বিশ্ব খাদ্য দিবস আজ

প্রকাশিত: ১:১৯ পূর্বাহ্ণ, অক্টোবর ১৬, ২০২৪

বিশ্ব খাদ্য দিবস আজ

নিজস্ব প্রতিবেদক | ঢাকা, ১৬ অক্টোবর ২০২৪ : খাদ্যশস্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পর উৎপাদন বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকলেও চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে দ্রব্যমূল্যের এই ঊর্ধ্বগতিতে চাল, সয়াবিন তেল, পেঁয়াজ, লবণ ও ডিমসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে অনেকেরই নাভিশ্বাস অবস্থা।

১৬ অক্টোবর বিশ্ব খাদ্য দিবস। কৃষি মন্ত্রণালয় ও জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) যৌথ উদ্যোগে বিশ্বের অন্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত হয়েছে দিবসটি। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘উন্নত জীবন ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের জন্য খাদ্যের অধিকার’।

বিশ্বব্যাপী এ প্রতিপাদ্যকে সামনে নিয়ে পালন করা হচ্ছে বিশ্ব খাদ্য দিবস। এ উপলক্ষে দেশে আন্তর্জাতিক সেমিনার ও জনসচেতনতা বৃদ্ধি কার্যক্রমসহ কৃষি মন্ত্রণালয় নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।

দিবসটি উপলক্ষে বুধবার সকালে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল মিলনায়তনে বিশ্ব খাদ্য দিবস ২০২৪ উদযাপিত হয়েছে।

কৃষি উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (অব.) অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। খাদ্য সচিব মাসুদুল হাসান এবং বিশ্ব খাদ্য সংস্থার বাংলাদেশ প্রতিনিধি Dr. Jiaoqun Shi বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেছেন কৃষি সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান।

এদিকে, দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে অবহিতকরণের জন্য মোবাইলে সচেতনতামূলক খুদেবার্তা পাঠানো, জাতীয় দৈনিকে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ, বিশ্ব খাদ্য দিবস ২০২৪-এর প্রতিপাদ্য তাৎপর্য পোস্টার/বিলবোর্ড/ভিডিও/মেসেজ/ডকুমেন্টেশনে প্রচার করা হয়েছে।

সরকার দেশের কৃষির উন্নয়নে ধারাবাহিকভাবে নানাবিধ যুগোপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ ও তা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। কৃষি গবেষণা-সম্প্রসারণকে কার্যকর সংযোগ স্থাপন, ন্যায্যমূল্যে কৃষি উপকরণ কৃষকের নিকট সহজলভ্য করা এবং কৃষি গবেষণায় বিনিয়োগ বাড়ানোই ফসলের নতুন নতুন জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়। ফলে কৃষি ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন হয়। আধুনিক, লাভজনক ও যান্ত্রিক কৃষি ব্যবস্থার প্রবর্তন হয়।

বিশ্ব খাদ্য দিবস প্রতি বছর ১৬ অক্টোবর বিশ্বব্যাপী পালিত হয়। ১৯৪৫ সালে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা প্রতিষ্ঠার স্মরণে এই দিনটি পালিত হয়। খাদ্য নিরাপত্তা ও দারিদ্র্য বিমোচনে কাজ করা বিভিন্ন সংস্থা, যেমন জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়ন তহবিল, এই দিনটি ব্যাপকভাবে উদযাপন করে। ২০২০ সালে খাদ্য সংকট মোকাবেলা, সংঘাতপূর্ণ এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখা এবং যুদ্ধ ও সংঘাতের অস্ত্র হিসেবে খাদ্যের ব্যবহার বন্ধ করতে নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করার জন্য বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচিকে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।
বিশ্ব খাদ্য দিবসের ২০১৪ সালের প্রতিপাদ্য ছিল পারিবারিক কৃষি: ‘বিশ্বকে খাওয়ানো, পৃথিবীর যত্ন নেওয়া’, ২০১৫ সালে ছিল ‘সামাজিক সুরক্ষা ও কৃষি: গ্রামীণ দারিদ্র্যের চক্র ভাঙা’, ২০১৬ সালে ছিল জলবায়ু পরিবর্তন: ‘জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে। খাদ্য ও কৃষিরও পরিবর্তন হতে হবে। যা ২০০৮ সালের প্রতিপাদ্য এবং তার আগে ২০০২ ও ১৯৮৯ সালের প্রতিপাদ্যর প্রতিধ্বনি বহন করে। ২০২০ সালের প্রতিপাদ্য ছিল ‘সমৃদ্ধ হও, পুষ্টি দাও, টেকসই করো। একসাথে। আমাদের কর্মই আমাদের ভবিষ্যৎ।’

