সিলেট ১২ই জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৮শে আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ১২:২০ পূর্বাহ্ণ, জুলাই ১২, ২০২৫
বাঙালির ইতিহাসে কিছু চরিত্র রয়েছেন, যাঁরা নিজের সুবিধাজনক সমাজপরিসর ত্যাগ করে বেছে নিয়েছেন প্রতিকূলতা, বেছে নিয়েছেন লড়াই। রাজনীতি যখন অধিকাংশের কাছে প্রভাব-প্রতিপত্তি আর অর্থবিত্ত অর্জনের মাধ্যম, তখন কেউ কেউ ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছেন সম্পূর্ণ উল্টো পথে হেঁটে। রাজা আলী ছবদর খান তাঁদেরই একজন—বৃটিশ ভারতে জমিদার পরিবারে জন্ম নিয়েও যিনি হয়েছিলেন মেহনতী মানুষের কণ্ঠস্বর, নিপীড়িতদের বন্ধু।
তিনি জন্মেছিলেন সিলেট বিভাগের একটি ঐতিহ্যবাহী পরিবারে— মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়ার পৃথিমপাশার জমিদারবাড়ি। তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে কলকাতার অভিজাত পরিমণ্ডলে, যেখানে বর্ধমান রাজপরিবারের সদস্যসহ সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে তাঁর ওঠাবসা ছিল। তিনি ছিলেন কলকাতার বিখ্যাত থ্রি-হান্ড্রেড ক্লাবের সদস্য। কিন্তু এই রাজকীয় জীবন, আভিজাত্য আর প্রাচুর্যের ভিতর থেকেও তিনি আকৃষ্ট হয়েছিলেন সাধারণ মানুষের জীবনের দিকে। তাঁর মধ্যে জন্ম নিয়েছিল সংগ্রামের চেতনা, জেগে উঠেছিল সাম্য ও ন্যায়ের প্রশ্ন।
রাজা আলী ছবদর খান রাজনীতিতে যুক্ত হন মাওলানা ভাসানীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে। ভাসানীবাদী রাজনীতি, সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদের বিরোধিতা ছিল তাঁর রাজনৈতিক দর্শনের মূলভিত্তি। জমিদার পরিবারের সন্তান হয়েও তিনি সাধারণ কৃষক, মজুর ও শ্রমজীবী মানুষের পক্ষ নিয়ে রাজনীতিতে সক্রিয় হন। এই পথ সহজ ছিল না, কিন্তু তিনি বুঝতেন—মানুষের পাশে দাঁড়ানো ছাড়া কোনো প্রকৃত রাজনীতির অস্তিত্ব নেই। মাওলানা ভাসানীর সতীর্থ কৃষক নেতা হিসেবে রাজা আলী ছবদর খান নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছিলেন।
১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে রাজা সাহেব এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নেন। নিজের পিতা আলী হায়দার খানের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে জনতার পক্ষের প্রার্থী মুহিবুস সামাদকে সমর্থন করেন। এটি কেবল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছিল না, ছিল আত্মিক ও নৈতিক বিদ্রোহ। পরিবার, ঐতিহ্য, ক্ষমতা সবকিছুর বিরুদ্ধে গিয়ে তিনি জনতার পাশে দাঁড়ান। এই সিদ্ধান্ত তাঁকে ইতিহাসে আলাদা করে পরিচিত করেছে—তিনি শুধু নেতা নন, ছিলেন জনতার রাজা।
ষাটের দশকে পূর্ব পাকিস্তানে কৃষক-শ্রমিক আন্দোলনের সময় রাজা আলী ছবদর খান ছিলেন সামনে থেকে নেতৃত্বদানকারী একজন সংগ্রামী। ১৯৬৩ সালে বালিসিরা কৃষক আন্দোলনের সময় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বিশ হাজার কৃষকের একটি বিশাল মিছিল মৌলভীবাজার অভিমুখে যাত্রা করে, এবং তিনি ছিলেন সেই মিছিলে সাধারণ মানুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। তাঁর নেতৃত্বে চা-শ্রমিক, পাহাড়ি কামলা ও ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন নতুন মাত্রা পায়। তিনি কৃষক আন্দোলনকে শুধু রাজনৈতিক আন্দোলন হিসেবে দেখেননি, দেখেছিলেন সামাজিক ন্যায়ের দাবি হিসেবে।
১৯৬৬ সালে পৃথিমপাশায় কৃষক সম্মেলনের আয়োজন করেন তিনি। পরের বছর কুলাউড়ায় অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক কৃষক সম্মেলনে ছিলেন অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি। তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতা ও জনসম্পৃক্ত নেতৃত্ব সে সময় তাকে গণমানুষের আস্থা অর্জনে সাহায্য করে।
