সিলেট ৬ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২১শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ১১:২২ পূর্বাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২৭, ২০২৪
(এটি কোন গবেষণা লব্ধ কর্ম নয়, লেখাটি লিখেছেন যিনি তিনি তাঁর নিজস্ব রেটিং অনুসারে লেখক বাছাই করেছেন।)
বিশ্বসাহিত্যের উপর অজস্র লেখালেখি হয়েছে। বিশ্ব সাহিত্যের সেরা প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নির্বাচনের ব্যাপারে অনেক রকম মত থাকাই স্বাভাবিক। তবে আলোচনাগুলোই একটা নকশা দাঁড় করিয়ে দিয়েছে যার ওপর থেকে আমরা সহজে বিশ্বসাহিত্যের দিগগজদের বের করে আনতে পারি।
জনপ্রিয় ইংরেজ সাহিত্যিক উইলিয়াম সমারসেট মম এর লেখা টেন নভেলস এন্ড দেয়ার অথর্স বই এই কাঠামোর একটা শক্ত খুঁটি হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। বইটিতে মম তলস্তয়, দস্তয়ভস্কি, বালজাক, ফ্লবেয়ার, চার্লস ডিকেন্স, হারম্যান মেনভিল, স্তাঁদল, হেনরি ফিল্ডিং, জেন অস্টেন, এমিলি ব্রন্টির ওপর আলোচনা করেছেন। ১৯৫৪ সালে এ বই প্রকাশিত হয়। মম বোধ হয় তখনও বেঁচে ছিলেন এমন কোনও ঔপন্যাসিককে আলোচনায় আনতে চাননি। ফলে বিশ্বসাহিত্য নিয়ে মম গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করলেও তিনি বিশ্বসাহিত্যের সার্বিক চিত্র আমাদের সামনে তুলে ধরেননি।
২০০১ সালে ডানিয়েল এস. বার্ট নামক এক আমেরিকান লেখক দি লিট্যারারি হান্ড্রেড নামে একটা বই প্রকাশ করেন। এই বইতে লেখক ১০০ জন সাহিত্যিককে সর্বকালের সেরা প্রভাবশালী সাহিত্যিক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ওপরে যেই নকশার কথা বলা হয়েছে তা যেন এই বইটাতে পরিপূর্ণতা লাভ করেছে। বার্টের গবেষণা এত গভীর যে এই বইয়ে উল্লেখিত সাহিত্যিকরা যে বিশ্বসাহিত্যের সেরা মোড়ল, এ নিয়ে সমকালীন বিশ্বের কোনও সাহিত্য-বোদ্ধাকে তেমন কোনও বড় দ্বিমত পোষণ করতে দেখা যায়নি। উইলিয়াম সমারসেট মম যেখানে শুধু উপন্যাসকে বিচার করেছেন, এবং ইউরোপীয় ও আমেরিকান উপন্যাস থেকে দশটি উপন্যাস বেছে নিয়েছেন, বার্ট সেখানে সাহিত্যের সব শাখায় হাত দিয়েছেন এবং সারা পৃথিবীর সাহিত্যিকদের বিবেচনায় এনেছেন। বার্ট এর তালিকায় সর্ব কালের সেরা প্রভাবশালী সাহিত্যিকদের তালিকায় এক নম্বরে আছেন উইলিয়াম শেক্সপিয়ার। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আছেন ৯০ নম্বরে।
বার্টের বিবেচনার সাথে একমত হয়ে এখানে সংক্ষেপে প্রথম পাঁচ জন সাহিত্যিকের সংক্ষিপ্ত জীবন ও শ্রেষ্ঠ বইগুলো নিয়ে আলোচনা করছি।