জানা গেছে খাদ্যে শিল্পোৎপাদিত ট্রান্সফ্যাট হৃদরোগ ঝুঁকি বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। ট্রান্সফ্যাট গ্রহণের কারণে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ২ লক্ষ ৫০ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করে। আশংকার কথা হলো ট্রান্সফ্যাটঘটিত হৃদরোগে মৃত্যুর সর্বাধিক ঝুঁকিপূর্ণ ১৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম বলে জানিয়েছে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা।
সম্প্রতি এক গবেষণায় ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ ইন্সটিটিউট ঢাকার পিএইচও নমুনার ৯২ শতাংশে ডব্লিউএইচও সুপারিশকৃত ২% মাত্রার চেয়ে বেশি ট্রান্স ফ্যাট (ট্রান্স ফ্যাটি এসিড) পেয়েছে। প্রতি ১০০ গ্রাম পিএইচও নমুনায় সর্বোচ্চ ২০.৯ গ্রাম পর্যন্ত ট্রান্স ফ্যাট এর উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে, যা ডব্লিউএইচও’র সুপারিশকৃত মাত্রার তুলনায় ১০ গুণেরও বেশি।
ট্রান্সফ্যাটের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত কোনো আইন বা নীতি হয়নি। তবে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ (বিএফএসএ) অতিসম্প্রতি সকল ফ্যাট, তেল এবং খাদ্যে ট্রান্সফ্যাটের সর্বোচ্চ সীমা মোট ফ্যাটের ২ শতাংশ নির্ধারণ করে নীতি প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

বিশ্ব খাদ্য দিবস উপলক্ষে এক প্রতিক্রিয়ায় গবেষণা ও অ্যাডভোকেসি প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞা’র (প্রগতির জন্য জ্ঞান) নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়ের বলেন, “বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে বাংলাদেশে হৃদরোগজনিত মৃত্যুর ৪.৪১ শতাংশের জন্য দায়ি ট্রান্সফ্যাট। খাদ্যে ট্রান্সফ্যাটের সীমা নির্ধারণ করার মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন বাঁচানো সম্ভব। তাই আমাদের দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় নীতি প্রণয়ন করতে হবে।”
ট্রান্সফ্যাটমুক্ত নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে অবিলম্বে ডব্লিউএইচও’র পরামর্শ অনুযায়ী সবধরনের ফ্যাট, তেল এবং খাদ্যদ্রব্যে ট্রান্সফ্যাটের সর্বোচ্চ সীমা মোট ফ্যাটের ২ শতাংশ নির্ধারণ করে আইন প্রণয়ন এবং কার্যকর করার দাবি জানায় প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান)।

বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নিম্নোক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য খাদ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে:

১। সরকারি ধান-চাল ক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রায় যে ঘাটতি হয়েছে তা পুরণে -ক. চালকল মালিকদের চুক্তিমত চাল দিতে বাধ্য করা, অন্যথায় জামানত বাজেয়াপ্ত জরিমানাসহ দন্ডাদেশ প্রদান।

২। মজুত বিরোধী আইন প্রয়োগে মজুত করা খাদ্য উদ্ধার ও মজুতকারিকে দন্ড প্রদান,

৩। চালের বাজারে সক্রিয় সিন্ডিকেট কঠোরহস্তে দমন,

৪। কৃষকদের ধানসহ কৃষি পণ্যের উৎসাহ মূল্য প্রদানের জন্য উৎপাদনের খরচ বিবেচনায় উপযুক্ত মূল্য ও ধান চাল ক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা বৃদ্ধি পূর্বে নির্ধারণ করা,

৫। গুদাম সংকট, ক্রয় কেন্দ্রের অপ্রতুলতা ও হয়রানি বন্ধের জন্য প্রতি উপজেলায় প্যাডি সাইলো নির্মাণ ও সমবায় ভিত্তিতে তার পরিচালনা,

৬। উৎপাদক কৃষকদের সমবায়ীতে অন্তর্ভুক্ত করে তাদের সাশ্রয়ী সুদে ঋণ দেয়া যাতে ধান উঠার সময় নিজেদের উদ্বৃত্ত নিজেরাই কিনে প্যাডি সাইলোসহ সুবিধাজনক স্থানে গুদামজাত করা ও অবস্থা বুঝে তা বিক্রি করে বাজার মূল্য স্থিতিশীল রাখতে পারে,

