বদলাচ্ছে মেয়েশিশুর প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি

প্রকাশিত: ৯:০৯ পূর্বাহ্ণ, এপ্রিল ১২, ২০২৫

বদলাচ্ছে মেয়েশিশুর প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি

বিশেষ প্রতিনিধি | ঢাকা, ১২ এপ্রিল ২০২৫ : রাজধানীর মিরপুরের বাসিন্দা লায়লা রহমান (৪০)। বিয়ের পর তার কোল আলো করে পৃথিবীতে আসে এক রাজকন্যা। এ খবরে কন্যার নানা বাড়িতে আনন্দ-উৎসব শুরু হয়। কিন্তু সেদিন বিপরীত চিত্র দেখা যায় কন্যার বাবার পরিবারে। কন্যা শিশু জন্ম দিয়ে যেন পরিবারকে বিপদে ফেলেছেন এমন ভাব শ্বশুরবাড়ির সদস্যদের।

এ নিয়ে কম অপমান সইতে হয়নি লায়লা রহমানকে। পুরোনো স্মৃতি মনে এলে এখনও ডুকরে কেঁদে উঠেন তিনি। শ্বশুরবাড়ির অবহেলায় জন্ম নেওয়া শিশুটি আজ প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষার্থী।

দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠে পড়ার কারণে দাদার বাড়িতে কদর বাড়লেও তার মা এখনও সেদিনের অপমানের যন্ত্রণা ভুলতে পারেননি। ‘এখন আমার সেই মেয়েকে নিয়েই পরিবারের সবাই স্বপ্ন দেখছেন’ বলে এই প্রতিবেদকের সাথে আলাপচারিতায় জানান লায়লা রহমান।

পিতা রায়হান উদ্দিন বলেন, তিনটি মেয়ে সন্তান জন্ম দিয়েও আমি একজন গর্বিত পিতা। আমার বড় মেয়ে ছন্দা ডাক্তার, দ্বিতীয় মেয়ে মায়া শিক্ষকতা পেশায় আছে, আর ছোট মেয়ে মাইসা ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি থেকে বিবিএ-এমবিএ করে একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকুরি করছে।

এই প্রতিবেদকের কাছে দু:খ প্রকাশ করে রায়হান উদ্দিন বলেন, আমার তিনটি মেয়ে, ছেলে নেই। আমার ভবিষ্যৎ অন্ধকার। এ ধরনের নানা নেতিবাচক কথা আমাকে আমার কাছের আত্মীয়-স্বজন এবং সহকর্মীদের কাছ থেকে শুনতে হয়েছে। কিন্তু আমি হতাশ হয়ে ভেঙে পড়িনি। আমি আমার মেয়েদেরকে মেয়ে নয়, মানুষ মনে করে, গড়ে তুলেছি। তাদের পেছনে আমার অর্থ, শ্রম, মেধা ব্যয় করে ওদের অ্যাকাডেমিক শিক্ষার পাশাপাশি সু-শিক্ষা দিয়ে গড়ে তুলেছি।

‘আজ আমার মেয়েরা সর্বক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। সন্তান ছেলে হোক বা মেয়ে হোক, সন্তানকে সঠিক পরিবেশ দিয়ে প্রকৃত মানুষ করে তুলতে পারছেন কি না- সেটাই বড় কথা।’ মেয়ে সন্তানদের নিয়ে এমনই ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির কথা জানালেন ফার্মগেইট মনিপুরি পাড়ার বাসিন্দা রায়হান উদ্দিন।

কন্যাশিশুর প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে উল্লেখ করে সাংবাদিক জি এম নেওয়াজ বলেন, দৈনিক বর্তমান বন্ধ হওয়ার পর অনেক দিন বেকার ছিলাম। আমার মেয়ে জুনাইরা বিনতে নেওয়াজ যেদিন পৃথিবীতে আগমন করে ওই মাসেই আমার চাকরি হয় যায়যায়দিন পত্রিকায়। সেদিনই উপলব্ধি করি, কন্যা সন্তান আল্লাহর দান এবং পিতার জন্য রহমত।

সেই দিন থেকেই আল্লাহ আমার ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দেন। সে এখন ৩য় শ্রেণির শিক্ষার্থী। ইংরেজি ভার্সনে কোয়ান্টাম ম্যাথডের প্রতিষ্ঠিত কসমো স্কুলে পড়ছে। তার ছোট ভাই হুজাইয়া বিন নেওয়াজও প্রেপ-২ ক্লাসের শিক্ষার্থী।

মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর একটা বাণী অনুসরণ করেন জানিয়ে নেওয়াজ আরও বলেন, বাসায় খাবার জাতীয় কিছু নিয়ে ফিরলে প্রথমে তার মেয়ের হাতে তুলে দেন। মেয়েকে ক্যাডেটে পড়িয়ে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করার ইচ্ছা প্রকাশ করে তিনি বলেন, কন্যা শিশু জন্মগ্রহণ করলে এখন পিতামাতার মন খারাপ হয় না। বরং পরিবারের প্রথম সন্তান কন্যা হলে তাকে সৌভাগ্যের প্রতীক বলে মনে করা হয়।

বাসা-বাড়িতে কাজ করেন আছমা খাতুন। স্বামী হাসান ইসলাম রিকশা চালাতেন, এখন অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়া। তার ২ ছেলে, এক মেয়ে। বড় ছেলে বিয়ে করে আমাদের ফেলে রেখে আলাদা সংসার গড়েছেন। দ্বিতীয় ছেলে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে বখাটেদের সাথে মিশে নেশা-পানি খায়।

অভাবের কারণে মেয়ে রেহানাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়িয়ে বন্ধ করে দিতে হয়েছে পড়াশোনা। মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও রেহানা আর এগিয়ে যেতে পারেনি। আর সেই মেয়েই আমার গার্মেন্টেসে চাকুরি করে সংসারের হাল ধরেছে।

আছমা খাতুন আর হাসান ইসলাম দম্পতি বলেন, আমার দুই পোলার জায়গায় যদি আরো দুইডা মাইয়া হইত তাইলে আমরা আরো বেশি খুশি হইতাম। আমরা কষ্ট কইরা হইলেও মাইয়াগো লেখাপড়া শিখাইতাম।

লায়লা রহমান, শাহনেওয়াজ, রায়হান উদ্দিন, আছমা খাতুন আর হাসান ইসলামের পরিবারের মতো বর্তমানে বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশেই কন্যাশিশুদের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়েছে। এ কারণে পরিবার এবং সমাজে দিন দিন তাদের কদর বাড়ছে। কেননা কন্যাশিশুরা এখন আর বোঝা নয়। ছেলে সন্তানের মত তারাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। সর্বক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকার কারণে সমালতালে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছেন কন্যাশিশুরা।

খেলাধুলা, বিজ্ঞান, গবেষণা, আবিষ্কার, রাজনীতি, প্রশাসন, পররাষ্ট্র ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সবক্ষেত্রেই মেয়েদের সরব উপস্থিতি লক্ষণীয়। নারী শক্তি এখন আর শুধু ঘরের চার দেয়ালের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই।

অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশের নারীরা তাদের সক্ষমতার বিকাশ ঘটিয়ে বাইরের দুনিয়ায় সমান পারদর্শিতার সাথে কাজ করে যাচ্ছে। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সমাজ-দেশ, এগিয়ে যাচ্ছেন নারীরাও। বাংলাদেশ এখন নারীর ক্ষমতায়নে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশ টানা দ্বিতীয়বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে।

কন্যাশিশু এডভোকেসি ফোরাম জানায়, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪২ শতাংশ শিশু। যাদের বয়স আঠারো বছরের কম। আর শিশুদের মধ্যে ৪৯ শতাংশ কন্যাশিশু। যাদের পেছনে রেখে দেশের উন্নয়ন কখনও সম্ভব নয়। বিশ্বে মোট জনসংখ্যার ১৫ ভাগ কন্যাশিশু। বাংলাদেশেও মোট জনসংখ্যার ১৭ শতাংশের কাছাকাছি কন্যাশিশু রয়েছে।

রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানার মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র তথ্য (বায়োমেট্রিকস ডেটাবেজ অনুসারে) অনুযায়ী, বাংলাদেশে তৈরি পোশাক কারখানায় ৩৩ লাখ ১৭ হাজার ৩৯৭ জন শ্রমিক রয়েছেন। এর মধ্যে ৫২ দশমিক ২৮ শতাংশই নারী শ্রমিক। সংখ্যার হিসাবে নারী শ্রমিক রয়েছেন ১৭ লাখ ৩৪ হাজার ৪৫৯ জন।

অন্যদিকে নিট (গেঞ্জিুজাতীয় পোশাক উৎপাদন) পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ’র তথ্য অনুযায়ী, নিট সেক্টরে ১৭ লাখ ২৫৫ জন শ্রমিক রয়েছেন। যার ৬২ শতাংশ অর্থাৎ ১০ লাখ ৫৪ হাজার ১৫৭ জনই নারী। সব মিলিয়ে দেশে তৈরি পোশাক খাতে ৫০ লাখ ১৭ হাজার ৬৫২ জন শ্রমিক রয়েছেন। যার ৫৫ দশমিক ৫৭ শতাংশ অর্থাৎ ২৭ লাখ ৮৮ হাজার ৬১৬ জন নারী শ্রমিক।

