সব গল্পেরই দার্শনিক ব্যাখ্যা সম্ভব!

প্রকাশিত: ৫:১৪ পূর্বাহ্ণ, অক্টোবর ৮, ২০২৪

সব গল্পেরই দার্শনিক ব্যাখ্যা সম্ভব!

কাজী মাহমুদুল হক |

যৌনতা মানেই অশ্লীলতা, যৌনতা মানেই ট্যাবু। প্রশ্ন হতে পারে অশ্লীলতার সংজ্ঞা কী? এটা মাপার কোন বৈশ্বিক মানদণ্ড আছে? আরেকটি সম্পুরক প্রশ্ন আসে – ট্যাবুর উৎপত্তি কিভাবে হয়?

আলোচনার খাতিরে শুধুমাত্র আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশ, মধ্য এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্যকে বিবেচনায় ধরলেও যৌনতা এবং ট্যাবু সমার্থক আজকের যুগেও।
এই ট্যাবু মাওলানার সময়েও বিদ্যমান ছিল এটুকু চোখ বুঝেই অনুমান করা যায়। এবং তার পরবর্তী যুগেও পরিবেশের বিশেষ তারতম্য হয় নাই। এই উপসংহার টানা যায় বইটির আলোচ্য অধ্যায় থেকেই। যেখানে লেখক একগাদা প্রাচীন মসনবী অনুবাদক/ব্যাখ্যাকারের নাম লিপিবদ্ধ করেছেন যারা সযতনে মসনবীর কিছু কিছু অংশ অনুবাদ করা থেকে বিরত থেকেছে!

রুমি ব্যাখ্যাতা হিসাবে নিকলসন, এনিমেরি পাশ্চাত্যের পরিচিত নাম। সেইসূত্রে আমার কাছেও পরিচিত। জাওয়িদ মোজাদ্দেদি আমার অপরিচিত (আমার রুমি পড়ার দৌড় অ আ ক খ পর্যন্ত…)। নিকলসন পড়েছি, সিমেল পড়িনি আর জাওয়িদের নাম নতুন জানলাম।
পুলিন বকসীর বরাতে জানা গেল, সিমেল মসনবীর এই অংশকে এক ধরণের ফ্যাণ্টাসিময় আলাপ বলেছেন। ফ্যাণ্টাসি শব্দটা কোন অর্থে এসেছে এত সংক্ষিপ্ত কোট থেকে সেটা বুঝা আমার পক্ষে সম্ভব হল না। বিরাট কোন উপন্যাসের গল্প যখন ঝুলে পড়ে, আর এগোতে চায় না তখন অনেক লেখক কিছু সুড়সুড়ি আমদানী করেন পাঠকের মনযোগ ধরে রাখতে। এইরকম কিছু বুঝাতে চেয়েছেন সিমেল? আমি নিশ্চিত না। আবার নিকলসন এই অংশটুকুর অনুবাদ ল্যাটিনে করেছেন। এর একটা ব্যাখ্যা আমার মতে, পাশ্চাত্য রোমান ক্যাথলিক চার্চের সরকারী ভাষা ল্যাটিন। একই সঙ্গে খৃষ্টিয় অতীন্দ্রিয়বাদের চর্চার সূতিকাগারও এই গোষ্ঠিই। কাজেই  মসনবীর এইসব আপাত অশ্লীল গল্পের গুঢ় তাৎপর্য বুঝতে এবং তার রস আস্বাদন করতে সক্ষম ল্যাটিন জানা চার্চ সংশ্লিষ্ট মানুষরাই। তাই নিকলসন এই অংশটুকু হরেদরে সবার জন্য উন্মুক্ত করতে চান নাই। কাজেই এখানে নিকলসনের সস্তা জনপ্রিয়তা পাবার বাসনা বা ভিক্টোরিয়ান এস্কেপিজমের গন্ধ আমার নাকে কমই আসল।
মূল প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে একটা প্রশ্ন রাখছি, স্ট্রাকচারালিজম, পোস্টস্ট্রকচারালিজম শব্দ দুটি সম্পর্কে ধারণা আছে? জাওয়িদের মন্তব্য হতে পারে স্ট্রাকচারালিস্ট দৃষ্টিকোন থেকে আর সিমেলেরটা পোস্টট্রাকচারালিস্ট দৃস্টিকোন। প্রফেসর ব্রাডগুচ যে প্রসঙ্গ এনেছেন তার সাথে  রুমির গল্প কতটুকু প্রাসঙ্গিক তা বলতে পারছি না। তবে হ্যাঁ, এটাকে ফুকোঁ ক্ষমতা শব্দটির যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন এবং ক্ষমতা কিভাবে সৃষ্টি হয় তার উদাহরণ হিসাবে দেখা যেতে পারে। তবে আমার কাছে এরচে সহজ ব্যাখ্যা আছে।প্রকৃতি-পুরুষ তত্ত্বে এর সহজ ব্যাখা সম্ভব। প্রকৃতিকে উপেক্ষা করে তার শক্তি ব্যাতিরেকে কোন অতীন্দ্রিয় জ্ঞান অর্জনই সম্ভব না। তাই পুরুষকে ফিরেই যেতে প্রকৃতির কোলে অথবা প্রকৃতির অভাবহেতু পরমকে খুঁজে পাবার ব্যর্থ প্রয়াস চালাতে হয় ডামি প্রকৃতিকে আশ্রয় করে। আরো সরল মারফতী ব্যাখ্যা হলো আমাদের বহুল কথিত শয়তানের ওয়াসওয়া/ইবলিসের ধোঁকা। মানে হল, এই এভারেস্ট চুড়ায় উঠার রুটের খাঁজে খাঁজে বন্ধুরূপী ক্যামোফ্লাজ শত্রুর অবস্থান 😄🙏
এইবার মূল প্রসঙ্গে আসি। তার আগে একটা অতিপরিচিত কোটেশন দিয়া শুরু করি- অথার ইজ ডেড। এই অমোঘ সত্য স্বীকার করেই যাত্রা শুরু করলাম। রুমি যা লিখে গেছেন তা সহস্র সহস্র পাঠক পড়ে তার থেকে হাজার রকমের উপসংহার দাড়া করাইছেন। এইটাই টেক্সটের ক্ষমতা। লেখক সেখানে গৌণ। পাঠকের হাত ধরেই তৈরি হয় প্রতিটি গল্পের মানে। কিভাবে হয় সেই আলোচনায় আর গেলাম না আপাতত।

