বাঙালিরা জল খাবে, এতে অন্যায় কী আছে?

প্রকাশিত: ৯:২৯ পূর্বাহ্ণ, অক্টোবর ২০, ২০২৪

বাঙালিরা জল খাবে, এতে অন্যায় কী আছে?

রুমি নন্দী |

খাই খাই

অবাঙালি বন্ধুরা মজা করে বলেন, “তোমাদের বাঙলা ভাষা খুব মজার”।
“কেন”?
“তোমরা বল জল খাচ্ছি। আরে, জল কী খাওয়া যায়”?
ঠিকই। আমরা বাঙালিরা ‘জল খাই’। শুধু খাই না, আমরা কেউ কেউ ডুবে ডুবে জল খাই। আর, শুধু জল কেন, বাঙালি দুধ খায়, চা খায়, কফি খায়, শরবত খায়। হ্যাঁ, হ্যাঁ, যেটা ভাবছেন, সেই শরাবও খায়।
কেবল তরল পদার্থ? বাঙালি সিগারেট খায়, বিড়ি খায়, চুরুট খায়। দুর্বল পেটরোগা মানুষ, কোন কিছু খেলে হজম হয় না, সেও কিন্তু ‘গ্যাস খায়’। খাওয়ার কি শেষ আছে? কর্তাব্যক্তিরা সুযোগ পেলে অধস্তনের ‘চাকরি খায়’। বিপদে পড়ে ‘খাবি খায়’।
সর্বভূক বলা যাবে কিনা জানিনা, তবে বাঙালি নিশ্চিতভাবেই বহুভূক, বিচিত্র ভূক। বাঙালির দৈনন্দিন জীবনে খাওয়া-খাওয়ির বিচিত্র ফিরিস্তি। জানেন কি, বাঙালির গাড়ি পেট্রল খায়? বিশ্বাস না হলে ড্রাইভারদের জিজ্ঞেস করুন। তাঁরা বলে দেবেন কোন মডেল তেল বেশি খায়। আকাশে ঘুঁড়ি ‘গোঁৎ খায়’, মাটিতে লাট্টু বনবন করে ‘পাক খায়’।
আর খাবে নাই বা কেন? আর কোন্ ভাষায় কোন্ কবি খাওয়া নিয়ে সাড়ম্বরে কবিতা লিখেছেন?
“খাই খাই কর কেন, এস বস আহারে,
খাওয়াব আজব খাওয়া, ভোজ কয় যাহারে”।
যাঁরা বিশ্বসাহিত্যের ভুরিভোজের খোঁজ খবর রাখেন, তাঁরা বলতে পারবেন, এরকম ‘খাই খাই’ কবিতা অন্য কোনো ভাষায় আছে কিনা।
বাঙলার শ্রেষ্ঠ কবি তো কবিতা জীবন শুরু করেছিলেন খাওয়া দিয়ে।
আমসত্ত্ব দুধে ফেলি তাহাতে কদলী দলি,
সন্দেশ মাখিয়া দিয়া তাতে,
হাপুস হুপুস শব্দ চারিদিক নিস্তব্ধ
পিঁপিড়া কাঁদিয়া যায় পাতে।
সুতরাং এই বাঙালি পরের মুখে ‘ঝাল খাবে’, মাস্টারের কাছে ‘কানমলা খাবে’, বন্ধুদের কাছে ‘প্যাঁক খাবে’, ভয়ে ‘থতমত খাবে’, এতে আর আশ্চর্য কি?
একটু পিছিয়ে যান। অষ্টাদশ শতাব্দীর কবি রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রের কাব্য অন্নদামঙ্গলে ঈশ্বরী পাটনি বর চাইলেন। কী বর? “আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে।” বর চাওয়ার সময়েও খাওয়ার চিন্তা! তাহলে? এই বাঙালি ভুল করলে ‘বকা খাবে’ না, আর ভালোবেসে ‘চুমু খাবে’ না? ছেঁড়া চটি পরে ‘হোঁচট খাবে’ না?
আরো একটু পিছিয়ে যান। ষোড়শ শতাব্দীতে কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর “চণ্ডীমঙ্গল “কাব্যে দেখুন বাঙালির দৈনন্দিন আমিষ নিরামিষ খাওয়ার ফিরিস্তি! কয়েকটা উদাহরণ চেখে দেখুন, -নিমশিমের শুক্তো, কাঁঠালবিচি দিয়ে নটেশাকের তরকারি, ঘি আর জিরে দিয়ে পালংশাক, কুমড়ো বড়ি আলু দিয়ে রুই মাছের ঝোল। এরপরেও বাঙালি যদি আয়েস করে পায়েস খায় আর মাঠে গিয়ে ‘হাওয়া খায়’, কাজ করতে ‘হিমশিম খায়’, আর পা পিছলে ‘আছাড় খায়’, এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু আছে?
