সিলেট ১৪ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৯শে আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৮:১২ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ২৬, ২০২৫
বিশেষ প্রতিনিধি | ঢাকা, ২৬ এপ্রিল ২০২৫ : অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেছেন, অনেক সংস্কার কমিশন গঠিত হলেও সুপারিশ বাস্তবায়নে অগ্রগতি নেই।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ৮ মাস: ভূমিকা ও সংস্কার প্রস্তাব শীর্ষক পর্যবেক্ষণ, পর্যালোচনা ও মতবিনিময়সভার মূল বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।
শনিবার (২৬ এপ্রিল ২০২৫) সকাল ১১টায় রাজধানীর বিজয়নগরের ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের হলরুমে ‘গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির উদ্যোগে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সভায় অন্তর্বর্তী সরকারের ৮ মাসের কার্যক্রম পর্যালোচনা করেন কমিটির সদস্যরা।
বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর প্রেসিডেন্ট দিলীপ রায়ের সঞ্চালনায় এবং অধ্যাপক আনু মুহাম্মদের সভাপতিত্বে আয়োজিত এ সভায় সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন বিষয়ে তাদের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন।
স্থপতি ফারহানা শারমিন ইমু ও স্থপতি আরিফুল হক শাওন জুলাই অভ্যুত্থানে আহতদের চিকিৎসা নিয়ে কথা বলেন। সংবিধান ও বিচার বিভাগের পরিস্থিতি তুলে ধরেন আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। জননিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে বক্তব্য রাখেন রাজনৈতিক কর্মী বাকি বিল্লাহ ও অ্যাক্টিভিস্ট রাফসান আহমেদ।
দ্রব্যমূল্য ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোশাহিদা সুলতানা ঋতু। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত নিয়ে বক্তব্য দেন লেখক ও গবেষক কল্লোল মোস্তফা। শ্রমিকদের অবস্থা তুলে ধরেন বাংলাদেশ গার্মেন্টস ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সত্যজিৎ বিশ্বাস।
কৃষকের সংকট ও সরকারের করণীয় বিষয়ে কথা বলেন লেখক ও গবেষক মাহা মির্জা ও সাংবাদিক সাঈদ শাহীন। শিক্ষা সংকট নিয়ে মত দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সামিনা লুৎফা নিত্রা ও গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট ছায়েদুল হক নিশান।
স্বাস্থ্যব্যবস্থার সংকট ও উত্তরণের উপায় নিয়ে বক্তব্য দেন চিকিৎসক ড. হারুন উর রশীদ। পাহাড় ও সমতলের আদিবাসী জনগোষ্ঠী নিয়ে কথা বলেন মানবাধিকারকর্মী ইলিরা দেওয়ান ও শিক্ষার্থী হেমা চাকমা। নারী ও লিঙ্গ বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীর পরিস্থিতি তুলে ধরেন মানবাধিকারকর্মী ফেরদৌস আরা রুমী এবং হরিজন জনগোষ্ঠীর অধিকার নিয়ে কথা বলেন নারী মুক্তি কেন্দ্রের সভাপতি সীমা দত্ত। সমবায় খাতের প্রতারণার চিত্র তুলে ধরেন নাসিরুদ্দিন নাসু।
সভায় মূল বক্তব্যে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, অনেক সংস্কার কমিশন গঠিত হলেও সুপারিশ বাস্তবায়নে অগ্রগতি নেই। নারী সংস্কার কমিশনের উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে সমানাধিকারের সুপারিশ এবং শ্রম সংস্কার কমিশনের জাতীয় ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ, শিল্প পুলিশ বাতিল, বকেয়া পরিশোধ ও সমমজুরি নিশ্চিত করার মতো বিষয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গুরুত্বপূর্ণ করণীয় ছিল।
তিনি বলেন, এসব বাস্তবায়নে গবেষণার প্রয়োজন নেই; সরকার উদ্যোগ নিলেই পরিবর্তনের দৃষ্টান্ত স্থাপন সম্ভব। সংস্কার আগে না নির্বাচন আগে—এ বিতর্ক অপ্রয়োজনীয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারই অনেক সংস্কার করতে পারে, কিন্তু বাস্তবে তা ঘটছে না।
তিনি আরও বলেন, জুলাইয়ে আহতদের চিকিৎসা, বম আদিবাসীদের মুক্তি কিংবা হরিজনদের জামিনের মতো মৌলিক বিষয়েও অগ্রগতি নেই। আদালতে রাজনৈতিক প্রভাব থাকলে সরকারের সংস্কার-ইচ্ছার বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, সংবিধান সংস্কার কমিশনের রাষ্ট্রধর্ম বহাল রাখার যৌক্তিকতা নেই। ধর্মনিরপেক্ষতা ছাড়া বহুত্ববাদ প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।
তিনি বলেন, সমাজতন্ত্র বাদ দিয়ে মুক্ত বাজার অর্থনীতি সুপারিশ করা হয়েছে, যা বৈষম্যহীন বাংলাদেশের চেতনাকে আঘাত করে।
তিনি কৃষক-শ্রমিক-আদিবাসী প্রতিনিধিত্ব, শিক্ষা-স্বাস্থ্যে ভর্তুকি ও জ্বালানিকে মৌলিক অধিকার করার পক্ষে মত দেন।
তিনি আরও বলেন, উচ্চ আদালতে রাজনৈতিক প্রভাব এখনো কাটেনি। জামিন পাওয়ার পরও বন্দিদের মুক্তিতে বিলম্ব হয়। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়েরের মাধ্যমে দমননীতি চলছে এবং জেল আইনের সংস্কার এখনো আলোর মুখ দেখেনি।
