সিলেট ১৩ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৮শে আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ১:৪০ পূর্বাহ্ণ, জুলাই ২৬, ২০২৫
বিশেষ প্রতিনিধি | ঢাকা, ২৬ জুলাই ২০২৫ : ‘কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা ও জীবিকায় জলবায়ু অভিযোজন’ এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে অনুষ্ঠিত হচ্ছে অষ্টম ফ্রুগাল ইনোভেশন ফোরাম (ফিফ) ২০২৫।
ব্র্যাকের উদ্যোগে আয়োজিত দুইদিনের এই সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় গ্লোবাল সাউথ বা বিশ্বের এই প্রান্তের বাস্তবতার নিরিখে এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর উদ্ভাবিত সমাধানগুলো নিয়ে বিশদ আলোচনা হয়।
সাভারে ব্র্যাক সিডিএম-এ শুক্র ও শনিবার (২৫ ও ২৬ জুলাই ২০২৫) অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের ২০০ জনেরও বেশি বিশেষজ্ঞ, উদ্যোক্তা, গবেষক এবং উন্নয়নকর্মী অংশ নেন।
অনুষ্ঠানের শুরুতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় নিহতদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
অনুষ্ঠানে উদ্বোধনী বক্তব্য রাখেন ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ্ এবং অনলাইনে যুক্ত হয়ে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জোট ‘ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম’-এর মহাসচিব ও মালদ্বীপের সাবেক প্রেসিডেন্ট মহামান্য মোহাম্মদ নাশিদ।
মূল বক্তব্যে ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম’-এর মহাসচিব মোহাম্মদ নাশিদ বলেন, বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কাঠামো জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর স্বার্থ রক্ষা করছে না, এই কাঠামো জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্যও সহায়ক নয়। উন্নয়নশীল দেশগুলো পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ও টেকসই অবকাঠামো নির্মাণে বিনিয়োগ করতে পারছে না। কারণ ঋণগ্রহণ এখনও তাদের জন্য অনেক বেশি ব্যয়বহুল। অভিযোজনের প্রয়োজনীয়তার তুলনায় অর্থায়ন অত্যন্ত সীমিত। অর্থবহ পরিবর্তনের জন্য যুক্তিসঙ্গত সুলভ অর্থায়নের সুযোগকে একটি জরুরি বৈশ্বিক অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করতে হবে বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন।
আসিফ সালেহ্ বলেন, এই পৃথিবী যেন আগুনে জ্বলছে, পুরো পৃথিবী চূড়ান্ত বিপর্যয়ের মুখোমুখি। বর্তমানে প্রতিবছর জলবায়ুজনিত অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলার। যার প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ছে বিশ্বের এই প্রান্তের মানুষগুলোর ওপর, যাদের পক্ষে এ ধরনের ক্ষতি সামাল দেওয়া খুবই কঠিন।
তিনি বলেন, জলবায়ু অভিযোজন নিয়ে আলোচনাগুলো যেন শুধু আমাদের টিকে থাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে জীবিকা, মানুষের মর্যাদা ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নকেও অন্তর্ভুক্ত করে।
তথ্যউপাত্ত উপস্থাপন করে আসিফ সালেহ্ বলেন, আজও বিশ্বে প্রায় ৭০০ মিলিয়ন মানুষ দৈনিক মাত্র ২ দশমিক ১৫ ডলারেরও কম আয়ে জীবনযাপন করছেন। এদের প্রায় ৯৯ শতাংশই গ্লোবাল সাউথ বা বিশ্বের এই গোলার্ধে বাস করেন। আশঙ্কা করা হচ্ছে, মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর শুকিয়ে আফগানিস্তানের কাবুল হবে প্রথম পানিশূন্য আধুনিক শহর। আর বিশ্বের বর্তমান গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার যদি ২ দশমিক ৭ ডিগ্রিতে পৌঁছায়, তাহলে প্রায় ২০০ কোটি মানুষ প্রাণঘাতী চরম তাপদাহের ঝুঁকিতে পড়বে। এদের প্রায় সকলেই দক্ষিণ গোলার্ধ অঞ্চলের বাসিন্দা।
আসিফ সালেহ্ বলেন, জলবায়ু সংকট আর ভবিষ্যতের কোনো হুমকি নয়; দীর্ঘতর তাপপ্রবাহ, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত এবং তীব্র বন্যা ও খরার কারণে আগামী ২৫ বছরের মধ্যে খাদ্যব্যবস্থায় ব্যাপক বিপর্যয়ের আশংকা রয়েছে। শুধু বাংলাদেশেই নয় বরং বিশ্বের এই প্রান্তজুড়েই এটি ঘটতে পারে। এসব বিবেচনায় রেখেই এবারের ফোরামের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা ও জীবিকায় জলবায়ু অভিযোজন’ — যার মাধ্যমে অংশগ্রহণকারীরা নতুন গবেষণা, উদ্ভাবন এবং প্রযুক্তি নিয়ে আলোচনা ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ের সুযোগ পাবেন। এর পাশাপাশি অর্থবহ পরিবর্তন আনার জন্য বিভিন্ন সেক্টরের মধ্যে এবং আন্তঃদেশীয় অংশীদারিত্ব গড়ে তুলতে পারবেন।
তিনি বলেন, “আমরা ইতিমধ্যেই দেখেছি, উদ্ভাবন যখন বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে জনগোষ্ঠীর মধ্য থেকে এবং মর্যাদার ভিত্তিতে গড়ে ওঠে, তখন তা অনেক কিছুকে সম্ভব হয়।”
