মুক্তি পায়নি শোকগাথা

প্রকাশিত: ১০:০৫ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ২৬, ২০২৫

মুক্তি পায়নি শোকগাথা

Manual6 Ad Code

আয়শা জাহান নূপুর |

পশ্চিমবঙ্গ,আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড ও অরুনাচল প্রদেশ এই ৭টি নিয়ে ছিল কলকাতা বোর্ড। তখন গ্রামের স্কুলগুলোতে কোনো মুসলিম শিক্ষার্থীরা পড়ার সুযোগ পেত না। তাই তারা পড়াশোনা করতো না। আর একটু সহজ করে বললে- আসলে মুসলিম ঘরের সন্তানদের ভর্তি নেয়া হতো না। ঠিক ঐ সময়ে প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে আসা মুসলিম ঘরের একটা ছেলে কলকাতা বোর্ডে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় ১৯৩৮ সালে ফাস্ট ডিভিশন নিয়ে পাস করে।

Manual1 Ad Code

এই খবর চারপাশে ছড়িয়ে পড়লে তখনকার স্থানীয় জমিদার এই ছেলেটিকে লোক মারফত ডেকে পাঠালেন। খালি পা। ছেলেটি ভোর থেকে জমিদার বাড়ির চারপাশে পায়চারি করতে থাকে কখন ভেতর থেকে ডাক আসে সেজন্য। অবশেষে ডাক আসে। জমিদার বললেন, ‘এই তুই নাকি পাস দিছোস?’
ছেলেটির উত্তর, ‘হ্যাঁ, ঠাকুর।’
জমিদার বললেন, ‘আগামীকাল থেকে তুই গদিতে বসবি। ব্যবসার হিসাব রাখবি।’

ছেলেটি সেই রাতেই পালালো কলকাতা গিয়ে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হতে। ছেলেটির নাম মো. সামসুল হক। তিনি ১৯৭১ সালের ৩ এপ্রিল চট্টগ্রামের ঘাসিয়াপাড়ায় পাকিস্তান বাহিনীর মর্টার শেলে প্রাণ হারানো আছমা বেগম, নাজমা বেগম ও ফাতেমা বেগমের পিতা। তার আদি বাড়ি মুন্সীগঞ্জের ভাগ্যকূলে। চট্টগ্রামের দামপাড়া এলাকায় থাকেন চাকরির সুবাদে। চাকরি করেন চট্টগ্রাম রেলওয়ের হিসাব বিভাগে। ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণার পর বিচ্ছিন্নভাবে দেশের সর্বত্রই অস্থিরতা বিরাজ করলে তিনি তার পরিবার নিয়ে আশ্রয় নেন ঘাসিয়াপাড়ার এক অবস্থাপন্ন বাড়িতে। সর্বসাকুল্যে সেখানে আশ্রয় নেয় ৬৫ জন। সামসুল হক সাহেবের বড় ছেলে তখন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার উদ্দেশ্যে তখন সে বাড়ির বাইরে। প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য অনেকের সাথে আশ্রয় নেয় চট্টগ্রাম ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ ওয়াহিদ উদ্দিন আহমেদের বাড়িতে। বাকি ৩ ছেলে ও ৫ মেয়েকে নিয়ে তিনি ঘাসিয়াপাড়ায় আশ্রয় নেন।

সময় ১৯৭১, ৩ এপ্রিল। ভোর বেলা। কেউ কেউ ঘুমে, কেউ কেউ জেগে উঠেছে কেবল। পাকিস্তানি বাহিনীর মর্টার শেলে প্রাণ হারায় আশ্রিত মোট ১৬ জন। তাদের মধ্যে রয়েছে সামসুল হকের তিন মেয়ে। আসমা ও ফাতেমা সাথে সাথেই মারা যায়। আরেক মেয়ে নাজমার রক্তক্ষরণ থামছে না। চিকিৎসার জন্য কোথাও নেওয়ার ব্যবস্থা নেই। চারপাশ ঘিরে রেখেছে পাকিস্তান বাহিনী। নাজমা বার বার বলছে, আমার ভাই মেডিকেলে পড়ে। আমাকে রক্ত দিলে আমি বেঁচে যাবো। আমাকে বাঁচান। রক্তের গ্রুপ বি পজেটিভ। অনেক কষ্টে স্থানীয় এক ডাক্তারে বাড়িতে নেয়া হয় চিকিৎসার জন্য। কিন্তু রক্ত সংগ্রহ করা যাচ্ছে না। কবর খোঁড়া হয়েছে একটা। নামানো হয়েছে দুটো লাশ। অপেক্ষা করছে বাকি একজন মরে গেলে তাকেও এক কবরেই রাখা হবে। অবশেষে ব্যাপক রক্তক্ষরণে শেষ পর্যন্ত মারা যায় নাজমাও। তিন বোনের এক কবর।সামসুল হকের আরেক মেয়ের বুকের এক পাশ উড়ে যায়। তিনি এখনো বেঁচে আছেন এই চিহ্ন নিয়ে ঠিক একই ভাবে তার ছোট ছেলের শরীরেও আছে শেলের চিহ্ন। ঐদিনে আহতের সংখ্যা ছিল অনেক।

