আমাদের বন্ধু ফটো সাংবাদিক শওকাত জামিল

প্রকাশিত: ৩:৫৩ পূর্বাহ্ণ, অক্টোবর ৩, ২০২৪

আমাদের বন্ধু ফটো সাংবাদিক শওকাত জামিল

মনির মহিউদ্দিন |

শওকাতকে আমরা শওকত নামেই ডাকতাম। হ্যাংলা পাতলা মানুষ। আর কথা বলে মিনমিনে গলায়। একটা প্রেমের অসমাপ্ত গল্পে বাতাসের জোর লাগাতে ও আমার ঘনিষ্ঠ হয়। সে স্কুল জীবন থেকেই সেখানে ওর ঘুর ঘুর। কিন্তু মূল্যবান কন্যা রত্নটি শওকাতকে মোটেই পাত্তা দিচ্ছিল না। আর জুৎ হচ্ছিল না কিছুতেই। শর্ত প্রতি শর্ত ক্রমশঃই এ সম্পর্কের বাঁধা হয়ে রয়। আর বাধ্য হয়েই আমাকে কিছুটা দৌঁড় ঝাপও করতে হয়।কতদিন বি এম স্কুলের রকে বসে শওকতের এ দুঃখের বয়ান শুনেছি। শুনেছি সদর রোড থেকে হাটতে হাটতে বগুড়া রোড অবধি। ফলাফল শূন্য। অই সম্পর্কের প্রথাগত বিচ্ছিন্নতা না হলেও। অনিবার্য বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। শওকাত কিছুটা কিছুদিনের জন্য দেবদাসও হয়ে যায়। কিন্তু আমার সাথে ওর সম্পর্ক কখনো গাঢ় না হলেও বিচ্ছিন্ন হয় নি। দেখা হলেই নানা কথা প্রসঙ্গ। নানা কথা। এর মধ্যেই ও ভর্তি হয় ইকোনকমিক্সএ আর আমি ইতিহাসে। আর অনিবার্যভাবেই নিয়মিত টিএসসি, হাকিম ভাইর চা’র দোকান, মধুর ক্যান্টিনে কখনো না কখনো দেখা হতেই থাকে। মাঝে মাঝে সে আবার আমাদের দলের সাথে ঘোরাঘুরিও করতে থাকে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের সাথেও ওর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ইতিমধ্যে আমরা লক্ষ্য করি শওকাত একটা ক্যামেরা কাঁধে নিয়ে একজন ফটোগ্রাফারের ভূমিকা নিচ্ছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু মঈনুও তখন ছবি তোলা নিয়ে নিয়মিত মসকো করে। ওরা একটু এনিয়ে ফুসফাসও করে।

তারপর আমরা দুজনই কেমনভাবে আলোকচিত্র জগতের মানুষ হয়ে উঠি। ফলে অনিয়মিত হলেও শওকত আমার সাথে আড্ডা মারতে আসে। কোন ফটোগ্রাফার কিছু রঙিন ছবি প্রিন্ট করাবে শওকতও ওনার সাথে চলে এলো আমার সাথে আড্ডা মারতে।শওকত একদিন আমার নতুন সংসারে এসে আমাদের ছবিও তুলে দিয়েছিল। যত্নের সাথে তা সংরক্ষিত আছে। সুযোগ হলে পোস্ট দেবো। আমাদের সম্পর্কটা কিন্তু একই রকম থাকে। ওটা কখনো মাত্রা ছাড়ায় নি।কাজের শুরুতেই শওকতও পত্রিকার জন্য অনেক ঝুঁকি নিয়ে ছবি তুলতে শুরু করে। যাদের প্রেস ফটোগ্রাফি সম্পর্কে ধারনা আছে তারা বুঝবেন বিষয়টি। ইতিমধ্যে সে অনার্স এবং এম এ ও পাশ করে ফেলে। ছাত্র হিসেবেও বরাবরই ভাল ছাত্র।

একটা কথা এখানে বলা প্রয়োজন। দেশের অন্যতম শীর্ষ ঔষধ কোম্পানি অপসোনিন শওকতের চাচা খালেক সাহেবের প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান। ওর চাচার পরিবার থেকে শওকতকে অনেকবার ওখানে কাজে যোগদানের জন্য বলা হয়েছে। এমন কী ওর চাচাত ভাই নান্টু ব্যক্তিগতভাবে আমাকে অনুরোধও করেছিল। নান্টুকে আমি খুব স্কুল বয়স থেকে জানি। ও আমার ছোট মামার ঘনিষ্ঠ বন্ধুও। আমি ওকে সব কথা বুঝিয়েও বলি। ততদিনে আলোকচিত্র শওকতের মজ্জাগত হয়ে উঠেছে। সে মোটরবাইক আর ক্যামেরা ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারত না। পত্রিকার পাতায় আজ তার ছবি ছাপা হয়নি এটা ও ভাবতেই পারতো না। ফলে পরিবারের ব্যবসা টাকা পয়সা তাকে আর টানতে পারে নি। আমি ওর পরিবারের কথা ওকে বলেছিলাম। এবং ওকে ওর পছন্দের ডিপার্টমেন্টে কাজের সুযোগ দেয়া হবে তাও বলেছিলাম। শওকতের আর ঘরে ফেরা হয় নি। হয়তো পরিবারের সম্পর্ক সব ঠিকই ছিল। কিন্তু ছবি তোলার ক্ষেত্রে সে অনড়।