দুইদিনব্যাপী এই ফোরামে প্যানেল আলোচনা, ইমপ্যাক্ট টক ও প্রদর্শনীতে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীর বাস্তবতা বিবেচনায় রেখে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার সম্ভাব্য সমাধানগুলো নিয়ে আলোচনা হয়।
অনুষ্ঠানের প্রথম দিন ব্র্যাক ও ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনালের ক্লাইমেট হাব-এর ঊর্ধ্বতন পরিচালক ক্রিস্টিনা চ্যান-এর সঞ্চালনায় ‘ট্রান্সফরমেশনাল অ্যাডাপটেশন ইন এগ্রিকালচার’, ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনাল কেনিয়ার জলবায়ু কর্মসূচির সিনিয়র ম্যানেজার ডিজেফু গ্যাটাচো-এর সঞ্চালনায় ‘নেভিগেটিং আনসার্টেনটি থ্রু ক্লাইমেট ইনফরমেশন সার্ভিসেস’, ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনালের ক্লাইমেট হাব-এর প্রধান অ্যাশলি টুম্বস-এর সঞ্চালনায় ‘ইউজ কেইসেস ফর গভর্নমেন্ট অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি’, ব্র্যাকের সিনিয়র ম্যানেজার কুলদীপ বন্ধু আরিয়াল-এর সঞ্চালনায় ‘ফার্মিং ফর দ্য ফিউচার: প্র্যাকটিকেল ইনোভেশনস ফর স্মলহোল্ডার ফার্মারস’ এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনোয়ারুল আবেদীনের সঞ্চালনায় ‘নেচার বেইজড সল্যুশনস’ শীর্ষক অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়।
স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার আলোকে উদ্ভাবিত, ব্যয় সাশ্রয়ী জলবায়ু অভিযোজন কৌশলগুলো কিভাবে আরো বড় পরিসরে প্রয়োগ করা সম্ভব এই বিষয়গুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়। এ ছাড়া পুনরুৎপাদনশীল কৃষি, প্রকৃতিভিত্তিক সমাধান, জলবায়ু সংক্রান্ত তথ্য সরবরাহ ব্যবস্থা, আর্থিক অন্তর্ভুক্তি ও বাজারজাতকরণের কৌশল উদ্ভাবনের মতো বিষয়গুলোর বাস্তবসম্মত সমাধানের লক্ষ্যে বিশেষজ্ঞ, গবেষক ও উদ্যোক্তারা বিস্তারিত আলোচনা করেন।
এ ছাড়া বিভিন্ন সেশনে জলবায়ু ঝুঁকি বিমা, জলবায়ু সহনশীল বীজ, ডিজিটাল পরামর্শ এবং কৃষিতে অর্থায়নের সুযোগের ক্ষেত্রে সমন্বিত ও প্রেক্ষাপট উপযোগী কৌশল নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়।
ব্র্যাকের ‘ফ্রুগাল ইনোভেশন ফেলোদের’ মধ্যে কেনিয়ার এসথার কিমানি, রুয়ান্ডার ঘিসলেইন ইরাকোজে এবং বাংলাদেশের মুবাসসির তাহমিদের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করে বলা হয়, তাদের উদ্ভাবনগুলো প্রমাণ করেছে কীভাবে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর উদ্ভাবিত সমাধানগুলো কাজে লাগিয়ে সীমিত সম্পদ ব্যবহার করে জলবায়ু সহনশীলতা অর্জন করা সম্ভব।
এছাড়া সাজিদা ফাউন্ডেশন, উইগ্রো (WeGro) ওয়ার্ল্ড ভিশন, ব্র্যাকের জলবায়ু পরিবর্তন কর্মসূচি, পভার্টি এলিভেশন ক্লাস্টার ও সোশ্যাল ইনোবেশন ল্যাব, ফ্রুগাল ইনোভশন ফেলোস, ইনসোরকাউ (InsureCow), আইফার্মার এবং গ্রীন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্স-এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর জলবায়ু সহনশীল কৃষিভিত্তিক উদ্ভাবন প্রদর্শনীতে তুলে ধরা হয়। কীভাবে প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনগুলো প্রান্তিক কৃষকদের অনিশ্চিত আবহাওয়া মোকাবিলা, ফসলের উৎপাদন হ্রাস এবং ফসল উৎপাদন পরবর্তী ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করছে এই বিষয়গুলো এখানে তুলে ধরা হয়।
আজ শনিবার দ্বিতীয় দিন বক্তব্য রাখবেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মাননীয় উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। সমাপনী ভাষণ দেবেন ব্র্যাকের চেয়ারপারসন ড. হোসেন জিল্লুর রহমান।
উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে যাত্রা শুরুর পর থেকে ফ্রুগাল ইনোভেশন ফোরাম (ফিফ) গ্লোবাল সাউথ ভিত্তিক উদ্ভাবন ও সম্ভাব্য সমাধান নিয়ে আলোচনার জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফরম হিসেবে কাজ করছে। এর আগের সম্মেলনগুলোতে ডিজিটাল আর্থিক অন্তর্ভুক্তি থেকে শুরু করে কোভিড পরবর্তী পুনরুদ্ধার নিয়েও আলোচনা হয়। জলবায়ু সংকট বাড়ছে এবং অভিযোজনের জন্য অর্থায়ন কমে আসছে। এই প্রেক্ষাপটে এবারের ফ্রুগাল ইনোভেশন ফোরাম (ফিফ) যে বার্তাটি দিচ্ছে সেটি হলো— কেবলমাত্র জনগনের জন্যই নয়, বরং তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে তৃণমূল পর্যায় থেকেই জলবায়ু সহনশীল ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে হবে।
সম্পাদক : সৈয়দ আমিরুজ্জামান
ইমেইল : rpnewsbd@gmail.com
মোবাইল +8801716599589
৩১/এফ, তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০।
© RP News 24.com 2013-2020
Design and developed by ওয়েব নেষ্ট বিডি