বাংলাতেই জন্মেছেন শ্রেষ্ঠ ভোজনরসিক কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, যাঁর রসবোধ আর রসনা দুটোই খুব সরস ছিল। তাঁর একটি কবিতার শিরোনাম ‘হেমন্তে বিবিধ খাদ্য’। সরস পদ্য রচনা করেছেন বিভিন্ন খাদ্য নিয়ে। আম, আনারস, তপসে মাছ -কী নেই তালিকায়! তোপসে মাছ এর দুটি লাইন,
কুড়ি দরে কিনে নেই দেখে তাজা তাজা,
টপাটপ খেয়ে ফেলি ছাঁকা তেলে ভাজা।
কবিতাগুলো পড়লে পেটরোগা দুর্বল লোক ‘ভির্মি খাবে’। পেটুক বাঙালি অবসরে ‘দোল খায়’, বৌ-এর কাছে ‘মুখ খায়’, জুতো, গুঁতো সবই খায়।
ভক্তিরসের গানের জন্য যিনি অধিক পরিচিত, সেই কান্তকবি রজনীকান্ত সেন লিখে ফেললেন,
“যদি কুমড়োর মতো চালে ধরে র’ত,
পান্তোয়া শত শত,
আর সরষের মত হত মিহিদানা,
বুঁদিয়া বুটের মতো”
ভেবে দেখুন, যে ভাষায় কাব্যরসের সঙ্গে রসনার এত রসালো মাখামাখি, সে ভাষায় যদি কেউ ‘তাড়া খায়’, ‘মার খায়’, ‘ঘুঁষি খায়’ কিংবা ‘আদর খায়’, সে খাওয়া কি খুব অস্বাভাবিক?
প্রকৃতিপ্রেমিক বিভূতিভূষণের দু’টি ছোট গল্পের শিরোনাম খেয়াল করুন- বাটিচচ্চরি আর হিঙের কচুরি। একই লেখকের দু দু’টি গল্পের শিরোনামে খাওয়ার আইটেম! সংসারত্যাগী সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ নির্দ্বিধায় বলেছিলেন, “যে ভালো রাঁধতে পারে না, সে ভালো সাধু হতে পারে না। মন শুদ্ধ না হলে ভালো সুস্বাদু রান্না হয় না”। বাংলা ভাষায় তাই ভাবের প্রকাশে খাওয়ার কোনো অভাব নেই। খাপে খাপে ‘খাপ খাওয়া’, তেলে জলে ‘মিশ খাওয়া’, ‘মাল খেয়ে’ ‘টাল খাওয়া’, বোকা বনে ‘ধোঁকা খাওয়া, খাওয়া নিয়ে একেবারে ‘ঘোল খাওয়া’র ব্যবস্থা!
অনেক দিন আগে এক বিদেশিনী মহিলার একটা লেখা পড়েছিলাম। তিনি মানুষের খাদ্যাভ্যাস নিয়ে বই লেখার জন্যে বিভিন্ন দেশে ঘুরেছিলেন। আমাদের দেশেও বিভিন্ন শহরে ঘুরে ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করার সময়ে কলকাতায় এসেছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে তাঁর দেখা কলকাতাই একমাত্র শহর, যেখানে লোকেরা ব্রেকফাস্ট খাওয়ার সময়ে লাঞ্চের কথা ভাবে, আর লাঞ্চ খেতে খেতে চিন্তা করে ডিনারে কী খাবে। তাই তো বাঙালি ‘দুধও খায়’, আবার ‘তামাকও খায়’। কেউ কেউ চুপিচুপি ‘টাকা খায়’, পকেটমার ধরা পড়ে ‘মার খায়’, কারা যেন ‘ঘুষ খায়’! ভীড়ের মধ্যে ‘ধাক্কা খায়’। ফুটবল মাঠে ‘গোল খায়’।
সুকুমার রায় ঐজন্য রায় দিয়ে দিয়েছেন,
এত খেয়ে তবু যদি নাহি ওঠে মনটা
খাও তবে কাঁচকলা, খাও তবে ঘন্টা।

তাহলে বলুন তো, বাঙালিরা ‘জল খাবে’, এতে অন্যায় কী আছে?

 

 

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