রাজনীতির মাঠে তিনি কখনো আপোষ করেননি। আইয়ুব খানের শাসনামলে যখন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিরোধী প্রার্থী ফাতেমা জিন্নাহর পক্ষে অবস্থান নেন, তখন মৌলভীবাজারে তাঁর দলের অফিস দখল করে বন্ধ করে দেওয়া হয়। প্রশাসনের হুমকিকে অগ্রাহ্য করে তিনি সেই অফিস খুলে দিতে প্রশাসনকে বাধ্য করেন। ১৯৭২ সালে কুলাউড়া স্কুল চৌমুহনীতে ১৪৪ ধারা ভেঙে জনসভা করেন। ১৯৭৪ সালে কুলাউড়া থানার লকআপ থেকে রক্ষীবাহিনীর চোখের সামনে জাসদ কর্মীদের মুক্ত করে আনেন। এ ধরনের দুঃসাহসিক পদক্ষেপ কেবল একজন সাহসী ও আদর্শবান নেতার পক্ষেই সম্ভব।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ভূমিকা ছিল গর্বের। তিনি পরিবারসহ ভারতের ত্রিপুরার কৈলাশহরের গৌড়নগরে অবস্থান নেন এবং সেখান থেকেই সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে যুক্ত হন। তিনি গঠন করেন সামরিক ছাউনি, নেতৃত্ব দেন গেরিলা আক্রমণে। মুড়ইছড়া চা বাগান, ডাকঘরসহ বহু পাকবাহিনীর ঘাঁটিতে সফল হামলা পরিচালনা করেন। একজন পঞ্চাশোর্ধ, বেসামরিক নেতা হয়েও তাঁর নেতৃত্বে ভারতীয় সেনা কর্মকর্তারা পর্যন্ত বিস্মিত হন। মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজা আলী ছবদর খান শুধু গেরিলাদের সংগঠিতই করেননি। মুক্তিযদ্ধের সময়ে তিনি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ব্যাপক কাজ করেছেন। এসময়ে কলকাতায় মুক্তিযোদ্ধা সমন্বয় কমিটির সাথে যুক্ত হয়ে তিনি বামপন্থীদের সংগঠিত করতে অনন্য ভূমিকা পালন করেছেন। এমনকি ফখরুদ্দিন আলী আহমদ, যিনি তখন ভারতের কৃষিমন্ত্রী ছিলেন এবং পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট হন, তাঁকে দিল্লিতে পরিবারসহ থাকার আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু রাজা সাহেব সেই প্রলোভন উপেক্ষা করে যুদ্ধক্ষেত্রে থাকার সিদ্ধান্ত নেন।
স্বাধীনতার পরও রাজা আলী ছবদর খান জনতার রাজনীতি থেকে সরে আসেননি। বরং রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে, রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের পক্ষেই লড়াই করে গেছেন। মাওলানা ভাসানীর ন্যাপ ও কৃষক সমিতির কেন্দ্রীয় সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেছেন আমৃত্যু।
এই প্রেক্ষাপটে আরেকটি নাম বারবার উঠে আসে—সৈয়দ আকমল হোসেন। তিনিও ছিলেন মৌলভীবাজার-কুলাউড়ার এক সাহসী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, যিনি “বিদ্রোহী সৈয়দ” নামে পরিচিত। রাজা আলী ছবদর খান ও বিদ্রোহী সৈয়দ, এ দুজন ছিলেন সময়ের প্রগতিশীল রাজনীতির দুই সাহসী মুখ। তাঁরা রাজনীতিকে দেখতেন মানুষের মুক্তির হাতিয়ার হিসেবে, রাজপথে পায়ের ধুলোয় গড়া এক সংগ্রামী চেতনার অবলম্বন হিসেবে।
আজকের দিনে রাজনীতি হয়ে উঠেছে প্রভাব, অর্থ আর ক্ষমতার খেলা। অথচ রাজা আলী ছবদর খান রাজনীতিকে দেখেছেন দায়িত্ব হিসেবে, আত্মত্যাগ হিসেবে, জনতার পক্ষে দাঁড়ানোর এক অনমনীয় প্রতিজ্ঞা হিসেবে। তাঁর মতো মানুষদের ইতিহাস আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়—রাজনীতি শুধু মঞ্চে বক্তৃতা নয়, এটি মানুষের কান্না ভাগ করে নেওয়ার শপথ।
১৬ জুলাই ২০২৫, (বুধবার) পৃথিমপাশার সুলতান কমপ্লেক্সে বিকেল ৩টায় তাঁর ৫১তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত স্মরণসভা নিছক একটি আনুষ্ঠানিকতা নয়। এটি সময়ের প্রয়োজন—একজন সংগ্রামী মানুষকে স্মরণ করার মাধ্যমে প্রজন্মকে তার আদর্শের সঙ্গে যুক্ত করার আহ্বান।
স্মরণসভা আয়োজন কমিটির পক্ষে মাহমুদুর রহমান চৌধুরী ওয়েছ ও আব্বাছ আলী সবাইকে এ আয়োজনে অংশ নেওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। যারা দেশ-বিদেশে আছেন, যারা রাজনীতি বা সমাজ নিয়ে ভাবেন, তাঁদের উচিত রাজা আলী ছবদর খানের মতো মানুষদের জীবনের দিকে ফিরে তাকানো। কারণ, স্মৃতি ধরে রাখাই সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক কাজ। রাজা আলী ছবদর খানের জীবন এক আলোকবর্তিকা—যে আলো আজকের ক্লান্ত সমাজকে দেখাতে পারে নতুন পথ, দেখাতে পারে সাহসের অর্থ কীভাবে সংগ্রামে পরিণত হয়। তাঁর মতো সংগ্রামীদের জীবনচর্চাই হতে পারে ভবিষ্যতের নতুন বাংলাদেশ গড়ার অন্যতম ভিত।
#
ইব্রাহীম চৌধুরী
লেখক ও সাংবাদিক
#bangladeshi#politicians
সম্পাদক : সৈয়দ আমিরুজ্জামান
ইমেইল : rpnewsbd@gmail.com
মোবাইল +8801716599589
৩১/এফ, তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০।
© RP News 24.com 2013-2020
Design and developed by M-W-D