সিলেট ১লা জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১৭ই আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ১০:২৩ পূর্বাহ্ণ, নভেম্বর ৩০, ২০২৪
১৯৭১ সালে এই অন্চলের একজন অন্যতম বিশ্বস্থ ব্যক্তিত্ব ছিলেন ‘রাজা সাহেব ‘। রাজা সাহেবকে আমি কখনও দেখি নাই, তবে তার সম্পর্কে আমার বড় মামা আমির আলী ও পরিবারের অন্যান্য সকলের কাছে ছোটবেলায় এত শুনেছি যার বদৌলতে শুনতে শুনতে তার প্রতিকৃতি ও অস্তিত্ব মনের মাঝে গেথে আছে এবং তার সেই পৃথিমপাশা নবাব বাড়ি সম্পর্কে এত বেশি ভাল কথা শুনেছি যা বলে বা লিখে শেষ করতে পারবো না; তারপরও একটু চেষ্টা করে দেখি,
কথায় আছে,
“বেটা থাকলে আলী আমজাদ
আর সব পুয়া
হাওড় থাকলে হাকালুকী
আর সব কুয়া!”
সিলেটের এই বিখ্যাত প্রবাদ দিয়েই এই পর্ব শুরু করছি,
পৃথিমপাশা নবাববাড়ী মৌলভীবাজার জেলা সদর থেকে ৪৭ কিলোমিটার পূর্বে ২৫ একর বিস্তৃত সাজানো-গোছানো জমিদার বাড়ির অবস্থান। পুরোনো কয়েকটি স্থাপনার সঙ্গে রয়েছে জমিদার নির্মিত শিয়া সম্প্রদায়ের একটি চমৎকার নকশা খচিত ইমামবাড়া।
প্রত্যেকটি স্থাপনাতেই আভিজাত্যের ছাপ সুস্পষ্ট।
পাশেই রয়েছে চমৎকার শান বাঁধানো ঘাটসহ সুবিশাল দীঘি।
পৃথিমপাশা জমিদার বাড়ি
যা পৃথিমপাশা নবাব বাড়ি নামেও পরিচিত, সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলায় জমিদারী আমলের স্মৃতি বিজড়িত এক ঐতিহাসিক এবং অপূর্ব স্থাপনার নাম পৃথিমপাশা জমিদার বাড়ি। পৃথিমপাশায় রয়েছে দু’টি জমিদার বাড়ি। এই জমিদার বাড়ির মতো জীবন্ত জমিদার বাড়ি বাংলাদেশে আর দ্বিতীয়টি নেই।
ইরানের রাজা রেজা শাহ পাহলভি এই বাড়ি সফরে আসেন। তখন তার সফরকে কেন্দ্র করে নিরাপত্তা দিতে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার প্রধান হুকুম জারি করলে আইয়ুব খানকে পাঠানো হয়।
পরবর্তীতে ১৯৫৮ সালে এই আইয়ুব খানই
মার্শাল ল’ জারি করে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হোন।
এই এলাকাটি এক সময় ছিল ত্রিপুরা রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। এখানকার পাহাড়ি এলাকায় নওগা কুকি উপজাতির বেশ প্রতাপ ছিল। শ্রীহট্ট সদরে যা বর্তমানে সিলেট, সেই সময় একজন কাজী ছিলেন যার নাম মোহাম্মদ আলী। ১৭৯২ সালে ইংরেজ শাসকদের পক্ষ হয়ে নওগা কুকিদের বিদ্রোহ দমনে মোহাম্মদ আলী গুরত্বপূর্ন ভূমিকা রাখেন।
ইংরেজ সরকার এতে খুশি হয়ে মোহাম্মদ আলীর পুত্র গাউস আলী খাঁনকে ১২০০ হাল বা ১৪,৪০০ বিঘা জমি দান করেন।
১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের সময় চট্টগ্রাম থেকে হাবিলদার রজব আলীর নেতৃত্বে একদল বিদ্রোহী সৈন্য সিলেট আসলে তার সমর্থন চান।
তিনি সরাসরি সাহায্য না করে তাদেরকে পাহাড়ী এলাকায় অবস্থান করার পরামর্শ দেন।
যুদ্ধ শেষে গাউস আলী খানকে বিদ্রোহে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার করে, তবে প্রমানের অভাবে ছেড়ে দেয়া হয়। উত্তরাধিকার সূত্রে এই জমিদারীর মালিক হন তার ছেলে আলী আহমদ খান।
আলী আহমদের সময়ে জমিদারীর আয় ব্যাপক বৃদ্ধি পায় এবং তিনি ব্রিটিশ আনুকুল্যও লাভ করেন। তার সময়ে চাদনীঘাট এবং সুরমা নদীর তীরে সিলেট শহরের গোড়াপত্তন হয়। ১৮৭২ সালে ছেলে আলী আমজাদ খানের নামে একটি ক্লক টাওয়ার স্থাপন করেন, যা এখন আলী আমজাদের ঘড়ি নামে বিখ্যাত। নবাব আলী আমজাদ খাঁন তখনকার সময়ে বৃহত্তর সিলেটের মধ্যে সবচেয়ে স্বনামধন্য এবং প্রভাবশালী জমিদার ছিলেন। সিলেটের বিখ্যাত সুরমা নদীর তীরে চাঁদনীঘাটের সিঁড়ি সমাজসেবায় তার একটি অন্যতম দৃষ্টান্ত।