০১. উইলিয়াম শেক্সপিয়ার
উইলিয়াম শেক্সপিয়ার সম্পর্কে আমরা সবাই কম বেশি জানি। শেক্সপিয়ার যে সর্বকালের সেরা প্রভাবশালী সাহিত্যিক তা নিয়ে দ্বিমত করবেন এমন সাহিত্যবোদ্ধা হাজারে এক জন মিললেও মিলতে পারে। শেক্সপিয়ার এর জীবনের দৈর্ঘ ছিল ৫২ বছর। জন্ম ১৫৬৪ সালে। মৃত্যু ১৬১৬ সালে। ১৮ বছর বয়সে শেক্সপিয়ার ২৬ বছর বয়সের নারী এন হাথওয়েকে বিয়ে করেন। তাঁরা দুই কন্যা ও এক পুত্রের জন্মদান করেন। সুস্বাস্থ্যের অধিকারী শেক্সপিয়ার হঠাৎ জ্বরে মারা যান। শেক্সপিয়ারের বৈবাহিক জীবন সুখের ছিল না। পরিপূর্ণ জীবনের বিশ বছর তিনি লন্ডনে একা বাস করেছেন। অনেক নারীর সাথে প্রেম করেছেন। ব্যক্তিগত জীবনে কোনওদিন সুখ পেয়েছেন, এমন নজির নাই। তা ছাড়া তাঁর পুত্র হ্যামনেন্ট শেক্সপিয়ারের অকালমৃত্যুতে অনেক কষ্ট পেয়েছেন। এই পুত্রকে নিয়ে তিনি তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত নাটক হ্যামলেট লিখেছেন বলে ব্যাপকভাবে ধারণা করা হয়। হ্যামলেটের এই নাটকটা আত্মজৈবনিক বলে অনেকে মত দিয়েছেন।
‘শেক্সপিয়ার এর সাহিত্যে মানুষ চারশ বছর আগে যেমন নিজের আবেগ খুঁজে পেত এখনও তেমনি পায়। বিলাতের রাজনৈতিক জীবনের উত্থান-পতন, ব্যক্তির জীবনে অসুখী প্রেম, দাম্পত্য জটিলতা, কামনার শিল্পরূপ এই চারটি বিষয়কে উপজীব্য করে শেক্সপিয়ার সাহিত্য রচনা করেছেন। শেক্সপিয়ারের শিল্প প্রকাশের কৌশল ছিল নাটকীয়তা। সমালোচকরা এটাকে আতিশয্য বলতেই পারেন। তবে নাটকীয়তা ছাড়া শেক্সপিয়ারের সাহিত্য এত সুখপাঠ্য যে হত না, তা বলা যায়’।
শেক্সপিয়ার ছিলেন নাট্যকার, কবি ও অভিনেতা। তাঁর লেখা ১৫৪টা সনেট ইংরেজি ভাষায় রচিত সুন্দরতম পদ্যের অন্তর্গত। কবিতা ও নাটক দুটোর কারণেই অমর হলেও শেক্সপিয়ারের নাটকই তাঁকে সারা বিশ্বে খ্যাতিমান করে। তাঁর ৩৮টা নাটকের মধ্যে বিখ্যাত দশটা নাটক হলো হ্যামলেট, ম্যাকবেথ, মিডসামার নাইট’স ড্রিম, কিং লিয়ার, টুয়েলফ্থ নাইট, দ্য টেম্পেস্ট, রোমিয়ো এন্ড জুলিয়েট, দ্য মার্চেন্ট অব ভেনিস, জুলিয়াস সিজার। এর অনেকগুলো নাটকেরই বাংলা অনুবাদ পাওয়া যায়।
শেক্সপিয়ার এর সাহিত্যে মানুষ চারশ বছর আগে যেমন নিজের আবেগ খুঁজে পেত এখনও তেমনি পায়। বিলাতের রাজনৈতিক জীবনের উত্থান-পতন, ব্যক্তির জীবনে অসুখী প্রেম, দাম্পত্য জটিলতা, কামনার শিল্পরূপ এই চারটি বিষয়কে উপজীব্য করে শেক্সপিয়ার সাহিত্য রচনা করেছেন। শেক্সপিয়ারের শিল্প প্রকাশের কৌশল ছিল নাটকীয়তা। সমালোচকরা এটাকে আতিশয্য বলতেই পারেন। তবে নাটকীয়তা ছাড়া শেক্সপিয়ারের সাহিত্য এত সুখপাঠ্য যে হত না, তা বলা যায়। গত চার শতকে ইংরেজি ভাষার অনেক পরিবর্তন হলেও শেক্সপিয়ারের সৃষ্টির মানুষের মনকে প্রভাবিত করার ক্ষমতার কোনও পরিবর্তন হয়নি।
