বলা চলে না। বরং ব্যর্থই হয়েছেন। সাধারণ নির্বাচনে দাঁড়িয়ে বারে বারে প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন মানুষের কাছে। তাঁর ব্যর্থতার সেসব দিনগুলিই ছিল বামপন্থী আন্দোলনের তীব্রতর জনস্রোত আর প্রতিরোধের আগুন। ১৯৭৪-এ তাঁর মৃত্যুর চার বছরের মধ্যেই বিপুল জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসে বামফ্রন্ট। ততদিনে সৌম্যেন্দ্রনাথ অতীত হয়ে গেছেন।…
(‘সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর রচনা সংগ্রহ’- ১-এর ‘ভূমিকা’ হিসেবে লিখিত, নির্বাচিত অংশ)
সম্পাদক : সৈয়দ আমিরুজ্জামান
ইমেইল : rpnewsbd@gmail.com
মোবাইল +8801716599589
৩১/এফ, তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০।
© RP News 24.com 2013-2020
Design and developed by M-W-D