শহর ও গ্রামের উন্নয়ন বৈষম্য নিয়ে কেউ কি ভেবেছি?

প্রকাশিত: ১১:১৬ পূর্বাহ্ণ, জুন ৩০, ২০২৪

শহর ও গ্রামের উন্নয়ন বৈষম্য নিয়ে কেউ কি ভেবেছি?

Manual3 Ad Code

ড. জেবউননেছা |

কেন রাজধানী ঢাকায় বাড়ি বাড়ি ‘টু-লেট’ ঝুলছে? কেন গ্রামের বিশুদ্ধ বাতাস, পুকুরের মাছ, ছড়িয়ে থাকা শাকপাতা, মায়ের আঁচল ছেড়ে ঢাকায় ছোট ছোট কক্ষে আবদ্ধ হয়েছিল মানুষ? কেন বাচ্চারা দূষণমুক্ত প্রকৃতির সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত হলো? উত্তর একটিই- শহরে কর্মস্থল, লেখাপড়া, হাসপাতাল, সুযোগ-সুবিধা থাকলে সেখানেই তো মানুষ ভিড় করবে। একবাক্যে বলা যায়, এই সুবিধাগুলো যদি হাতের কাছে থাকত, কেউ নিজ বাসভূম ছেড়ে আসত না।

এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ঢাকায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৪৮টি। সর্বোচ্চ সংখ্যক ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলও ঢাকায় রয়েছে। ঢাকায় কলেজ রয়েছে ২২২টি। মাদ্রাসার ২৮ শতাংশ শিক্ষার্থী ঢাকায় পড়াশোনা করে। বছরে ঢাকা শহরে নতুন করে ছয় লাখ ১২ হাজার লোক যুক্ত হয়। দিনে যুক্ত হয় ১৭০০ মানুষ। ঢাকায় ১,৫৫৫টি কারখানা রয়েছে। উইকিপিডিয়ার হিসাবমতে, ঢাকায় চার লাখ থেকে সাড়ে চার লাখ রিকশা চলাচল করে। বিআরটিএর হিসাবমতে, সিএনজির সংখ্যা ১৩ হাজার। রাজধানীতে কেন মাত্রাতিরিক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান- কেউ কি ভেবেছি?
ঢাকায় ইটভাটা রয়েছে ৪৮৭টি। ঢাকার বায়ুদূষণের ৫৮ শতাংশ উৎস ইটভাটা থেকে নির্গত হচ্ছে। এ কারণেই রাজধানী ঢাকা শহরে প্রতিবছর ১,২৫০টি শিশু মৃত্যুবরণ করে। ইট তৈরিতে ১৮০ বর্গকিলোমিটার কৃষিজমির উর্বরতা নষ্ট হচ্ছে। প্রায় ৮০ লাখ টন কাঠ ও কয়লা পুড়ছে। যা থেকে পরিবেশে আনুমানিক দুই কোটি টন কার্বন নির্গত হচ্ছে। বায়ুদূষণের ফলে ঢাকার গাছপালায় ৪৩৬ টন ধুলা জমে। সেই হিসাবে প্রতিমাসে ১৩ হাজার টন ধুলা জমছে। বায়ুদূষণের প্রভাব নিয়ে রাজধানীর ছয়টি স্কুলের শিক্ষার্থীদের নিয়ে একটি গবেষণা করা হয়। গবেষণায় দেখা যায়, ২৪ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর ফুসফুসের সক্ষমতা কমছে। এ বিষয় কেউ ভেবেছি?

Manual6 Ad Code

রাজধানী ঢাকায় ২১ দশমিক ৫৭ শতাংশ উন্মুক্ত জায়গা রয়েছে। যার মধ্যে ০.৮৯ শতাংশ পার্ক, নগরের গাছপালা ০.০২ শতাংশ, বাগান ০.৯ শতাংশ, কৃষি ১২ দশমিক ১২ শতাংশ। ঢাকা কাঠামো পরিকল্পনা অনুযায়ী উন্মুক্ত জায়গা থাকার কথা ২০ শতাংশ। কিন্তু পার্ক, গাছপালাসহ আছে ১৫ শতাংশের কম। ঢাকা মেট্রোপলিটন উন্নয়ন পরিকল্পনায় দেখা যায়, পুরান ঢাকায় ৫ শতাংশ এবং নতুন ঢাকায় ১২ শতাংশ উন্মুক্ত জায়গা রয়েছে। কিন্তু কেন ঢাকায় এত চাপ, কেউ কি ভেবেছি?