বাংলাদেশি মেয়ে পেসার মারুফা আক্তার আইসিসির ২০২৩ সালের বর্ষসেরা নারী উদীয়মান ক্রিকেটার মনোনীতদের তালিকায় উঠে এসেছেন। জানা যায়, মারুফা আক্তারের জন্ম নীলফামারী সদর উপজেলার সংগলশী ইউনিয়নের ঢেলাপীর এলাকায়। বাবা আইমুল্লাহ হক বর্গাচাষি আর মা মর্জিনা বেগম গৃহিণী। মা-বাবা, চার ভাইবোনসহ ছয়জনের বেশ বড়সড় পরিবার।

মারুফাদের ভিটেমাটি ছাড়া আর কোনো জায়গা-জমি নেই। ঘরের যেই ভিটে তাও মারুফার নানার দেওয়া। তবে এখন বদলে যাচ্ছে সব। কেবল নিজের পরিবারই নয়, মারুফা বদলে দিচ্ছেন দেশের লাখো মেয়ের চিন্তাভাবনা। দেখাচ্ছেন নতুন দিনের স্বপ্ন।

অনূর্ধ্ব-১৯ নারী সাফে সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার জিতে নিয়েছেন সাগরিকা। পেয়েছেন সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কারও। সাফের প্রথম ম্যাচে তার জোড়া গোলে নেপালকে হারায় বাংলাদেশ। ভারতের বিপক্ষে তার একমাত্র গোলে জেতে বাংলাদেশ।

বছর দুয়েক আগে সুইডিশ কিশোরী গ্রেটা থুনবার্গ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে পৃথিবী ও পরবর্তী প্রজন্মকে রক্ষায় বড়দের আরও অনেক বেশি সক্রিয় ভূমিকা পালনের দাবিতে নিজের স্কুলের সামনে একা প্ল্যাকার্ড হাতে ধর্মঘটে বসেছিলেন। মাত্র দুই বছরে এই কিশোরী জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক আন্দোলনে সারা বিশ্বের দূত হয়ে উঠেছেন।

আজ তার ডাকে জড়ো হয় লাখ লাখ মানুষ।

জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের ন্যাশনাল কোঅর্ডিনেটর সৈয়দা আহসানা জামান এ্যানি বলেন, এমন একটা সময় ছিল যখন কন্যাশিশু জন্মগ্রহণ করলে বাবা-মায়ের মন খারাপ হতো। তবে এখন সময় বদলেছে। বদলেছে বাবা-মায়ের ধারণারও।

শিক্ষাক্ষেত্রে, কর্মক্ষেত্রে যোগ্যতা প্রমাণ করে এগিয়ে যেয়ে কন্যাশিশুরা পরিবারে একটা ভরসার স্থান করে নিতে পেরেছে, যেটা কিছুদিন আগেও ছিল না। আগে ভাবা হতো, ছেলে সন্তানই পরিবারের ভবিষ্যৎ, তাদের পেছনেই বিনিয়োগ করলে বৃদ্ধ বয়সে বাবা-মাকে তারা দেখবে, পরিবারের হাল ধরবে।

বর্তমানে কম-বেশি প্রতিটি জায়গাতেই এ ধারণাটা অনেকখানিই বদলেছে। বাধা-বিঘ্ন পেরিয়ে কন্যাশিশুরা এখন পুত্র সন্তানের মতো সমানতালে পরিবারে, সমাজে ও রাষ্ট্রে অবদান রেখে চলেছে। কন্যা সন্তানও বৃদ্ধ পিতা-মাতার অসহায় জীবনে সহায় হচ্ছে। ক্ষেত্রবিশেষে পুত্র সন্তানের চেয়ে বাবা-মার প্রতি বেশি দায়িত্ব পালন করছে কন্যারাই।

আজকের কন্যাশিশুই আগামী দিনের আদর্শ মা।

তাই কন্যা শিশুদের সাহসী ও আত্মবিশ্বাসী করে গড়ে তুলতে হবে। শিশুদের অধিকার নিশ্চিত করতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। কন্যাশিশুরা যদি বাধাহীনভাবে আরও এগিয়ে যেতে পারে, তবে তারা সমাজ এবং রাষ্ট্রে আরও জোরালো অবদান রাখতে পারবে বলে মনে করেন সৈয়দা আহসানা জামান এ্যানি।