০২. দান্তে আলিগিয়েরি
বার্ট এর গবেষণায় সর্বকালের সেরা ১০০ প্রভাবশালী সাহিত্যিক এর তালিকায় দ্বিতীয় স্থান দখল করেছেন ইতালির দান্তে আলিগিয়েরি। তাঁর জন্ম ফ্লোরেন্স শহরে, ১২৬৫ সালে, আর মৃত্যু ১৩২১ সালে। ৫৬ বছরের জীবন। জ্ঞানী মানুষ হিসাবে দান্তের অনেক পরিচয় আছে। কিন্তু তিনি যে জন্য বিখ্যাত তা হলো ১৪,২৩৩ লাইনের একটা কবিতা। যেটাকে তিনি নাম দিয়েছিলেন কমেডি। বিশ্ব সাহিত্যের আর এক মহারথি, তিনিও ইতালিয়ান, জোভানি বোকাচিও এই কবিতাটার নামের আগে ডিভাইন শব্দটি যোগ করেন। শেষ পর্যন্ত এই বৃহৎ কবিতাটা তিনটি খন্ডে বিভক্ত করে প্রকাশিত হয়। প্রথমটার নাম ইনফার্নো বা দোজখ। দ্বিতীয়টার নাম পারগাটরি বা আত্মার শুদ্ধিস্থান। তৃতীয়টার নাম প্যারাডাইস বা বেহেশত। কবিতার ঘটনাটা এ রকম: এক দিন দান্তে সহসা নিজেকে একটা জঙ্গলের মধ্যে খুঁজে পান। আসলে সেটা পরকাল। তিনি সেখানে তাঁর গুরু এবং আর এক ইতালিয়ান মহারথি কবি ভার্জিলের দেখা পান। ভার্জিল তাঁকে পুরো দোজখ আর আত্মার শুদ্ধিস্থানের বেশির ভাগ ঘুরিয়ে দেখান। তারপর ভার্জিল দান্তেকে তরুণী বিয়াত্রিচের কাছে সমর্পণ করেন যিনি দান্তেকে আত্মার শুদ্ধিস্থান এর বাকি অংশ আর বেহেশতের বেশির ভাগ ঘুরিয়ে দেখান। তারপর দান্তেকে বেহেশতের অবশিষ্ট অংশ ঘুরিয়ে দেখান সন্ত বার্নাড। খ্রিস্টান ক্যাথলিক ধর্ম বিশ্বাসে পরকালের যে বর্ণনা আছে দান্তে এই কবিতার মধ্য দিয়ে পাঠককে তার পুরোটা দেখিয়ে দেন। রূপকার্থে কবিতাটা মূলত ঈশ্বরের দিকে আত্মার যাত্রা পথের বিবরণ দেয়। তবে দান্তের বর্ণনা অনেক ব্যাপক, অকৃত্রিম আর অন্তর্ভেদী। কবিতায় বর্ণিত পরকালে দান্তে ইতিহাসের সব বিখ্যাত চরিত্রের দেখা পান এবং আরও দেখা পান তাঁর শহর ফ্লোরেন্সের অনেক বাসিন্দার। দান্তে তাঁর সময়কার ফ্লোরেন্সের স্থানীয় ভাষায় তাঁর কবিতা লেখেন যা বর্তমানে সমগ্র ইতালির সাহিত্যের ভাষা। বার্ট এর বর্ণনায় এক নম্বর প্রভাবশালী সাহিত্যিক শেক্সপিয়ার এর রচনাবলীর দৈর্ঘ মোটামুটি শরৎ রচনাবলীর দৈর্ঘের সমান। আর দান্তের ডিভাইন কমেডির তিন খন্ড আনুমানিক রবীন্দ্রনাথের সঞ্চয়িতার সমান।
০৩. হোমার