অথচ গ্রামের সাধারণ মানুষ কৃষিকে নিয়ে গেছে কত উচ্চে। বর্তমানে বিশ্বে বাংলাদেশ চাল উৎপাদনে চতুর্থ, স্বাদু পানির মাছে তৃতীয়, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, বিশ্বে বাংলাদেশের মোট ইলিশের উৎপাদন ৮৬ শতাংশ, ছাগল উৎপাদনে চতুর্থ, আলু উৎপাদনে অষ্টম, ফল উৎপাদনে দশম। বাংলাদেশ এখন বিশ্বে কাঁঠাল উৎপাদনে দ্বিতীয়, আমে সপ্তম, পেয়ারায় অষ্টম ও পেঁপেতে ১৪তম। বিগত ২০১৯ সালে ৪২ লাখ ৭৬ হাজার টন মাছ উৎপাদিত হয়েছে এবং চাষ থেকে ২৪ লাখ টন মাছ উৎপাদিত হচ্ছে, যা মোট উৎপাদনের প্রায় ৫৬ শতাংশ। পোলট্রি শিল্প এখন ৩০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগের বাজার। দেশে এখন ৯৫ শতাংশ জমি পাওয়ার টিলার এবং ট্রাক্টর দিয়ে চাষ হচ্ছে। ৭৬ শতাংশ জমিতে সেচ দেওয়া হয় পাম্পের মাধ্যমে। বর্তমানে সবজি বীজের বাজার প্রায় ৮০০ কোটি টাকার। এই শিল্পে যদি শিক্ষিত মানুষ নিয়োজিত থাকত, তাহলে কৃষিপণ্য উৎপাদনে আমাদের অবস্থান কোথায় থাকত তা কেউ কি ভেবেছি?
করোনাকালে রাজধানী ঢাকা থেকে এক কোটি মোবাইল ফোনের গ্রাহক এখন তাদের নিজ গ্রামে গিয়েছিল। তখন জনমানবশূন্য রাজধানী ঢাকা বিশ্বে বায়ুদূষণের দিক থেকে অষ্টম স্থান অধিকার করেছিল। সঠিক শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা যদি প্রতিটি জেলায় করা যেত, তাহলে কেউ নিজের ঘরবাড়ি ছেড়ে রাজধানীতে এসে ভিড় জমাত না। এটি নিয়ে কেউ কি ভেবেছি?
অপরিকল্পিত নগরায়ণ, যত্রতত্র ভবন নির্মাণ করে রাজধানী ঢাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, শিল্পকারখানা ও ইটভাটায় ঢাকা হয়েছে যান্ত্রিক নগরী। ঢাকামুখী হওয়ার জন্য গ্রামের যৌথ পরিবার ভেঙে যাচ্ছে, বাচ্চারা গ্রামের শিকড় ভুলে যাচ্ছে। গ্রামে শক্তিশালী রাস্তাঘাট নির্মাণ, পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন হাসপাতাল, মানসম্মত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ, চাকরির সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি, কৃষি- শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং কলকারখানা নির্মাণ প্রয়োজন- এটা নিয়ে কেউ কি ভেবেছি?

Manual8 Ad Code

মানসিক, শারীরিক এবং সামাজিক স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য এবং সুস্থ একটি প্রজন্ম সৃষ্টির লক্ষ্যে শিক্ষানীতি, স্বাস্থ্য নীতি, নগরায়ণের নীতিকে ঢেলে সাজানোর এখন সময়ের দাবি। পরিবেশ, সুস্বাস্থ্য এবং জীবনধারণ এ বিষয়গুলোই এখন বিবেচ্য বিষয়। তবে কৃষিক্ষেত্রে উদ্যোক্তা বৃদ্ধির জন্য এবং বেকারত্বের চাপ সামাল দিতে আগামী দিনগুলোতে গবাদি পশু পালন ও মাছ চাষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তরুণদের স্বল্প সুদে ঋণ প্রদান শিক্ষিত তরুণদের গ্রামমুখী করা যেতে পারে। তখন স্বাভাবিকভাবেই মানুষ তার নিজের ঠিকানায় বাস করবে, কাজ হারিয়ে ঢাকা ছাড়ার এই দুঃখী ছবি দেখতে হবে না। বাচ্চারা গ্রামের আকাশে রংবেরঙের ঘুড়ি ওড়াবে। সুস্থভাবে বেড়ে উঠবে তার আপন আলোয়।

সংবিধানের ১৬ অনুচ্ছেদে বলা আছে- গ্রাম-নগর বৈষম্য কমাতে হবে। গ্রামের মানুষদের পেছনে ফেলে উন্নয়ন সম্ভব নয়। সবাইকে নিয়েই এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ। অনাগত ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার জন্য গ্রাম-শহর দুই স্থানকেই হতে হবে সামঞ্জস্যপূর্ণ। নইলে উপচেপড়া মানুষের ভিড়ে রাজধানী ঢাকা একদিন তার প্রাণ হারাবে। বাচ্চারাও বায়ুদূষণের ফলে অসুস্থ হয়ে পড়বে।

Manual8 Ad Code

#
ড. জেবউননেছা
সহযোগী অধ্যাপক
লোকপ্রশাসন বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

Manual3 Ad Code

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