গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা ও ব্যবস্থা বদলের সংগ্রাম এগিয়ে নিন

প্রকাশিত: ১২:৩৩ পূর্বাহ্ণ, জানুয়ারি ৩, ২০২৫

গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা ও ব্যবস্থা বদলের সংগ্রাম এগিয়ে নিন

রুহিন হোসেন প্রিন্স |

মানুষের জীবনের দৈনন্দিন সংকট কাটছে না। প্রতিদিন যেন নতুন নতুন সংকট সামনে আসছে। সাধারণভাবে রাজনৈতিক সংকট বলতে মানুষের কাছে যা বোধগম্য হয়, তার কোনো সমাধানের পথরেখা সাধারণ মানুষের চোখে পড়ছে না। সমাজে নানা ধরনের অস্থিরতা বেড়েই চলছে।

আমরা অনেকদিন ধরেই বলে আসছিলাম পুরো সমাজব্যবস্থার একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন ছাড়া এই সংকটের সমাধান করা যাবে না। এ কাজটি করতে মানুষকে সচেতন ও সংগঠিত করার জন্য আমরা আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। বিভিন্ন সময়ে আমাদের সামনে যেসব সংকট দৃশ্যমান হচ্ছে, সেসব সংকট নিয়েই সমাজে প্রধানত আলাপ-আলোচনা, ঘুরপাক খেয়ে থাকে। এসময় আমরাও আশু সমস্যা, এর আশু সমাধান এসব নিয়েই কথাবার্তা বলে থাকি। এটাই স্বাভাবিক। পত্রপত্রিকা, টেলিভিশন, সভা সমাবেশ সর্বত্রই প্রধানত এসব সমস্যা নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত থাকে। এর মধ্য দিয়ে অনেকেই আশু সমস্যার সমাধানের মধ্যে স্থায়ী সমাধানের আকাঙ্ক্ষা পোষণ করেন। এসব সমস্যা এবং তার সমাধানে গভীর ভাবনা না থাকায় এবং সমস্যা সমাধানের প্রকৃত পথ সম্পর্কে মানুষের কাছে সার্বিক তত্ত্ব ও তথ্য না থাকায় মানুষ হতাশ হয়। এসব বিষয়ক হিসাবে রেখে আমরা আমাদের কার্যক্রমকে অগ্রসর করে চলেছি।

এবছর জুলাই আগস্টে সংঘটিত গণঅভ্যুত্থানের সাড়ে চার মাস অতিবাহিত হতে চললো। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তার দায়িত্ব পালন করে চলেছে। শুরুতে মানুষের মধ্যে যে আকাঙ্ক্ষা ছিল তা যেন দিন দিন ফিকে হতে চলেছে। যা কারোর কাক্সিক্ষত ছিল না।

আমাদের প্রধান উৎপাদক কৃষক খেতমজুর। সার কীটনাশক বীজ নিয়ে হঠাৎ অনেক মূল্যবৃদ্ধিসহ নানা ধরনের নৈরাজ্যের খবর আমরা দেখতে পেলাম। সরকার এ ক্ষেত্রে ভূমিকা নিতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধিসহ উৎপাদিত ফসলের দাম বেড়ে গেছে। আর বাজার ব্যবস্থার পুরনো ধারা অব্যাহত থাকায়, প্রকৃত কৃষক ফসলের লাভজনক দাম থেকে বঞ্চিত হচ্ছে; আবার শহরের ক্রেতারাও অধিক দামে এসব নিত্যপণ্য কিনতে বাধ্য হচ্ছে। বিদেশ থেকে আমদানিকৃত প্রয়োজনীয় পণ্যের দামের নৈরাজ্য ঠেকানো যায়নি। সম্প্রতি সয়াবিন তেল নিয়ে এই নৈরাজ্যের চূড়ান্ত রূপ দেখা যাচ্ছে। সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের হাতে এখনো বন্দি দেশ, দেশের বাজার। বাজার ব্যবস্থার সংস্কার ছাড়া যে এ অবস্থার উন্নতি করা যাবে না, এটা বারবার বললেও শোনার কেউ নেই। কেউ নেই বলাটাও বোধহয় যথাযথ না, কারণ মুক্তবাজারের নামে বাজারের ওপর সব ছেড়ে দিয়ে সাধারণ মানুষের স্বার্থে বাজার নিয়ন্ত্রণ যে করা যাবে না এটা বুঝলেও মুক্তবাজারের সমর্থকরা ক্ষমতায় থাকলে তাদের কাছ থেকে আশা করার যে বিশেষ কিছু নেই এটা সাধারণ মানুষ এত সহজে বুঝবে না। আর তাই মুক্তবাজারের সমর্থকরা ক্ষমতায় থেকে তাদের নীতি অব্যাহত রাখার কাজটাই করে যাবে। এখন হচ্ছে তো তা-ই।

শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের স্বার্থের কথা সবাই বলেন। তারপরও এই সরকারের সময় জাতীয় ন্যূনতম মজুরি, শ্রমিকের স্বার্থে ট্রেড ইউনিয়ন নিশ্চিত করা এবং এসব শ্রমজীবী মানুষের জীবন জীবিকা, ভবিষ্যৎ জীবন নিশ্চিত করার বিষয়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির খবর সাধারণ মানুষের কাছে নেই। শিক্ষা স্বাস্থ্যের নৈরাজ্যকর অবস্থার উন্নতির কথা কেউ বলতে পারছেন না। বরঞ্চ এসব ক্ষেত্রে অনিশ্চিত যাত্রাই সামনে থেকে যাচ্ছে।

রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন নিয়ে আলোচনা হয়। এই দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে কথা বলা হয়। কিন্তু অর্থনীতির দুর্বৃত্তায়নের ধারা অব্যাহত থাকলে তা যে অনিবার্যভাবে দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির জন্ম দেয়, আর এই দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতি-অর্থনীতি রক্ষা করতেই কর্তৃত্ববাদ, স্বৈরাচার, ফ্যাসিবাদের আবির্ভাব হয়, তাকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা হয়—এই গুরুত্বপূর্ণ কথাটি সাধারণভাবে সামনে আসে না।

‘সংস্কার’ এসময়ে বহুল আলোচিত শব্দ। কিন্তু গ্রাম শহরের সাধারণ মানুষের কাছে এর প্রকৃত অর্থ কি জিজ্ঞেস করলে অধিকাংশ মানুষ নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারবে না। এই অবস্থার মধ্যে আমরা যেন অনিশ্চিত যাত্রায় চলেছি।

দেশের সাধারণ মানুষ অনেক আগেই এইটুকু বুঝে এসেছিল যে তাদের ভোট দেয়ার ক্ষমতা আছে। এই ভোট দিয়ে তারা প্রতিনিধি নির্বাচন করবেন। প্রতিনিধিরা যদি ঠিক ঠিক মতো কাজ না করে তাদের কথা না শোনে, তাহলে পরবর্তী ভোটে, তাদের আর ভোট দেবে না। বিগত সময় প্রকৃত ভোট নামক বিষয়টি যেন কর্পূরের মত উড়ে গেছে। এজন্য সাধারণ মানুষের কাছে এটি একটি গ্রহণযোগ্য আলোচনা হলো নির্বাচন ব্যবস্থায় যে সংকট আছে তার সমাধান করে সবার ভোটে দাঁড়ানো ও সবার ভোট দেওয়ার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। বিগত স্বৈরাচারী ফ্যাসিবাদী সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময় এই দাবি অন্যতম প্রধান দাবি হিসেবে সামনে এসেছিল। এসময় এই ভোটের আলোচনা বারবার সামনে এলেও, তার সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপের ঘোষণা আসছে না, এমনকি সাধারণ মানুষ বুঝতেও পারছেন না কবে ভোট হবে।