বার্ট এর তালিকায় তৃতীয় স্থানে আছেন হোমার। হোমার এর জন্ম ১২০০ থেকে ৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের যে কোনও সময়ে হতে পারে। হোমার সম্পর্কে দ্বিতীয় বড় যে কথাটা জানা যায় তা হলো তিনি অন্ধ ছিলেন। আর তাঁর সম্পর্কে সবচেয়ে বড় যে কথাটা আমরা জানি তা হলো তিনি ইলিয়াড আর অডিসি মহাকাব্যের রচয়িতা। তবে এক জন কবিই মহাকাব্য দুটি রচনা করেছেন নাকি তা অনেক চারণের রচণার সামষ্টিক ফল, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। এমনকি শেক্সপিয়ার নিয়েও এমন একটা বিতর্ক আছে, যদিও তা অনেক সীমিত পর্যায়ে।
‘তলস্তয়ের সবচেয়ে পরিচিত উপন্যাস হলো আনা কারেনিনা যা প্রেমের উপন্যাস, যা বেশি বিখ্যাত হয়েছে পরকিয়া প্রেম এর গল্প হয়ে। আনা কারেনিনা উপন্যাসের মধ্যে দুটি সমান্তরাল গল্প আছে। একটি আনা বা আন্নার অশান্ত প্রেম। আর একটি লেভিন নামক এক জমিদারের শান্তিপূর্ণ গ্রামীণ জীবন। লেভিনের কাহিনি তলস্তয়ের জীবনের চিত্র বলা যেতে পারে’
হোমারের জন্ম আধুনিক তুরস্কের পশ্চিম অংশে, এক সময় যা গ্রিসের অধীন ছিল। হোমারের জন্ম যখন হয়েছিল বলে ধারণা করা হয় তখনও তুরস্কের ওই অংশ, অ্যানাতোলিয়া, গ্রিসের অধীনে আসেনি। আমি ধারণা করি গ্রিকরা হোমার এর পদ্যকে তাঁদের ভাষায় রূপান্তরিত করে নেন, যেই ভাষা ক্লাসিক্যাল গ্রিক ভাষা হিসাবে পরিচিত। ইলিয়াড-এর কাহিনি হলো গ্রিকদের সাথে ট্রয় নামক রাষ্ট্রের দশ বছর ব্যাপী যুদ্ধ, যে যুদ্ধের নাম ত্রোজান যুদ্ধ, যে যুদ্ধে গ্রিকরা অনেক কষ্টে জয়ী হয়। আর অডিসি হলো ত্রোজান যুদ্ধ ফেরত বীর অডিসিয়াসের ঘরে ফেরার কাহিনি যে ভ্রমণ চলেছে দশ বছর ধরে। দুটো কাহিনিই পৌরাণিক যদিও এখন কেউ কেউ বিশ্বাস করেন ট্রয় নগরীর অস্তিত্ব ছিল।
কোনও বিতর্কে না গিয়ে যা নিশ্চিতভাবে বলা যায় তা হলো সাহিত্যে ইলিয়াড আর অডিসির প্রভাব। আড়াই হাজারেরও বেশি সময় ধরে এ দুটি মহাকাব্য বিশ্ব সাহিত্যকে প্রভাবিত করে এসেছে, এমনকি আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির ওপরও তাদের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। সাহিত্যের উত্তরাধুনিক কালে, যার বয়স এখন ষাট কি সত্তর বছর, রচিত কিছু পরীক্ষা-নীরিক্ষামূলক নাটক, উপন্যাস, ছোট গল্প ছাড়া সমস্ত গদ্য সাহিত্যের গঠনে রয়েছে ইলিয়াড আর অডিসির আদল।
গ্রিক মিথোলজি বা গ্রিক পুরাণ যাঁদের হয়ে আমাদের হাতে এসে পৌঁছেছে তাঁদের মধ্যে হোমার সবচেয়ে বিখ্যাত। বিখ্যাত সব গ্রিক দেব-দেবী যেমন জিউস, পসাইডন, আথিনা, আফ্রোদিতে, অ্যাডোনিস, সবাইকে আমরা হোমারের চোখে তথা ইলিয়ড ও অডিসির বর্ণনায় দেখি।
০৪. লিয়ো তলস্তয়