ঐ সময় পৃত্থিমপাশা জমিদার বাড়িতে ত্রিপুরার মহারাজা রাধা কিশোর মানিক্য বাহাদুরসহ বহু ইংরেজ ভ্রমণ করে গেছেন। ইরানের রাজাও ভ্রমণ করে গেছেন। জমিদার বাড়ির ঐতিহ্য ধরে রাখতে আলী আমজাদ খাঁন মৌলভীবাজার ও কুলাউড়ায় বিভিন্ন স্কুল-কলেজ এবং সুপেয় পানির জন্য দীঘি খনন করেন।
উল্লেখ্য, সিলেটের সুপরিচিত রাজপরিবার তরফের অন্যতম শাখা, সিপাহসালার হযরত সৈয়দ নাসিরউদদিন (রঃ)-এর উত্তরসুরী নরপতি সাহেব বাড়ির অন্যতম জমিদার সৈয়দ আমিনউদ্দিন সাহেবের পুত্র।
সৈয়দ ময়েজ উদ্দিনের বোনের নাম সৈয়দা ফাতেমা বানু, এই সৈয়দা ফাতেমা বানুর বিয়ে হয় পৃথিমপাশার জমিদার নবাব আলী আমজাদ খানের সাথে এবং অপর বোন সৈয়দা রহিমা বানুর বিয়ে হয় কুলাউড়ার আর এক জমিদার বাড়ি জয়পাশা খন্দেগার বাড়ীতে। সৈয়দা ফাতেমা বানু যিনি ছিলেন নবাব আলী আমজাদ খানের প্রথম পত্নী। জনশ্রুতি রয়েছে তিনি অত্যান্ত রূপসী ও বিদুষী মহিলা ছিলেন।
নবী বংশীয় এবং রাজ পরিবারের ঐতিয্য থাকার কারনে পৃথিমপাশার জমিদার নবাব আলী আমজাদ খান নরপতির পশ্চিম হাবেলীতে এই পরিবারে সম্পর্ক স্হাপনে আগ্রহী হন। নবাব আলী আমজাদ খান বাংলার শ্রেষ্ট পরাক্রমশালী জমিদারদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একজন। বৃটিশ শাসনআমলে তার এষ্টেটের ম্যানেজার ছিল একজন বেতনভুক্ত ইংরেজ।পাহারাদার ছিল নেপালী, সবসময় বাড়িতে ১০০টি বন্দুক ছিল এবং বন্দুকধারী বাহিনীরা পাহারায় থাকত।তিনি যখন নরপতি পশ্চিম হাবেলীতে সুন্দরী কন্যা সৈয়দা ফাতেমা বানুর সাথে বিয়ের প্রস্তাব দেন তখন নরপতির সৈয়দরা সেই প্রস্তাবে প্রথমে রাজি হন নাই, যেহেতু নবাবেরা ছিলেন শিয়া সম্প্রদায়, পরবর্তীতে রাজি হন এবং মহাধুমধামে বিয়ে সম্পন্ন হয়।
ঐ বিয়েতে অতিথি হয়ে বরযাত্রীর বহরে ছিলেন বহু ইংরেজ, উপমহাদেশের বিভিন্ন গন্যমান্য পরিবারের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিবর্গ এবং ত্রিপুরা রাজ্যের মহারাজা “রাধা মানিক্য বাহাদুর“।
তখন চল্লিশটি হাতি নিয়ে বিরাট বরযাত্রী নরপতি এসে প্রায় একসপ্তাহ অপেক্ষা করে সৈয়দ সাহেবদেরকে রাজি করিয়ে সৈয়দা ফাতেমা বানুকে বিয়ে করে পৃথিমপাশা নিয়ে আসেন।
নবাব আলী আমজাদ ছিলেন এই বাংলার প্রথম মুসলিম টি প্ল্যান্টার বা চা বাগান মালিক। এই নবাব বাড়ীর প্রধান ফটকের সামনে দুই পাশ্বে দুইটি বাঘের খাঁচা ছিল।
সেখান থেকে জীবন্ত বাঘের তর্জন, গর্জন শোনা যেত ।
আলী আমজাদ খানের পুত্র নবাব আলী হায়দার খান ভারতবর্ষে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা ও রাজনীতিবিদ ছিলেন। পৃথিমপাশা নবাব পরিবারের আলী সরওয়ার খান আওয়ামী লীগের টিকেট পেয়ে প্রাদেশিক পরিষদের প্রতিনিধি নির্বাচিত হন। এই পরিবারের অন্যতম সদস্য ও ভাসানী ন্যাপের অন্যতম সিনিয়র নেতা নবাব আলি সফদর খান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম একজন বলিষ্ঠ সংগঠক ও স্থানীয় জনগনের অত্যন্ত আস্থাভাজন ও নির্ভরযোগ্য নেতা ছিলেন ।
তিনি ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করতে গুরুত্বপুর্ন ভুমিকা পালন করেন। তাকে হত্যা করার জন্য পাক বাহিনী বহুবার বিভিন্ন স্হানে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়।