২৬ মার্চ থেকে ৩ এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর ভাস্কর্য গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল এই তিন জন আছমা, নাজমা ও ফাতেমাকে স্মরণ করে ‘ত্রিবেণী’ শিরোনামে প্রদর্শনী। এই প্রজন্মের একদল তরুণের আঁকা ৪৫টি চিত্রকর্ম স্থান পেয়েছে এই আয়োজনে। জলরং, তেল রং ও দৃশ্যমাধ্যমে তারা ফুটিয়ে তুলেছে শহীদ আসমা, নাজমা ও ফাতেমার শৈশব থেকে সেইদিন পর্যন্ত। ৩ এপ্রিল ছিল এই আয়োজনের সমাপনী দিন। প্রদর্শনী ‘ত্রিবেণী’ উদ্বোধন করেছেন অন্তবর্তীকালীন সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেই এসেছিল ৯ দিন ব্যাপী এই স্মৃতিময় আয়োজনে।

Manual6 Ad Code

Manual2 Ad Code

প্রথম দিনের মতো শেষ দিনও ছিল দর্শকের উপচে পড়া ভীড়। সমাপনী অনুষ্ঠানে দর্শকদের সাথে উপস্থিত ছিলেন শহীদ পরিবারের সদস্যরাও। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শহীদের ছোট ভাই আবদুর রহমান বাবলু। বড় ভাই, জনস্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের সাবেক পরিচালক, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা ও বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকারের স্বাস্থ্য সংস্কার কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডাঃ মোজাহেরুল হক তাঁর অনুভূতি প্রকাশ করার এক পর্যায়ে বলেন, ‘৫৪ বছর ধরে আমার পরিবার এই বেদনাদায়ক স্মৃতি আঁকড়ে বেঁচে আছে। আমাদের সঞ্চয় বলতে আছে বোনদের প্রতি গভীর মমতা, ভালোবাসা, একটা সাদা কালো ছবি আর তাদের পরিধেয় বস্ত্র বলতে আছে ৩টি জামা আর ৩টি শাড়ি। যা এতো বছর ধরে আমার যত্ন সহকারে রেখে দিয়েছি আজ ভাস্কর্য গ্যালারির এই দেয়ালের চারপাশ থেকে আমাদের বোনেরা আমাদের সকলের দিকে তাকিয়ে আছে। এই ৫৪ বছর এই স্বাধীন বাংলাদেশে অনেক সরকার এসেছেন। এখন পর্যন্ত এই তিন বোন পায়নি কোন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি, মানুষ জানেনি তাদের নাম। এমন একটি ঘটনা আসেনি কোনো প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার। আমরা কাউকে এই তিনজনের নাম বললে কেউ তাদের নাম শুনেনি বলতো। এই আয়োজনের মধ্যে দিয়ে, আপনাদের মধ্যে দিয়ে আজ অনেকেই তাদের নাম জানবে। আমরা চাই, তাদের অবদান অস্বীকার করার ইচ্ছা কারো না থাকুক। সাথে সাথে আমি প্রাণ হারানো বাকিদের শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করছি। আমার বোনদের মতো তাদের কথাও কেউ হয়তো জানেন না! তাদের সকলের ভাগ্য এক ও অভিন্ন।’
#
আয়শা জাহান নূপুর
কবি ও সংগঠক

Manual7 Ad Code

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

 


Follow for More!

Manual1 Ad Code
Manual3 Ad Code