রাশিয়ার ঔপন্যাসিক ও ছোট-গল্পকার তলস্তয়ের জন্ম ১৮২৮ সালে আর মৃত্যু ১৯১০ সালে। ৮২ বছরের দীর্ঘ জীবন তাঁর এমন এক সময়ে যখন পৃথিবীতে মানুষের গড় আয়ু ছিল ২০ বছরের মতো। তলস্তয় ছিলেন জমিদার। তখনকার রাশিয়াতে জমিদার আর প্রজা এই দুই শ্রেণির মানুষ ছিলেন। আর স্বল্পসংখ্যক মানুষ, ৫% এরও কম, ছিলেন বিভিন্ন পেশাজীবী।
তলস্তয়ের সবচেয়ে পরিচিত উপন্যাস হলো আনা কারেনিনা যা প্রেমের উপন্যাস, যা বেশি বিখ্যাত হয়েছে পরকিয়া প্রেম এর গল্প হয়ে। আনা কারেনিনা উপন্যাসের মধ্যে দুটি সমান্তরাল গল্প আছে। একটি আনা বা আন্নার অশান্ত প্রেম। আর একটি লেভিন নামক এক জমিদারের শান্তিপূর্ণ গ্রামীণ জীবন। লেভিনের কাহিনি তলস্তয়ের জীবনের চিত্র বলা যেতে পারে।
তলস্তয়ের আর একটি বিখ্যাত উপন্যাস ওয়ার এন্ড পিচ। যা নেপোলিয়ন এর রাশিয়া আক্রমণের কাহিনি। এই উপন্যাসটা এ যাবৎ প্রকাশিত বৃহৎ উপন্যাসগুলোর একটি। তবে বিখ্যাত উপন্যাসের মধ্যে আর দুটো উপন্যাস আছে যাদের দৈর্ঘ ওয়ার এন্ড পিচ এর চেয়ে বড়। একটা হলো মার্চেল প্রাউস্ত এর ইন সার্চ অব লস্ট টাইম আর অন্যটা হলো স্যামুয়েল রিচার্ডসন এর ক্লারিসা। তবে শিল্প মূল্যের বিচারে ক্লারিসা উপন্যাসটা অন্য দুটোর ধারে কাছে নাই। বড় হলেও উপন্যাসটা বেশ সুখপাঠ্য। এর কারণ হলো তলস্তয়ের গল্প বলার প্রতিভা। প্রতি প্যারায় টেনশন আর নাটকীয়তার উপস্থিতি। আর তলস্তয়ের চরিত্র সৃষ্টির অনন্যসাধারণ ক্ষমতা।
তলস্তয়ের তৃতীয় বৃহৎ উপন্যাস হলো রিসারেকশন। এই তিনটি বাদ দিলে তলস্তয়ের অন্য লেখাগুলোর পরিধি ছোট। অনেকটা বড় গল্পের আকার। তলস্তয় অনেক ছোট গল্পও লিখেছেন। শেষ বয়সে এসে তলস্তয় পরিবার ছেড়ে দেন আর কিছু শিক্ষামূলক লেখা লেখেন যেগুলো তেমন মানসম্পন্ন লেখা নয়, অন্তত তলস্তয়ের অমর সৃষ্টিগুলোর তুলনায়। বাড়ি ছেড়ে বেড়িয়ে পড়া তলস্তয়ের মৃত্যু হয় এক রেল স্টেশনে, রেল কর্মচারির বাড়িতে। আনা কারেনিনা আর ওয়ার এন্ড পিচ এর পর তলস্তয়ের যে লেখাটা আমার দৃষ্টিতে শিল্পমানে অসাধারণ তা হলো একটা বড় গল্প যার নাম দ্য ডেথ অব ইভান ইলিচ।
জমিদার হয়েও তলস্তয় সমাজতন্ত্রের সমর্থক ছিলেন। তলস্তয়ের মৃত্যু হয় নোবেল প্রাইজ প্রচলনের দশ বছর পর। বার বার নামটা বিবেচনায় আসার পরও তলস্তয়কে নোবেল প্রাইজ দেওয়া হয়নি। সাহিত্যে প্রথম নোবেল প্রাইজ পান ফ্রান্সের কবি সুলি প্রধোম। এই কবির কবিতা এখন আর পড়া হয় না।
নোবেল পুরস্কার বিশ্বের সবচেয়ে বড় পুরস্কার। এই পুরস্কার নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে, সমালোচনা আছে। অনেক নিচু মানের সাহিত্যিককে নোবেল প্রাইজ দেয়া হয়েছে আবার অনেক বড় সাহিত্যিক তা পাননি। তলস্তয়কে নোবেল প্রাইজ দিয়ে সুইডিশ অ্যাকাডেমি নিজেদের সম্মানিত করে রাখতে পারত। তলস্তয়ের লেখা সারা পৃথিবীতে পড়া হয় এবং তাঁর জনপ্রিয়তায় কখনও ভাটা পড়েনি।
