সিলেট ১৪ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৯শে আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৪:৫২ অপরাহ্ণ, জুলাই ১৬, ২০২৫
চব্বিশের ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের এক বছর পার হতে চলেছে। ছাত্র-জনতার দুর্বার গণজোয়ারে পতন হয়েছিল কর্তৃত্ববাদী, স্বৈরাচারী আওয়ামী শাসনের। শত শহীদের আত্মদান এবং শত শত ছাত্র-শ্রমিক-জনতার আহত হওয়ার মধ্য দিয়ে এই বিজয় অর্জিত হয়েছিল। যারা জীবন দিয়েছেন এবং আহত হয়ে আছেন তার মধ্যে বিরাট অংশ হলো শ্রমজীবী খেটে খাওয়া মানুষ। এই বিজয় ছিল মানুষের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার বিজয়। এই সময় আর যে স্লোগানটি সামনে এসেছিল সেটি হলো ‘বৈষম্যহীনতার’।
দুই,
আমরা বিজয়ের শুরুতেই বলেছিলাম পূর্ণ গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত এই সংগ্রাম অব্যাহত রুখতে হবে। আমাদের সামনে অন্যতম প্রধান কর্তব্য হলো এই বিজয়ের মর্মবস্তুকে রক্ষা ও সংহত করা। গণ-অভ্যুত্থানের পরপর মূল্যায়নে আমরা বলেছিলাম, ওই আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে অন্যান্য শক্তির সঙ্গে দক্ষিণপন্থি প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক শক্তি যুক্ত হয়ে নানা ষড়যন্ত্র করছিল, যা এখনও করছে। লুটপাটকারী, চাঁদাবাজি ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর বদল হলেও সেই লুটপাটতন্ত্রের বিনাশ এখনও হয়নি। আমরা আরও বলেছিলাম, গণ-অভ্যুথানের আকাঙ্ক্ষা ও সম্ভাবনাকে সংহত এবং বাস্তবায়ন করার প্রশ্নে আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী শক্তিগুলো তাদের নিজ নিজ মত ও ভাবনা নিয়ে অগ্রসর হবে, এটাই স্বাভাবিক। একটা সাধারণ লক্ষ্যে আন্দোলন পরিচালিত। হলেও আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী অংশগ্রহণকারী আন্দোলনের সুবিধাভোগীদের মধ্যে নানামাত্রিক দ্বন্দ্ব ছিল এবং এখনও আছে। এটা দিন দিন আরও প্রকাশিত হচ্ছে এবং হবে। এমন অবস্থায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ওপর নির্ভর করে বসে থাকা কোনোমতেই সঠিক হবে না। সঠিক ধারায় প্রকৃত গণসংগ্রামের চাপ অব্যাহত রাখতে না পারলে গণ-অভ্যুথানের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের লক্ষ্যাভিমুখী গতিপথ পাল্টে যেতে পারে।
গণ-অভ্যুত্থানের ধারাকে তার লক্ষ্য অভিমুখে অব্যাহত রাখাটা এই মুহূর্তের একটি অপরিহার্য কর্তব্য হিসেবে গণ্য করতে হবে। এই কর্তব্য পালনের গর্ভেই জন্ম দিতে হবে সমাজ পরিবর্তনের বিপ্লবী প্রক্রিয়া। আমরা আমাদের মূল্যায়নে এটুকু বলেই শেষ করিনি। পথনির্দেশ করে আমরা বলেছিলাম, এই আন্দোলনের সফলতা যেন হাতছাড়া না হয় সে বিষয়ে পার্টিকে সতর্ক থাকতে হবে এবং অন্যান্য বাম গণতান্ত্রিক শক্তিকে সঙ্গে নিয়ে সে বিজয় সংহত করার ভেতর দিয়ে প্রগতি, বৈষম্যের প্রকৃত অবসান ও শোষণমুক্তির লক্ষ্যে একটি বাম প্রগতিশীল দেশপ্রেমিক বিকল্প লক্ষ্যাভিমুখী সরকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে হবে।
তিন.