রুমির গল্পের ময়নাতদন্তে পাশ্চাত্য তাফসিরকারগণ রুমির সময়ের সমাজ, ভাবনা, রুমির আর্থিক অবস্থান ইত্যকার সাথে মাওলানার ইন্টারেকসনকে নিশ্চয়ই ধর্তব্যে এনেছেন। নাহলে ঐ সময়ের একজন মানুষের মননের মিথস্ক্রিয়া বুঝে উঠা সম্ভব না। আর প্রাগ্রসর মানুষ যারা একেকজন একেককটা প্রতিষ্ঠানে পরিনত হন তাঁদের বুঝতে আসলে কোন স্ট্রাকচার ফাকচারই কামে লাগে না। তাই যুগে যুগে তাঁরা প্রাসঙ্গিক থেকে যান।
পুলিন বকসী খুব ধৈর্য ধরে রুমির অশ্লীল(!) গল্পগুলিকে সমকালীন মননরেখায় আঁকতে চেয়েছেন। কখনো লাকাঁর পথে কখনো ফ্রয়েডের পথে। বিষয়টা ভাল লাগছে। সব গল্পেরই দার্শনিক ব্যাখ্যা সম্ভব এমনকি একটা সামান্য কৌতুকেরও যেহেতু ‘অথার ইজ ডেড’ এবং “সব কিছুই টেক্সস্ট এর অন্তর্ভুক্ত”।

মালকিন-দাসী-গাধার গল্পটা আমার কাছে পিওর মিস্টিক্যাল জার্নিই মনে হইছে। খুব ছোট্ট করে বললে বলা যায়, একজন সাধককে (সালিক) তার পথ সম্পর্কে ওয়াকেবহাল হতে হয়। এটা দেখে দেখে শেখার বিষয় না। এর জন্য দরকার গুরুর। মালকিন যদি দাসীকে গুরু হিসাবে মেনে নিত তাহলে সে হয়ত মোক্ষধামের দেখা পেতো। বিশেষ করে দাসীর মুখের বয়ানটা  এখানে প্রাসঙ্গিক। গুরু এভাবেই শিষ্যকে পথ দেখান। আরেকটা ব্যাখ্যা এমন হতেপারে,(এটা একদমই আমার নিজস্ব অনুধাবন, মাফ করবেন)- সুফি ধারার দুটি পথ আছে। শরা আর বেশরা সুফি পথ। বেশরা সুফিদের সব কর্ম সাদা চোখে বুঝার চেষ্টা করা বৃথা। তাকে অনুকরণ করাতো প্রানঘাতী মহাভুল।

দ্বিতীয় গল্পের বিষয়বস্তু অবশ্যই সুফিদের সর্বোত্তম সম্পদ দারিদ্রতা বিষয়ক। নফসের কবলে পড়ে কত সহজেই একজন তার সর্বোত্তম সম্পদকে সস্তায় বিক্রি করে দিতে পারে তার উদাহরণ। কোরআনে “সামানান কালিলা” শব্দটা আছে না? নফসের খপ্পরে পড়ে কী অর্থহীন তেজারতি!