এবারের গণঅভ্যুত্থানে আলোচনায় অনেক বিষয়ের মধ্যে দুটি বিষয় বিশেষভাবে সামনে এসেছিল যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর একটি হলো শুধু স্বৈরাচারকে উৎখাত করলে মানুষের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয় না। স্বৈরাচারী ব্যবস্থা যাতে টিকে থাকতে না পারে তা বন্ধ করার বলার রাস্তাটিও বন্ধ করতে হবে। আর সমাজে সর্বত্র দীর্ঘদিন ধরে যে বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে এই বৈষম্যের অবসান ছাড়া মানুষের স্বার্থরক্ষা করা যাবে না।

এ দুটি বিষয় নিয়ে কিছু আলোচনা হলেও সুনির্দিষ্ট করে এই সমস্যার সমাধানের বিকল্প পথ নিয়োগ নিয়ে খুব একটা আলোচনা অগ্রসর করা যায়নি।

এরমধ্যে প্রতিদিন রাজনৈতিক অঙ্গনসহ দেশের মধ্যে নানা ধরনের সমস্যা ও সংকট তৈরি হচ্ছে। পতিত স্বৈরাচারী শক্তি নানা ধরনের অপকৌশল করে আবার ক্ষমতাসীন হওয়ার পায়তারা করছে। এছাড়া দীর্ঘদিন ধরে বেড়ে ওঠা সাম্প্রদায়িক অপশক্তিসহ নানা ধরনের অপশক্তি সমাজে নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করে তাদের অপতৎপরতা অব্যাহত রেখে চলেছে। সরকারের কোন কোন অংশের প্রশ্রয়ে এরাই সুযোগ পাচ্ছে বলে বিভিন্ন কাজের মধ্য দিয়ে তারা সামনে আসছে। আর ভূ-রাজনৈতিক কারণে আধিপত্যবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দেশের রাজনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অব্যাহতভাবে তাদের আধিপত্য বিস্তারের কাজ করে চলেছে।

এ অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে দেশের মানুষের দীর্ঘ সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় জনজীবনের শান্তি ফিরিয়ে আনাসহ মানুষের প্রকৃত মুক্তি অর্জনে আমাদের সংগ্রাম আরো দৃঢ়তার সাথে অগ্রসর করতে হবে।

বিগত দিনগুলোতে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ও গণমুখী নীতিনিষ্ঠ কিছু বাম গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল শক্তি ও ব্যক্তিবর্গের গণমুখী ভূমিকা সচেতন মানুষের কাছে দৃশ্যমান হলেও, দেশের ব্যাপক সাধারণ মানুষের কাছে এখনো দৃশ্যমান হয়নি। অন্যদিকে নানা প্রচার প্রপাগান্ডার মধ্য দিয়ে অনেক অপশক্তি সামনে চলে এসেছে। এ অবস্থায় আমাদের সামনে নতুন এক চ্যালেঞ্জ উপস্থিত হয়েছে।

বিগত এক যুগ ধরে আমরা আওয়ামী লীগ সরকারের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি। ওইসময় আমরা মূল স্লোগান উচ্চারণ করে বলেছিলাম, ‘দুঃশাসন হটাও, ব্যবস্থা বদলাও, বাম গণতান্ত্রিক বিকল্প শক্তির সমাবেশ গড়ে তোলো’। এই স্লোগানের প্রাসঙ্গিকতা এখন আরও দৃশ্যমান হচ্ছে। ব্যবস্থা বদলের সংগ্রাম ও নীতিনিষ্ঠ বাম গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল বিকল্প শক্তি সমাবেশ গড়ে তোলাই এখনকার অন্যতম প্রধান কর্তব্য।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হওয়ার পর থেকে আমরা সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন সমস্যার সমাধানসহ সরকারের করণীয় বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কথা তুলে ধরে আমাদের সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছি। বিভিন্ন বিষয়ে দৃঢ়তার সাথে আমরা আমাদের অবস্থানকে পরিষ্কার করে অগ্রসর হওয়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছি।