জুলাই আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসা প্রসঙ্গে স্থপতি আরিফুল হক শাওন বলেন, তালিকা জটিলতা, কাগজপত্র জমার হয়রানি, চিকিৎসা প্রচারণার সীমাবদ্ধতা ও পুনর্বাসন পরিকল্পনার অভাব রয়েছে। তিনি সব মন্ত্রণালয়কে নিয়ে একটি সমন্বিত মাস্টারপ্ল্যান তৈরির আহ্বান জানান।
স্বাস্থ্য সংকট বিষয়ে অধ্যাপক হারুন উর রশীদ বলেন, স্বাস্থ্যকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি, বাজেট বাড়ানো, সরকারি হাসপাতাল উন্নীতকরণ এবং চিকিৎসক-নার্স নিয়োগসহ ১৬টি করণীয় দ্রুত বাস্তবায়ন জরুরি।
শিক্ষা সংকট বিষয়ে ড. সামিনা লুৎফা নিত্রা ও ছায়েদুল হক নিশান বলেন, শিক্ষা এখনো উপেক্ষিত। তারা জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠন, শিক্ষাকে মৌলিক অধিকার ঘোষণা, উপাচার্য নিয়োগে সংস্কার, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনে শিক্ষার সুলভকরণের দাবি জানান। পাশাপাশি, ডাকসু নির্বাচন ও সেশনজট নিরসনের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
তারা বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানের পর শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক সচেতনতা বেড়েছে, যা গণতান্ত্রিক শিক্ষাঙ্গণ তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ। তবে ক্যাম্পাসে মব ভায়োলেন্স, পরিচয়ভিত্তিক বিভাজন এবং জনতুষ্টিবাদী কার্যক্রম গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরিতে বাধা সৃষ্টি করছে।
অর্থনৈতিক সংকট বিষয়ে মোশাহিদা সুলতানা ঋতু বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার পুরোনো পরিকল্পনা অব্যাহত রেখেছে এবং নতুন কোনো টেকসই অর্থনৈতিক পরিকল্পনা গ্রহণ করেনি। পাটকল পুনরায় চালুর কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ নেই। তিনি অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত করার আহ্বান জানান এবং বাজেটে পরোক্ষ কর কমানো, ব্যাংক খাত সংস্কার এবং পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে কার্যকর পদক্ষেপের প্রস্তাব দেন।
কৃষকের সংকট প্রসঙ্গে মাহা মির্জা বলেন, আলু, পেঁয়াজ ও ফুলকপিতে কৃষকদের ব্যাপক লোকসান হয়েছে। তিনি সরকারি বীজ সরবরাহ বাড়ানো, হিমাগারের সক্ষমতা উন্নত করা এবং কৃষকের জন্য সংরক্ষণের ভাগ নির্ধারণের দাবি জানান।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত নিয়ে কল্লোল মোস্তফার বক্তব্য পাঠ করে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, দ্রুত সরবরাহ আইন বাতিল হলেও পুরোনো ব্যয়বহুল চুক্তি বহাল আছে। আদানির চুক্তি বা সুন্দরবন-সংলগ্ন প্রকল্প বাতিলের কোনো উদ্যোগ নেই। ব্যয় কমাতে বেসরকারি চুক্তি সংশোধন ও ক্যাপাসিটি চার্জ বাতিলের দাবি জানান তিনি।
শ্রমিক পরিস্থিতি নিয়ে সত্যজিৎ বিশ্বাস বলেন, শ্রমিক আন্দোলন দমনে মামলা, গ্রেফতার ও গুলি চালানোর নীতি চলমান। শিল্প এলাকায় ভয়ের পরিবেশ এখনো কাটেনি এবং বিগত সরকারের আমলে শ্রমিকদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলার কোনো বিচার হয়নি।
পাহাড় ও সমতলের আদিবাসী প্রসঙ্গে হেমা চাকমা বলেন, বান্দরবানে বম জনগোষ্ঠীর ওপর নির্যাতন বিগত সরকারের মতোই অব্যাহত রয়েছে এবং সেনাশাসন প্রত্যাহারের দাবি এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। সংবিধান সংস্কারে আদিবাসীদের দাবির প্রতিফলন ঘটেনি বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
রাজনৈতিক কর্মী বাকি বিল্লাহ বলেন, বিচারবহির্ভূত হত্যা, নারী ও শিশুনির্যাতন, সংখ্যালঘু নির্যাতন ও শ্রমিক অসন্তোষ বেড়েছে। তিনি দ্রুত বিচার ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিতের আহ্বান জানান।
নারী ও লিঙ্গ বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠী প্রসঙ্গে ফেরদৌস আরা রুমি বলেন, ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি বেড়েছে। নারী, হিজড়া ও যৌনকর্মীদের নিরাপত্তায় সরকার কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি।
নারী মুক্তি কেন্দ্রের সভাপতি সীমা দত্ত বলেন, হরিজনদের মামলা মোকদ্দমায় ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হচ্ছে না এবং চাকরির জন্য ঘুষ ছাড়া উপায় নেই।
সমবায় প্রতারণা প্রসঙ্গে নাসিরুদ্দিন নাসু জানান, জামালপুরের মাদারগঞ্জে ৩৪ হাজার পরিবারের আড়াই হাজার কোটি টাকা সমবায়ের নামে একটি রাজনৈতিক চক্র আত্মসাৎ করেছে। তিনি প্রতারিত জনগণের আন্দোলনে সমর্থন জানান।
সম্পাদক : সৈয়দ আমিরুজ্জামান
ইমেইল : rpnewsbd@gmail.com
মোবাইল +8801716599589
৩১/এফ, তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০।
© RP News 24.com 2013-2020
Design and developed by ওয়েব নেষ্ট বিডি