আবার এই নবাব পরিবারের আর এক উচ্ছৃঙ্খল সদস্য পাকিস্তানপন্থী হানাদার বাহিনীর একজন যোগসাজশকারী হিসাবে সর্বত্র গন্য ছিলেন।
তারই আহবানে নবাব বাড়িতে হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প স্থাপিত হয়েছিল এবং পাক হানাদারদের দ্বারা বেশ কিছু মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়েছে।
এমনকি নবাব আলী সফদর খানের বসত বাড়ীতে একজন পাক আর্মি অফিসারের আস্তানা গড়ে উঠেছিল, তিনি তখন সপরিবারে ভারতে অবস্থান করছিলেন। তার স্ত্রী পুত্রদের ভারতের আগরতলায় আত্মীয়ের বাড়ীতে রেখে তিনি মুক্তিযাদ্ধা শিবিরে সংগঠক হিসাবে সকল মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করেন, তাদের খাবারের ব্যবস্থা করে দিতেন।
তিনি ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করতে গুরুত্বপুর্ন ভুমিকা পালন করেন। তাকে হত্যা করার জন্য পাক বাহিনী বহুবার বিভিন্ন স্হানে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। অন্যায়ের সাথে ‘রাজা সাহেব’ কখনই আপোষ করেন নাই।
তিনি সংগ্রাম করেছেন জমিদার পিতার বিরুদ্ধে, অত্যাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে সংগ্রামী এই জননেতা ১৯৭৪ সালের ১৬ ই জুলাই মৃত্যুবরণ করেন।
পৃত্থিমপাশা জমিদার পরিবারের পরবর্তী সন্তানগন ও সমাজসেবা ও জনহিতকর কাজে সম্পৃক্ত ছিলেন, রাজা সাহেবের ছেলে ‘নবাব আলী আব্বাস খান‘ বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ এবং তিনবারের সংসদ সদস্য ছিলেন, আপামর জনসাধারণের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে চলেছেন। তিনি এই নির্বাচনী এলাকায় অত্যন্ত জনপ্রিয় ও গ্রহনযোগ্য ব্যক্তিত্ব। ছোট ছেলে ‘নওয়াব আলী নকী খান’ এই ইউনিয়নের দীর্ঘদিন জনপ্রিয় চেয়ারম্যান ছিলেন এবং বর্তমানে বাড়িতেই অবস্থান করছেন।
সারাদেশের বিভিন্ন সম্ভ্রান্ত পরিবারের সাথে রয়েছে এই পরিবারের আত্বীয়তা এবং সুসম্পর্ক।
এই বাড়ির ভেতর সবকিছু পুরানো আমলের কারুকাজ খচিত মনে হলেও সেগুলো পরিষ্কার ঝকঝকেই আছে এখনো। জমিদারদের ব্যবহার করা অনেক জিনিসপত্র রয়েছে এ বাড়িতে। রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্য এখানে লোক রয়েছে। নবাব আলী আমজাদ খাঁর উত্তসুরিরাই বর্তমানে দেখাশুনা করেন জমিদার বাড়িটি এবং দেশে বিদেশে প্রচুর বংশধর ও আত্বীয় স্বজনেরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে অবস্থান করছেন, অগনিত বহু বড় বড় বিখ্যাত ব্যক্তির আগমন ঘটেছে এই বাড়িতে, সেই উছিলায় কুলাউড়াতে, বাংলার ইতিহাসের অগ্নিস্বাক্ষী এই নওয়াব বাড়ির কথা লিখে শেষ করার মত নয়।
বহু ইতিহাসবিদ, গবেষকগন নানাভাবে, নানা বইতে এই বাড়ি ও এই বাড়ির কীর্তিমানদের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন, এমনকি গুগল, উইকিপিডিয়াতেও ব্যাপক আকারে পৃথিমপাশা নবাব বাড়ির কথা উল্লেখ রয়েছে, বিভিন্ন মাধ্যম থেকে টুকিটাকি তথ্য সংগ্রহ করে এই পর্বটি তৈরী করেছি, উইকিপিডিয়া সহ সকলকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে এই পর্ব শেষ করছি।
ছবি সৌজন্যে: সৈয়দ মিসবাহউদ্দিন, সিলেট।
(চলবে)
সম্পাদক : সৈয়দ আমিরুজ্জামান
ইমেইল : rpnewsbd@gmail.com
মোবাইল +8801716599589
৩১/এফ, তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০।
© RP News 24.com 2013-2020
Design and developed by M-W-D