দৈনিক সংবাদ দিয়ে ওর প্রেস লাইনের শুরু। এ ক্ষেত্রে আমাদের উর্মি দি মানে উর্মি রহমানের অবদানের কথা বলতেই হয়। উনিই সংবাদ অফিসের সাথে শওকতকে ফটোগ্রাফার হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন। তারপর বন্ধু শওকাত জামিল ক্রমশঃ একজন ডেডিকেটেড প্রেস ফটোগ্রাফার হিসেবে নিজেকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়। অনেক বছর আগে আমরা CMES Centre for mass education in science এর তরফ থেকে শাহবাগের পাবলিক লাইব্রেরিতে আলফ্রেড নোবেল এর জীবন পরিচয় এবং নোবেল পুরস্কার নিয়ে যে প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিলাম। শওকাতও সেখানে একটি বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল। এরকম একটি প্রদর্শনী ওকে অনুপ্রাণিত করেছে তা আমাকে বেশ কয়েকবার বলেছে। এবং তাকে প্রেস ফটোগ্রাফিতে খ্যাতির শীর্ষ স্পর্শ করতে হবে।

সে যখন এ কাজে যুক্ত হয় তখন দেশে রাজনীতির টালমাটাল অবস্থা। ফলে আন্দোলন মারামারি টিয়ার গ্যাস রাস্তার নৈমত্তিক ব্যাপার। শওকতও এমন ছবি চায়। ব্যাস শুরু হয়ে গেল তার আহত হবার পালা।পুলিশের লাঠিপেটা দৌড়ে পালান। কিন্তু আমাদের নিবেদিত বন্ধু কোন বাঁধা মানবে না। হরতালে ফাঁকা রাস্তায় কাকের মিটিংএর ছবি আমাদের চমকে দিয়েছিল। এর ওর মার খেয়েছে কয়েকবার ঝুঁকি নিয়ে হরতাল মারামারির ছবি তুলতে গিয়ে। আমাদের বন্ধু ওয়াকারের সাথেও শওকতের জমে ওঠে। ওয়াকার রশিকতা করে বলতো নাম তো শও কাত দেখিস বেশী কাত হইস না।

কোর্টে নেত্রী শেখ হাসিনার মুক্তির আদেশের দিন ছবি তুলতে গিয়ে ওভারপাসের উপর থেকে পড়ে গিয়ে মাজার হাড্ডি ফেটে যায়। শওকতকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এখবর শুনে আমরা ছুটে যাই ওকে দেখতে। ও আমাদেরকে বুঝাচ্ছিল এঙ্গেল ঠিক মত পাচ্ছিল না।ওটা ঠিক করতে গিয়েই পড়ে যায়। এবার ভাবুন। আমরা সব সময়ই কোন হরতাল মারামারি হলে কাগজে শওকতের নাম খুঁজতাম ও মার খেয়েছে কী না?

পরিশেষে শওকত The daily star এ ফটোগ্রাফার হিসেবে কাজ করছিল। এর মধ্যেই একবার মোটরবাইকেও এক্সিডেন্ট করে।

কয়েক বছর আগে হঠাৎ একদিন দুপুরে টিভির স্ক্রলে দেখলাম এলিফেন্ট রোডে একটা দোকানে অগ্নিকাণ্ডের ছবি তুলতে গিয়ে শওকত অসুস্থ হয়ে পড়ে মৃত্যুবরণ করেছে। আমি স্তম্ভিত। যেন আকাশ থেকে পড়লাম। শওকতের এমনটা পরিনতি হবে আমরা ধারনা করেই ছিলাম। কারন ছবি তুলতে ও যে ঝুঁকি নিত ভাবা যায় না।
খবর দেখে দ্রুত বের হয়ে গেলাম The daily star এ গিয়ে জানাযায় দাড়িয়ে ওকে শেষবারের মত বিদায় জানালাম। শুনলাম ওর লাশ বরিশালে নিয়ে যাওয়া হবে।

এটুকুই, এর পর আর কিছু জানিনা। শওকতের মতো উৎসর্গকৃত আলোকচিত্রী আর দ্বিতীয়তটি দেখবো বলে মনে হয় না। স্কুল জীবন থেকে কত স্মৃতি ওর সাথে।

শওকত সেতার বাজাতো। টুনটান সে শব্দের মতোই আমার হৃদয়েও ও বেজে চলেছে। বাজবে তা চিরদিন।জীবনের সব সুযোগ তাচ্ছিল্য ভরে প্রত্যাখ্যান করেছে শুধুমাত্র একটি ভাল ফটো নিউজের জন্য। শওকতের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।

শওকতের ছেলে সাভারে এনাম মেডিকেল কলেজের ছাত্র। ভাবী আর ওর মঙ্গল কামনা করছি। শওকাত জামিল আমাদের প্রেস ফটোগ্রাফির গর্ব।