সরকার একটি বিশেষ গোষ্ঠীর কাছে ‘মাথা নত করছে’: সমাবেশে বক্তারা

প্রকাশিত: ১১:০১ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ১৯, ২০২৫

সরকার একটি বিশেষ গোষ্ঠীর কাছে ‘মাথা নত করছে’: সমাবেশে বক্তারা

নিজস্ব প্রতিবেদক | ঢাকা, ১৯ জানুয়ারি ২০২৫ : অন্তর্বর্তী সরকার একটি বিশেষ গোষ্ঠীর কাছে মাথা নত করছে, ধর্মীয় গোষ্ঠীকে আশকারা দিচ্ছে। বিশেষ গোষ্ঠীকে মদদ দিলে রাজনৈতিক দল ও জনগণের সঙ্গে এই সরকারের দূরত্ব বাড়বে। রাজধানীর মতিঝিলে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ওপর হামলাকারীদের বিচার না হলে সামনে আরও কর্মসূচি দেওয়া হবে। ‘পাঠ্যবই থেকে আদিবাসী শব্দুযুক্ত গ্রাফিতি বাদ দেওয়া ও আদিবাসীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে’ এক সমাবেশে বক্তারা এসব কথা বলেছেন।

আজ রোববার (১৯ জানুয়ারি ২০২৫) বিকেলে রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে এই সমাবেশের আয়োজন করে ‘বিক্ষুব্ধ নাগরিক সমাজ’। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকার উন্নয়নের গীত গেয়েছে, আর অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কারের গীত গাইছে বলে মন্তব্য করে রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, এই গীত দিয়ে হবে না। রাজধানীর মতিঝিলে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ওপর ‘স্টুডেন্ট ফর সভরেন্টি’ যে হামলা চালিয়েছে, তার বিচার না হলে একের পর এক কর্মসূচি দেওয়া হবে।

সংখ্যালঘুরা আতঙ্কের মধ্যে থাকেন, যেকোনো সময় তাঁরা আক্রমণের শিকার হতে পারেন—এ কথা উল্লেখ করে অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস আরও বলেন, এই শঙ্কা নিয়ে বাস করা যায় না। তিনি বলেন, ‘প্রফেসর ইউনূসকে (অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা) বলি, এই সংবেদনশীল মন থাকতে হয়।…সেটা আপনার বিবৃতির মধ্যে, আপনার এত দিনের কাজের মধ্যে—কোথাও তো এই সংবেদনশীলতা, সেই মানবিকতার ছোঁয়া আমরা খুঁজে পাইনি।’

পাঠ্যবই থেকে গ্রাফিতি কেন তুলে ফেলা হলো, তার জবাবদিহি সরকারকে করতে হবে বলে মন্তব্য করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন। গ্রাফিতি তুলে ফেলার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার ও বিচারের পাশাপাশি গ্রাফিতি পুনর্বহালের দাবিও জানান তিনি।

গণ–অভ্যুত্থানের অঙ্গীকার ছিল সাম্য, ন্যায়বিচার ও অন্তর্ভুক্তিমূলক দেশ হবে উল্লেখ করে জোবাইদা নাসরীন বলেন, সরকার সেটি বজায় না রেখে বারবার একটি বিশেষ গোষ্ঠীর কাছে মাথা নত করছে। ধর্মীয় গোষ্ঠীকে আশকারা দিচ্ছে।

বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক কমরেড সাইফুল হক বলেন, সরকার বিশেষ কোনো গোষ্ঠীকে প্রত্যেক্ষ–পরোক্ষভাবে মদদ যোগাচ্ছে বোঝা গেলে তাদের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে রাজনৈতিক দল ও জনগণের সঙ্গে এই সরকারের দূরত্ব বাড়বে।

স্টুডেন্ট ফর সভরেন্টিকে একটি ‘লাঠিয়াল বাহিনী’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন গণফোরামের সভাপতি পরিষদের সদস্য সুব্রত চৌধুরী। অতীতের মতো সরকারের কোনো লাঠিয়াল বাহিনী দেখতে চান না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘…অতীতের সরকার তারা টিকতে পারে নাই, আপনিও লাঠিয়াল বাহিনী দিয়ে ক্ষমতায় থাকতে পারবেন না।’

অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে আসছে বলে মনে করেন বাসদের সাধারণ সম্পাদক কমরেড বজলুর রশীদ ফিরোজ। ‘অন্ধকারের শক্তি’ অন্তর্বর্তী সরকারকে পরিচালনা করছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘এই সরকার ধর্মীয় মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক শক্তিকে প্রশ্রয় দিচ্ছে কি না, মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনার বিপরীতে দেশকে নিয়ে যাওয়ার জন্য পাঁয়তারা করছেন কি না, তা ভাবতে হবে।’

বাংলাদেশে থাকতে হলে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করা যাবে না বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক কমরেড রুহিন হোসেন (প্রিন্স)। তিনি বলেন, সংবিধান থেকে তিন মূলনীতি বাদ দেওয়ার প্রস্তাবের পর আর ঐক্য নেই। সংবিধানে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানান তিনি।

রাজধানীর মতিঝিলে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় সরকারের পক্ষ থেকে যে নিন্দা জানানো হয়েছে, তা যথেষ্ট নয় বলে মন্তব্য করেন এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা। তিনি বলেন, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর দাবি বিবেচনায় নেওয়ার জন্য সরকার আলোচনা শুরু করেছে, এমন কার্যক্রম দেখতে চান।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে ‘আদিবাসী’ শব্দটি বলা যেত না বলে উল্লেখ করেন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে তাঁর প্রশ্ন, এখনো কেন সেই শব্দটি উচ্চারণ করা যাবে না?

আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অলীক মৃ অভিযোগ করেন, রাষ্ট্র ও সরকার ইচ্ছা করেই তাঁদের ওপর হামলা করিয়েছে। রাষ্ট্র ও সরকার তাঁদেরকে বিচ্ছিন্নতাবাদী তকমা দিয়ে রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করছে।

স্টুডেন্ট ফর সভরেন্টি নামের সংগঠনটিকে চরমপন্থী, সাম্প্রদায়িক ও উগ্র হিসেবে আখ্যায়িত করেন ঐক্য ন্যাপের সভাপতি এস এম এ সবুর।

সমাবেশ সঞ্চালনা করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় সদস্য দীপায়ন খীসা। এ সময় তিনি ছয়টি দাবি তুলে ধরেন। এর মধ্যে রয়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক (এনসিটিবি) কার্যালয়ের কাছে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে হামলায় জড়িত সবাইকে গ্রেপ্তার করতে হবে। আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসার দায়িত্ব রাষ্ট্রকে নিতে হবে। এই হামলার পেছনে বিশেষ মদদদাতা গোষ্ঠী সক্রিয় ছিল কি না, তা শনাক্ত করতে হবে। পাঠ্যপুস্তকে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর যথাযথ ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কিত অধ্যায় যুক্ত করতে হবে। এনসিটিবিকে ক্ষমা চাইতে হবে এবং গ্রাফিতি পুনঃস্থাপন করতে হবে। হামলার সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা কেন নীরব ছিলেন বা ব্যর্থ হলেন, তার ব্যাখ্যা সরকারকে দিতে হবে।

এ সময় আরও বক্তব্য দেন আদিবাসী ফোরামের সহসাধারণ সম্পাদক গজেন্দ্রনাথ মাহাতো, বাংলাদেশ জাসদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক করিম সিকদার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক খায়েরুল ইসলাম প্রমুখ।