চলমান সময়ে আশু সমস্যা সমাধানে ও সার্বিক সমস্যা সমাধানে আমাদের সুনির্দিষ্ট বক্তব্য দেশবাসীর কাছে তুলে ধরার কাজটি আরো পরিকল্পিতভাবে অগ্রসর করতে হবে। একই সাথে আমাদের সমবেত শক্তিও মানুষের সামনে আনতে হবে। আমাদের সমর্থক শুভানুধ্যায়ীদের পার্টির পতাকা তলে এনে, আরো সক্রিয় করে সাধারণ মানুষের মাঝে গিয়ে তাদের সংগঠিত করতে উৎসাহিত করতে হবে।

এ কাজটি করার মধ্য দিয়েই আমরা গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে মানুষের কাছে পূর্ণ গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা ও বৈষম্যমুক্ত সমাজ গড়ে তোলার যে আকাঙ্ক্ষা সামনে এসেছে ওই আকাঙ্ক্ষা পূরণে পথ দেখাতে পারবো।

এসব লক্ষ্যকে সামনে রেখেই ৩ জানুয়ারি ২০২৫ শুক্রবার ঢাকার ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঢাকা সমাবেশের আহ্বান জানানো হয়েছে। এই সমাবেশ থেকে বর্তমান সংকট সমাধানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, বিভিন্ন বাম-গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল ও দেশবাসীর করণীয় এবং আহ্বান তুলে ধরা হবে।

এসব আহ্বানকে সামনে রেখে আমাদের সদস্য, সমর্থক, শুভানুধ্যায়ীরা আবার দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে। দেশের শ্রমজীবী মেহনতি মানুষ, তরুণ প্রজন্মসহ সর্বস্তরের মানুষের কাছে আমরা আমাদের কথা পৌঁছে দিয়ে তাদের সমস্যা সমাধানে বিকল্প পথের সন্ধান তুলে ধরবো।

এর মধ্য দিয়েই আগামী দিনে, গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা, স্বৈরাচারী, সাম্প্রদায়িক, লুটপাটকারী, আধিপত্যবাদী-সাম্রাজ্যবাদী অপশক্তি রুখে দাঁড়ানোর মধ্য দিয়ে দেশকে অগ্রসর করার কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে।

সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য নির্বাচন ব্যবস্থার যতটুকু সংস্কার প্রয়োজন ততটুকু সংস্কার করে দ্রুততম সময় নির্বাচনের ধারায় দেশকে নিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের ধারাকে অগ্রসর করার কাজটি করার দিকে আমাদের এগোতে হবে। একই সাথে বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কারে যতটুকু ঐকমত্য হওয়া যায়, ততটুকু নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কার্যক্রম সূচনা করতে পারে যা আগামীতে অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্ব বহন করবে।

অতীতের মত অঙ্গীকার করেও যদি রাজনৈতিক দলসমূহ ওই অঙ্গীকার রক্ষা না করে সেই বিচারের ভার সাধারণ জনগণের ওপরই ছেড়ে দিতে হবে। একই সাথে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ইতিহাস ঐতিহ্য সংস্কৃতি ধ্বংসের বিরুদ্ধে যে কোনো অপতৎপরতাও রুখে দাঁড়াতে হবে। এইসব কাজই আমরা করতে পারবো প্রকৃত বাম গণতান্ত্রিক প্রগতিশীলদের শক্তি বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে।

৩ জানুয়ারি ২০২৫ এ আমরা ঢাকায় ব্যাপক সমাবেশের মধ্য দিয়ে ওই শক্তি বৃদ্ধির যাত্রাকে এগিয়ে নিতে পারবো। সংশ্লিষ্ট সবার মধ্যে উৎসাহ সৃষ্টি করতে পারবো। মানুষের মধ্যে বিকল্পধারাকে দৃশ্যমান করতে পারবো। ইতোমধ্যে এই সমাবেশ ঘিরে সিপিবিসহ বাম-প্রগতিশীল মহলে উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা যাচ্ছে। সারাদেশে প্রচার-প্রচারণা চলছে। আমরা সংশ্লিষ্ট সবাইকে ঢাকার সমাবেশ সফল করতে যথাযথ ভূমিকা রাখার আহ্বান জানাই।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