৭। বছরের ৫ মাস ১০ টাকা কেজি মূল্যে ৩০ কেজি চাল প্রদানের কর্মসূচী বছরব্যাপী বিস্তৃত করা,

৮। সারাদেশে রেশনিং ব্যবস্থা চালু করা।

করোনা অতিমারির ভয়াবহতা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, মূল্যস্ফীতি, জ্বালানি সংকটে বাংলাদেশসহ সমগ্র বিশ্ব দুঃসহ ক্রান্তিকাল অতিক্রম করেছে। বৈশ্বিক খাদ্য সংকটে বিশ্বের অনেক দেশ যারপরনাই পর্যুদস্ত হয়েছে। উৎপাদন পরিস্থিতি বিবেচনায় এবং চলমান সংকটের কারণে ২০২৪ সালে সারাবিশ্বে খাদ্য সংকট বা দুর্ভিক্ষ অত্যাসন্ন এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এবারই বিশ্ব সর্বোচ্চ খাদ্য সংকটের মুখোমুখি হওয়ার বিষয়ে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার ইঙ্গিত খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থাসহ সবাই একযোগে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের কারণে হতে যাওয়া এ ভয়াবহ খাদ্য সংকটের ফলে শুধু ইউক্রেন নয়; হাজার হাজার মাইল দূরবর্তী দেশগুলোর মানুষেরও মৃত্যুর আশঙ্কা প্রচার করে আসছে।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) সংশোধিত বার্ষিক পূর্বাভাস অনুযায়ী, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পাশাপাশি নানাবিধ কারণে বর্তমান বৈশ্বিক অর্থব্যবস্থা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। ফলে সংস্থাটি ২০২৩ সালে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য কমার ইঙ্গিত দিয়েছে। উপরন্তু জ্বালানি, খাদ্য ও সারের আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়া বিশ্বজুড়ে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার শঙ্কা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর ঋণ সংকট বাড়াচ্ছে। ফলে আগামী বছর বিশ্ব বাণিজ্য আরও সংকুচিত হবে বলে মন্তব্য করেছেন ডব্লিউটিওর মহাপরিচালক এনগোজি ওকোনজো-আইওয়ালা। গত ২৩ জানুয়ারি গণমাধ্যমে প্রকাশিত জাতিসংঘের ‘দ্য গ্লোবাল রিপোর্ট অন ফুড ক্রাইসিস’ শীর্ষক প্রতিবেদন মতে, ২০২২ সালে বিশ্বের ৫৮টি দেশের ২৫৮ মিলিয়ন মানুষ তীব্র খাদ্য সংকটের মুখোমুখি হয়েছিল, যা ২০২১ সালের চেয়ে ৬৫ মিলিয়ন বেশি। এ প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, গত বছর সোমালিয়া, আফগানিস্তান, বুরকিনা ফাসো, হাইতি, নাইজেরিয়া, দক্ষিণ সুদান ও ইয়েমেনের মানুষ সবচেয়ে বেশি অনাহার-মৃত্যুর সম্মুখীন হয়েছিল। এছাড়া খাদ্য সংকটে নিপতিত হতে হয়েছিল বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশকেও।

এতৎসত্ত্বেও আবহমান বাংলার আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও ঐতিহ্যের মূল চালিকাশক্তি কৃষি খাত দেশবাসীকে অত্যন্ত আশাবাদী করার প্রয়াস অব্যাহত রেখেছে। করোনার প্রকোপকালীন দেশের জিডিপিতে সর্বোচ্চ অবদান রাখা সেবা খাতসহ বিভিন্ন খাতের বিপর্যয়ের বিপরীতে একমাত্র কৃষি খাতই দেশের অর্থনীতিকে প্রাণবন্ত রাখতে সক্ষম হয়েছিল। এখনো কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলছে।

মোট দেশজ উৎপাদনের হিসাবে জিডিপিতে এখন কৃষি খাতের অবদান ১৩ শতাংশ এবং কর্মসংস্থানে ৪১ শতাংশ।

গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন-কর্মসংস্থান-দারিদ্র্যবিমোচন তথা স্বনির্ভরতা অর্জনে সুদূর প্রাচীনকাল থেকেই কৃষির ভূমিকা অনস্বীকার্য। কৃষিভিত্তিক বাংলাদেশের মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পুরোটা জুড়েই ছিল কৃষি।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