আর তৃতীয় গল্পটি (সুফি-দাসী-স্ত্রী) চির পরিচিত ত্রিভূজ প্রেমের গল্প! (মাফ করবেন🙏)। প্রকৃতি-পুরুষের সহজাত আকর্ষন এতটাই যে একজন সর্বোচ্চ স্তরের সাধককেও যেকোন মুহূর্তে পথচ্যুত করে দিতে পারে। এইতো…. ।

প্রথম গল্পের লাকাঁ, ফ্রয়েডিয় ব্যাখার পাশাপাশি লেখক কিঞ্চিৎ লালনের পথে হেঁটেছিলেন।একটু আশাবাদী হইছিলাম। হঠাৎ থেমে গেলেন কেন বুঝলাম না। আরেকটু ডিটেইল আশা করছিলাম। দেহবাদী লালন যখন গেয়ে উঠেন- আমি আর সে অচীন একজন, এক জায়গাতে থাকি দুজন। ফাঁকে থাকি লক্ষ যোজন।…

এই ব্যাখ্যাটা পুলিন যেভাবে বা যে প্রসঙ্গে এনেছেন তা আরেকটু ডিটেইল করা দরকার ছিল। দেহবাদী ঘরাণা (বা সহজিয়া ঘরাণা) মনেকরেন – যা আছে ভাণ্ডে, তাই আছে ব্রহ্মাণ্ডে। ভাণ্ডটা হইল এই দেহ আর ব্রহ্মাণ্ডতো জানেনই। সহজ কথায় খোদার সৃষ্টি এই বিশাল দুনিয়ার ক্ষুদ্র সংস্করণ হল এই দেহ। খোদা যেমন এই ব্রহ্মাণ্ডে বিদ্যমান তদ্রুপ তিনি এই ক্ষুদ্র ভাণ্ডেও আসীন হন। দেহবাদীগণ সেই অচিনের সাক্ষাৎ পেতে মরিয়া হয়ে চেষ্টা করেন। এই প্রকাণ্ড ব্রহ্মাণ্ডের বিশালতার মাঝে তাঁকে খুঁজে বেড়ানোর চেয়ে তুলনায় কোটি কোটি গুন ক্ষুদ্র এই দেহাভ্যন্তরে তাঁকে খোঁজার চেষ্টা করাটা স্বাভাবিক নয় কী? দেহবাদীরা সেই সহজ পথেই হাঁটেন। কিন্তু এই অচীন মানুষের সাথে  কখন, কিভাবে দেখা হতে পারে তার বিস্তৃত বর্ননা লালনের গানে গানে ছড়িয়ে আছে।তাই একজন দেহবাদীর কাছে সম্ভোগ শুধু রতিখেলার নাম নয়, এটা “মনের মানুষ”কে তাঁর “বারাম খানায়” দেখা পাবার পন্থা। সেটাই একজন লালনের চরম চাওয়া ও পরম পাওয়া।
লালনীয় ব্যাখ্যায় রুমির গল্পের মালকিন-দাসী ফারাকটা ঠিক এই জায়গায। দুটি সম্ভোগের উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ বিপ্রতীপ।

ফাতেমা মার্নিসি প্রসঙ্গ এসেছে অধ্যায়টিতে।অথারেটেরিয়ান ইসলামকে চ্যালেঞ্জ করা তাঁর পথ। মার্নিসি,গাজালি.. ইত্যকার নাম বাদ দিয়েও বলা যায়, নারী শব্দটাই জগতজোড়া একটা ট্যাবু। যে যে যার যার মতো করে এই ট্যাবু ব্যবহার করেন। কখনো ধর্ম, কখনো জাগতিক বিষয়ে।

আমার মনেহয় নারী কেন ট্যাবু এই আলাপ থেকে বেশি জরুরী ট্যাবু কেন ও কিভাবে সৃষ্টি হয়। আমি আলাপের পয়লাই এই প্রশ্নটার ইংগিত দিয়ে রাখছিলাম।

ধর্মে নারীকে ট্যাবু করার ব্যাখ্যায় পুলিন চাইলে ফুঁকোর জ্ঞান-ক্ষমতার সম্পর্ক এবং কিভাবে ক্ষমতা জ্ঞানকে সৃষ্টি করে, সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করে এই পথে আলাপটা বাড়াতে পারতেন। তাতে সামগ্রিক আলোচনা আরো কৌতুহলপ্রদ হতো পাঠকের কাছে।
বহুল পঠিন মসনবীর প্রায় অপঠিত অংশ নিয়ে মনোজ্ঞ আলোচনা করার সাহস দেখাবার জন্য লেখক সাধুবাদ পেতেই পারেন।

— কাজী মাহমুদুল হক

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