এই ধারায় প্রায় এক বছর ধরে আমরা আমাদের কর্মকাণ্ড অব্যাহত রেখে চলেছি। এটা নিশ্চয়ই সচেতন মহলের মনে আছে, এক যুগ ধরে আমরা যে কর্তৃত্ববাদী স্বৈরাচারের অবসানের জন্য সংগ্রাম করেছিলাম সেখানে আমাদের উচ্চারিত শ্লোগান ছিল- ‘দুঃশাসন হটাও, ব্যবস্থা বদলাও, বাম গণতান্ত্রিক বিকল্প শক্তি সমাবেশ গড়ে তোলো।’ গণ অভ্যুথানে দুঃশাসক হটলেও দুঃশাসনের অবসান ঘটেনি। ব্যবস্থা বদল তো আরও পরের কথা। দুর্বৃত্তায়িত অর্থনীতির ওপর ভর করে গড়ে উঠেছে দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতি। এই অর্থনীতি ভাঙার কোনো লক্ষণ নেই। শুরুতে অর্থনীতির দুর্বৃত্তায়নের শ্বেতপত্রের জন্য গঠিত কমিটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করলেও তাদের ভাষায়, ‘এটি পড়ে দেখার সময় ক্ষমতাসীনদের কারোর হয়নি।’ না হওয়াটাকে অস্বাভাবিক দেখছি না। ইতোমধ্যে সংস্কারের নামে গঠিত একটি কমিটির ডকুমেন্টে ‘মুক্তবাজার’কে অর্থনৈতিকভাবে স্বীকৃতি দিয়ে এগোনোর কথা বলা হয়েছে। সমাজতন্ত্রকে নাকচ করার কথা বলা হয়েছে। যা এখনও আমাদের সংবিধানে বিদ্যমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও মূলনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। মানুষের জীবনের বিশেষত শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের জীবনের সংকট দূর হয়নি। বরং নানাভাবে অনিশ্চিত জীবনের হিসাব-নিকাশ করেই দিন পার করছেন অনেকে। বেকারত্ব বাড়ছে, কল কারখান্য বন্ধ হচ্ছে। নৃশংস হত্যাকাণ্ড, সহিংসতা, মব সন্ত্রাস চলছেই। বৈষম্যহীনতার কোনো আলোচনা এজেন্ডায় নেই।
চার,
এসবের মধ্যে চলতি ব্যবস্থা বহাল রেখেই কিছু সমস্যা সমাধানের পথ খোঁজার চেষ্টা হচ্ছে।
আমরা পার্টির পক্ষ থেকে পরিষ্কার করে বলেছি, আমাদের সংগ্রাম সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা। এর জন্য চাই সমাজব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন। যেটাকে এখনকার বহুল আলোচিত সংস্কারের সময়ে মৌলিক সংস্কারের কথাও বলা যেতে পারে। এজন্য আমরা বলেছি, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ও রাজনীতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। আমরা জাতীয় স্বাধীনতা- সার্বভৌমত্ব সংহত করার লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করার কথা বলেছি। গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্রের চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতি নিষ্কলুষভাবে বহাল রেখে এবং অসম্পূর্ণতা দূর করে বাহাত্তরের সংবিধানের মূল ভিত্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠার কথা বলেছি। সব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সব ক্ষমতার মালিক জনগণের সার্বভৌমত্ব ও যথাযথ কার্যকর ভূমিকা নিশ্চিত করার জন্য (১) গণতন্ত্র (২) উপযুক্ত বিকেন্দ্রীকরণ (৩) স্বচ্ছতা (৪) জবাবদিহি (৫) জনগণের কার্যকর নিয়ন্ত্রণ ও অংশগ্রহণ- এই নীতিমালার ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রশাসনিক কাঠামো মৌলিকভাবে ঢেলে সাজানো সংগ্রাম আমরা করছি। এজন্য সব স্তরের প্রশাসনিক কাঠামোতে আমরা আমলাতান্ত্রিকতা দূর করা ও রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক কাজকর্মের ওপর সর্বস্তরে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ন্ত্রণ ও প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
পাঁচ,
সাম্প্রতিক সময়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংস্কারের কথাকে সামনে এনে ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। এর মধ্যে শিক্ষা, বৈষম্যহীনতা, কৃষি, শিল্পসহ গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলো আলোচনার মধ্যেই তারা রাখেনি। উল্লেখিত ১১টি সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবের মধ্যে মাত্র পাঁচটি সংস্কার কমিশনের প্রায় হাজারখানেক নানা প্রশ্ন ও বিকল্প ভাবনা থাকলেও এগুলোর মধ্যে মাত্র ১৬৬টি বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্য প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন। এসব বিষয়ে কমিশন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করেছে। সিপিবির সঙ্গেও প্রথম পর্বে দুই দফায় আলোচনা হয়েছে। আমরা মৌলিক সংস্কারের কথা তুলে ধরে, প্রচলিত অবস্থায় ন্যূনতম গণতান্ত্রিক অধিকার সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কারের বিষয় ঐকমত্য পোষণ করেছি। ওই আলোচনায় বিশেষ করে, জনপ্রশাসন, বিচার বিভাগ ও দুর্নীতি দমন বিভাগের সংস্কারের অনেকগুলো প্রস্তাবের সঙ্গে ঐকমত্য পোষণ করেছি। সংবিধান ও নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের আলোচনায় কিছু বিষয়ে আমরা আমাদের সুস্পষ্ট দ্বিমত তুলে ধরেই বলেছি, এসব অনেক আলোচনায় একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক এবং তা আলোচনার টেবিলে আনারও প্রয়োজন নেই। বিশেষত বাংলায় দেশের নামে পরিবর্তন করে কিছু কথা যুক্ত করা, সংবিধানের মূল ভিত্তি চার মূলনীতিকে বিদায় করাসহ শাসনব্যবস্থার নানামুখী পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে, যা আমাদের বিপ্লবী গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের লক্ষ্যের সঙ্গে ঘোরতরভাবে সাংঘর্ষিক।
ছয়,
আমরা এই দৃষ্টিভঙ্গির ওপর ভিত্তি করেই আলোচনাগুলোয় অংশ নিচ্ছি। উল্লেখ্য, অনানুষ্ঠানিকভাবে আলোচনায় জানা গেছে, আগের উল্লিখিত ১৬৬টি প্রস্তাবের মধ্যে ৮৫ থেকে ৮৬টি প্রস্তাবে সব দল ঐকমত্য পোষণ করেছে। এ ছাড়া একেবারেই ঐকমত্য হবে না বিবেচনা করে অনেক প্রস্তাব দ্বিতীয় দফা আলোচনার জন্য বিবেচনা করা হয়নি। দ্বিতীয় ধাপের আলোচনায় গিয়ে আমরা দেখতে পেলাম ১৮-১৯টি বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার জন্য আলোচনা শুরু করলেন। বাকি অনেকগুলো বিষয় আলোচনা হলেও হয়তো ভালো আলোচনার মধ্য দিয়ে আরও বেশ কিছু বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা যাবে। আমরা শুরুতেই এ কথা পরিষ্কারভাবেই বলেছি যে, সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে যেসব বিষয়ে পরিবর্তন আনতে হবে, এই পরিবর্তন আনার দায়িত্ব পালন করবে আগামীতে নির্বাচিত সংসদ। এগুলো আমরা আমাদের পরামর্শ হিসেবে রাখব। আরও দুটি কথা সামনে এসেছে তা হলো জুলাই ঘোষণা ও জুলাই সনদ। জুলাই ঘোষণা নিয়ে এর আগে কিছু আলোচনা হলেও এখনও এটি সুনির্দিষ্ট করে কোনো আলোচনা আমাদের সামনে উত্থাপিত হয়নি। এ ছাড়া জুলাই সনদ নামে কী হবে তা-ও এখনও সুস্পষ্ট নয়।
সাত.
এ কথা আমরা স্পষ্ট করে বলে এসেছি, যারা এই সময় সুযোগ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে খাটো করে এবং মুক্তিযুদ্ধের অর্জনকে বিসর্জন দিয়ে বিশেষ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করতে চাইবেন তার বিরুদ্ধে আমরা অন্যান্য বাম প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তিকে নিয়ে রুখে দাঁড়াব। এ ছাড়া জনজীবনের সমস্যা, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা, স্বার্থ রক্ষায় আমরা রাজপথের সংগ্রাম অব্যাহত রাখব। আমূল সংস্কার করে দ্রুততম সময়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে আমাদের চলমান বক্তব্য অব্যাহত রাখব। দেশের স্বার্থ ও সার্বভৌমত্ববিরোধী যে কোনো কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে আমাদের চলমান সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে। সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রামের বন্দরের লাভজনক নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল বিদেশিদের লিজ, রাখাইনে করিডর, কুয়েতকে সমরাস্ত্র তৈরির কারখানা করতে দেওয়ার অবস্থান থেকে সরে আসতে ও সারা বিশ্বের বিতর্কিত সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থ রক্ষাকারী স্টারলিং-এর সঙ্গে চুক্তি বাতিলের দাবিতে ঢাকা-চট্টগ্রাম রোডমার্চের মধ্য দিয়ে দেশের সচেতন মানুষের কাছে বাম প্রগতিশীলদের সম্পর্কে ইতিবাচক আগ্রহ তৈরি হয়েছে। সেটিকে অব্যাহত রাখতে আমাদের দৃঢ় ভূমিকা দৃশ্যমান করতে হবে।
গণ-অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে আগামী ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থান দিবস পালন এবং এ সময় গণতন্ত্র, বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আমাদের বিকল্প বক্তব্যগুলো তুলে ধরেই আমরা আমাদের কর্মকান্ডকে অগ্রসর করব।
#
রুহিন হোসেন প্রিন্স:
সাধারণ সম্পাদক
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি)
সম্পাদক : সৈয়দ আমিরুজ্জামান
ইমেইল : rpnewsbd@gmail.com
মোবাইল +8801716599589
৩১/এফ, তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০।
© RP News 24.com 2013-2020
Design and developed by ওয়েব নেষ্ট বিডি