বিশ্বের দরিদ্রতম প্রেসিডেন্ট কমরেড পেপে মুজিকা আর নেই

প্রকাশিত: ৯:৩০ পূর্বাহ্ণ, মে ১৪, ২০২৫

বিশ্বের দরিদ্রতম প্রেসিডেন্ট কমরেড পেপে মুজিকা আর নেই

বিশেষ প্রতিনিধি | মোন্তেভিদেও (উরুগুয়ে), ১৪ মে ২০২৫ : বিশ্বজুড়ে বামপন্থীদের কাছে এক কিংবদন্তি ও গেরিলা যোদ্ধা হিসেবে পরিচিত উরুগুয়ের সাবেক প্রেসিডেন্ট কমরেড হোসে ‘পেপে’ মুজিকা আর নেই।

তিনি মারা গেছেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৯ বছর। খাদ্যনালির ক্যানসারের সঙ্গে দীর্ঘ এক বছরের লড়াইয়ের পর চলতি মে মাসের শুরুতে তাঁকে প্যালিয়েটিভ কেয়ারে রাখা হয়েছিল।

উরুগুয়ের বর্তমান রাষ্ট্রপতি ইয়ামান্দু ওরসি এক্স হ্যান্ডলে এক শোকবার্তায় বলেন, ‘গভীর দুঃখের সঙ্গে আমরা আমাদের কমরেড পেপে মুজিকার প্রয়াণের খবর জানাচ্ছি। প্রেসিডেন্ট, রাজনৈতিক কর্মী, পথপ্রদর্শক এবং নেতা। প্রিয় বন্ধু, আপনাকে আমরা খুব মিস করব।’

বলিভিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট ইভো মোরালেস তাঁর ‘অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞাকে স্মরণ করেন। ব্রাজিল সরকার তাঁকে ‘আমাদের সময়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মানবতাবাদী’ হিসেবে অভিহিত করে শোক প্রকাশ করেছে। স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ বলেছেন, ‘মুজিকা একটি উন্নত বিশ্বের জন্য বেঁচে ছিলেন।’ গুয়াতেমালার বার্নার্ডো আরেভালো তাঁকে ‘নম্রতা এবং মহত্ত্বের উদাহরণ’ হিসেবে তুলে ধরেছেন তাঁর শোকবার্তায়।

মার্কসবাদী-লেনিনবাদী গেরিলা গোষ্ঠী ‘তুপামারোস’ থেকে মূলধারার রাজনীতিতে মুজিকার যাত্রা লাতিন আমেরিকার রাজনীতিতে এক অনন্য দৃষ্টান্ত। তাঁর জনপ্রিয়তার মূলে তাঁর সরল দার্শনিক চিন্তাভাবনা। ১৯৭২-৮৫ সালে উরুগুয়ের স্বৈরশাসনের সময় মুজিকা ১৩ বছর কারাগারে কাটিয়েছেন। এর অর্ধেকেরও বেশি সময় তিনি একটি ছোট্ট সেলে বন্দী ছিলেন। মাসে মাত্র কয়েকবার ব্যায়াম করার জন্য তাঁকে বাইরে বের হতে দেওয়া হতো।

সেই অন্ধকার প্রকোষ্ঠে, যেখানে কোনো বই বা অন্য কোনো সঙ্গ ছিল না, সেই স্মৃতি রোমন্থন করে কমরেড মুজিকা বলেছিলেন, তিনি সেখানে চিন্তা করতে শিখেছিলেন।

মুক্তির পর স্প্যানিশ সংবাদপত্র এল পাইসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কমরেড মুজিকা বলেন, ‘নিজেকে সুস্থ রাখার জন্য আমি আমার পড়া জিনিসগুলো এবং যৌবনে আমার চিন্তাভাবনাগুলো স্মরণ করতে শুরু করি। পরে আমি বিশ্বকে বদলে দেওয়ার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করি এবং আর কিছুই পড়িনি। আমি বিশ্বকে বদলাতে পারিনি, কিন্তু যৌবনে যা পড়েছিলাম, তা আমাকে সাহায্য করেছিল।’

২০০০ সালে সিনেটর হিসেবে রাজনীতিতে প্রবেশের পর উরুগুয়ের প্রথম বামপন্থী প্রেসিডেন্ট তাবারে ভাজকুয়েজের অধীনে পশুপালন মন্ত্রী হন মুজিকা। ২০০৯ সালের নভেম্বরে তিনি ৫৩ শতাংশ ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। উরুগুয়ের সংবিধান অনুযায়ী তাঁর পাঁচ বছরের মেয়াদে তিনি গর্ভপাত, সমকামী বিয়ে এবং গাঁজার ব্যবহার বৈধ করেন।

২০১০-১৫ সালের মেয়াদে মুজিকা তাঁর বেতনের বেশির ভাগ অংশ দাতব্য প্রতিষ্ঠানে দান করে ‘বিশ্বের দরিদ্রতম প্রেসিডেন্ট’ হিসেবে খ্যাতি পান। তিনি স্যান্ডেল পরে সরকারি অনুষ্ঠানে যোগ দিতেন এবং মন্টেভিডিওর উপকণ্ঠে তাঁর ছোট্ট খামারে বসবাস করতেন। বাড়িতে সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ বলতে ছিল ১৯৮৭ সালের একটি ফক্সওয়াগন বিটল গাড়ি।