০৫. জেফ্রি চ’চার
ইংরেজ কবি জেফ্রি চ’চার এর জন্ম ১৩৪২ কি ৪৩ সালে আর মৃত্যু ১৪০০ সালে। তাঁর লেখা দি ক্যান্টারবেরি টেলস এর চব্বিশটা গল্প বার্টের বিবেচনায় চ’চারকে সর্বকালের সেরা সাহিত্যিকদের মধ্যে পঞ্চম স্থান প্রদান করেছে।
চ’চার সর্বপ্রথম সাহিত্যে ইংরেজি ভাষাকে জনপ্রিয় করেন। তখন পর্যন্ত খোদ বিলাতেও লাতিন, ইতালীয় আর ফরাসি ভাষায় সাহিত্য চর্চা হতো। চ’চারের পিতা ও পিতামহ ইংল্যান্ডের রাজ পরিবারে মদ সরবরাহ করতেন আর সেই সুবাদে চ’চার প্রথমে রাজ পরিবারের ভৃত্য এবং পরে রাজা তৃতীয় এডওয়ার্ডের ব্যক্তিগত পাচক ও খানসামা হিসাবে কাজ করেন। ক্রমে তিনি সরকারি কর্মচারি হিসাবে পদোন্নতি পেয়ে ফ্রান্স ও ইতালিতে কূটনৈতিক দায়িত্ব পালন করেন এবং পরে শুল্কবিভাগের উচ্চ পদে বসেন। তৃতীয় এডওয়ার্ডের পর রাজা হন দ্বিতীয় রিচার্ড আর চ’চারও চাকরি হারান। ফলে তাঁর হাতে সময় আসে ক্যান্টারবেরি টেলস লেখার।
দি ক্যান্টারবেরি টেলস এর গ্রন্থ পরিকল্পনা: লন্ডন থেকে ৫৪ মাইল দূরে ক্যান্টারবেরির গির্জার উদ্দেশে বের হওয়া ৩০ জন তীর্থযাত্রী পথে ট্যাবার্ড ইন নামক এক সরাইখানায় জড়ো হয়ে গল্প বলার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। আসা ও যাওয়ার পথে প্রত্যেক তীর্থযাত্রীর মুখ থেকে ৪টা করে মোট ১২০টা গল্প তৈরির পরিকল্পনা ছিল চ’চারের। তবে তিনি মাত্র চব্বিশটা গল্প শেষ করেন। আর তাতেই তিনি মধ্যযুগের ইউরোপের জীবনের এক বৃহৎ চিত্র উপস্থাপন করেন যেখানে ধনীর গল্প, গরিবের গল্প, অনুমোদনবিহীন প্রেমের গল্প, ঈশ্বরের নৈকট্য লাভের গল্প সব বলা হয়ে গেছে।
দি ক্যান্টারবেরি টেলস চ’চারের লেখা ভাষায় পড়া আমাদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। দি ক্যান্টারবেরি টেলস এর গল্পগুলোকে অনেকে আধুনিক ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন। পেঙ্গুইন কর্তৃক প্রকাশিত নেভিল কগিল এর অনুবাদটা সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়েছে। চ’চার দি ক্যান্টারবেরি টেলস ছাড়াও আরও দশ কি এগারোটা কাব্য রচনা করেছেন। তাঁর সাহিত্যে মধ্যযুগের ইউরোপের যে নিখুঁত চিত্র পাওয়া যায় তার তুলনা নাই।
#
কালেকশন ফ্রম পুঁথিতীর্থ
সম্পাদক : সৈয়দ আমিরুজ্জামান
ইমেইল : rpnewsbd@gmail.com
মোবাইল +8801716599589
৩১/এফ, তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০।
© RP News 24.com 2013-2020
Design and developed by M-W-D