২০২০ সালে রাজনীতি থেকে অবসর নেওয়ার পরেও তাঁর সেই ‘চাকরা’ বা ক্ষুদ্র খামার বামপন্থী রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক এবং অনুরাগীদের তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছিল। মুজিকা ভোগবাদের সংস্কৃতি এবং এর ফলে পৃথিবীর পরিবেশের যে ক্ষতি হয়েছে, তার কঠোর সমালোচক ছিলেন। তিনি একবার বলেছিলেন, ‘আমরা আত্মঘাতী সমাজ তৈরি করেছি। আপনার কাজ করার সময় আছে, কিন্তু বাঁচার সময় নেই।’

২০২৪ সালের মে মাসে মুজিকার ক্যানসার ধরা পড়ে। মুজিকার স্ত্রী লুসিয়া তোপোলানস্কি বেঁচে আছেন। গেরিলা যোদ্ধা থাকার সময় লুসিয়ার সঙ্গে মুজিকার পরিচয়। এই দম্পতির কোনো সন্তান নেই। মৃত্যুর আগে তিনি সেই খামারে, তাঁর পোষা কুকুরের পাশে সমাহিত হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে গেছেন।

প্রেসিডেন্ট কথাটা শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে বিলাসবহুল জীবন, অর্থ-যশ কিংবা ধরাছোঁয়ার বাইরের একজন মানুষ। কিন্তু হোসে আলবার্তো মুহিকা ছিলেন এসব চিন্তার পুরো উল্টো মেরুর মানুষ। উরুগুয়ের সাবেক প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও তাঁর জীবনযাপন ছিল এতটাই সাধারণ যে তাকে বলা হতো বিশ্বের সবচেয়ে ‘গরীব রাষ্ট্রপতি’।

১৪ মে মারা গেছেন তিনি, রেখে গেছেন এক অনবদ্য আদর্শ—ক্ষমতা ভোগের জন্য নয়, তা হতে পারে সেবার মাধ্যম। রাষ্ট্রপতি থাকাকালেও মুহিকা বাস করতেন তাঁর স্ত্রীর পুরনো একটি খামারবাড়িতে। বিলাসবহুল প্রাসাদ তো দূরের কথা, তাঁর বাড়ির উঠোনেই কুয়া থেকে পানি তুলে আনতেন, কাপড় শুকাতেন দড়িতে। নিরাপত্তার জন্য ছিল মাত্র দুই পুলিশ আর একটি তিন পা-ওয়ালা কুকুর।

মাসে প্রায় বারো হাজার ডলার বেতন পেলেও তার প্রায় ৯০ শতাংশ তিনি দান করে দিতেন। নিজের জন্য রাখতেন মাত্র ৭৭৫ ডলার—একজন গরিব শ্রমিকের মাসিক আয় বরাবর। নিজের পরিচয় দিতেন কৃষক হিসেবে। স্ত্রী ফুল চাষ করতেন, সংসার চলত তাঁর আয়ে। মুহিকার নামে কোনো ব্যাংক একাউন্ট ছিল না। ২০১০ সালে রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন তার সম্পদের পরিমাণ দেখানো হয় মাত্র ১৮০০ ডলার—তাঁর পুরনো ১৯৮৭ সালের ভক্সওয়াগন বিটল গাড়ির মূল্য।

কিন্তু তাঁর জীবনের শুরুটা ছিল খুবই কষ্টের। মাত্র আট বছর বয়সে বাবাকে হারিয়ে পরিবারে দারিদ্র্য নেমে আসে। বাঁচতে গিয়ে তিনি কখনো কাজ করেছেন বেকারিতে, কখনো ফুল বিক্রি করেছেন রাস্তায়। পরে কিউবার বিপ্লব দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে সরকারবিরোধী গেরিলা আন্দোলনে যোগ দেন। অপহরণ, ডাকাতি, এমনকি হত্যার অভিযোগও রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে, জেলেও যেতে হয়েছে তাঁকে।

উরুগুয়েতে গণতন্ত্র ফিরে এলে সাধারণ ক্ষমার আওতায় মুক্তি পান তিনি। এরপর আর অস্ত্র নয়, রাজনীতির পথে হাঁটেন মুহিকা। ২০০৯ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হন। ক্ষমতায় থেকেও কখনোই নিজেকে ক্ষমতার বাইরে তুলে ধরেননি। বরং কৃষিকাজ, সাধারণ পোশাক, আর সাদামাটা জীবন তাকে আরও আপন করে তুলেছিল উরুগুয়ের সাধারণ মানুষের কাছে।

যদিও রাজনৈতিক জীবনে তার সমালোচকও কম ছিল না, কিন্তু যখন তিনি ২০১৫ সালে ক্ষমতা ছাড়েন, তখন দেশজুড়ে একটি কথাই ঘুরে বেড়াত—বিশ্বের সবচেয়ে বিনয়ী মানুষটি আজ বিদায় নিলেন। চলতি বছর মুহিকা জানিয়েছিলেন, তাঁর খাদ্যনালীতে ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়েছে। চিকিৎসা নেবেন না বলেই স্থির করেছিলেন।

হোসে মুহিকা ছিলেন এমন একজন মানুষ, যিনি আমাদের শিখিয়ে গেছেন—ক্ষমতা মানেই বিলাসিতা নয়। রাষ্ট্রপতি হয়ে থেকেও তিনি ছিলেন সাধারণের মতোই একজন। তাঁর বিদায় আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সৎ আর বিনয়ী থাকার শক্তি এখনো পৃথিবীতে মূল্যবান।

সূত্র: https://www.youtube.com/watch?v=Phic2-sRHR8