চীনের বিরল প্রজাতির বানর সংরক্ষণে তিন দশকের লড়াই

প্রকাশিত: ৩:০০ অপরাহ্ণ, আগস্ট ২৭, ২০২৫

চীনের বিরল প্রজাতির বানর সংরক্ষণে তিন দশকের লড়াই

Manual7 Ad Code

বিশেষ প্রতিবেদক | হুবেই (চীন), ২৭ আগস্ট ২০২৫ : চীনের হুবেই প্রদেশের শেননোংজিয়া পাহাড়ি অরণ্যে একসময় মানুষের জন্য মাংস ও লোম সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ব্যাপকভাবে বানর শিকার হতো। ১৯৮০-এর দশক পর্যন্ত এই শিকার ও বন নিধন চলতে থাকে। দরিদ্র কৃষকরা টিকে থাকার জন্য ব্যাপক হারে গাছ কেটে ফেলছিল, যার ফলে ধ্বংস হচ্ছিল এ অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য। এর সরাসরি প্রভাব পড়ে বিরল স্বর্ণালি স্নাব-নোজড বানরের উপর।

তাদের সংখ্যা নেমে আসে ৫০০ এর নিচে।
এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতেই ১৯৯১ সালে স্নাতক পাশ করেই নবীন গবেষক ইয়াং জিংইউয়ান কাজ শুরু করেন। তখন তার বয়স মাত্র কুড়ির ঘরে। তিনি স্মরণ করেন, বানরদের আবাসস্থল গাছ নিধনের কারণে ধ্বংস হচ্ছিল, ফলে তাদের সংখ্যা দ্রুত কমছিল।

তবে বর্তমানে পুরো অঞ্চল সংরক্ষিত রয়েছে এবং বানরের সংখ্যা বাড়ছে।
বর্তমানে ৫৫ বছর বয়সী প্রফেসর ইয়াং শেননোংজিয়া ন্যাশনাল পার্ক সায়েন্টিফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক। তিনি তার জীবনের পুরোটা সময় এই বিরল উপ-প্রজাতির স্নাব-নোজড বানরদের রক্ষা ও বোঝার কাজে নিয়োজিত করেছেন। তিনি গবেষকদের নিয়ে বনে গেলেন, যেখানে বানরদের সাথে সরাসরি মেলামেশার সুযোগ পাওয়া যায়।

Manual1 Ad Code

বানরের ভাষা বোঝা
প্রফেসর ইয়াং জানিয়েছেন, তারা এখন বানরের কিছু শব্দের অর্থও বুঝতে পারেন। যেমন, ‘ইয়িইই’ মানে পরিবেশ নিরাপদ, অন্যরা এগিয়ে আসতে পারে। ‘উ-কা’ মানে বিপদ আছে, সতর্ক হও। বানরদের উপস্থিতিতে তিনি বিভিন্ন শব্দ করছিলেন, আর বানররা গাছ থেকে নেমে এসে হাত ধরছিল, ছুঁয়ে দেখছিল। বানরদের জটিল সামাজিক গঠন সম্পর্কেও তিনি জানালেন।

Manual7 Ad Code

একটি পরিবারিক দলে একজন পুরুষ প্রধানের সঙ্গে ৩ থেকে ৫ স্ত্রী ও তাদের সন্তানরা থাকে। কয়েকটি পরিবার মিলে বড় দলে পরিণত হয়, যেখানে সদস্য সংখ্যা শতাধিক হতে পারে। অবিবাহিত পুরুষরা আলাদা দল গড়ে এবং কখনও কখনও পাহারার দায়িত্ব নেয়। স্ত্রী বানররা গোপনে সম্পর্ক গড়ে তোলে, যা দ্বন্দ্ব ও লড়াইয়ের জন্ম দেয়। পুরুষের নিয়ন্ত্রণ বদল বা গোত্রভিত্তিক লড়াইও ঘটে। ৬ বছর বয়সী স্ত্রী বানররা নিজেদের পরিবার ছেড়ে অন্য দলে যোগ দেয়, যাতে আত্মীয়তার মধ্যে প্রজনন এড়ানো যায়। তাদের আয়ু প্রায় ২৪ বছর। মৃত্যুর সময় এলে তারা একা নির্জন স্থানে চলে যায়। এতটাই গোপন হয় সেই স্থান যে বনরক্ষীরা কখনও তাদের মৃতদেহ খুঁজে পায়না।

Manual2 Ad Code

সংরক্ষণের দীর্ঘ লড়াই
বর্তমানে বানররা ৪০০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় স্বাধীনভাবে বসবাস করছে। তবে এ পর্যায়ে আসতে বহু বছর লেগেছে। ১৯৮২ সালে জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করা হলেও স্থানীয় কৃষকরা তখনও গাছ কেটে জীবিকা নির্বাহ করতেন। ৪৯ বছর বয়সী বনরক্ষী ফাং জিক্সি বলেন, ‘মানুষ তখন খুব দরিদ্র ছিল। বন্যপ্রাণী রক্ষার কোনো ধারণাই ছিল না। কাঠ কাটা নিষিদ্ধ হলেও অনেকে গোপনে গাছ ফেলতো বা শিকার করতো। ধীরে ধীরে সচেতনতা তৈরি হয়। পরে আমাদেরকেই রক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।’ কৃষকদের বন ধ্বংসের পরিবর্তে সংরক্ষণ কাজে যুক্ত করাই ছিল বড় পরিবর্তন। বর্তমানে তিনি পাহাড় টহল দেন, শিকারিদের নজরদারি করেন এবং বানরদের অবস্থান খুঁজে বের করেন যাতে গবেষকরা তাদের আচরণ, প্রজনন ও খাদ্যাভ্যাস নিয়ে গবেষণা করতে পারেন।

Manual2 Ad Code

গবেষণা দলের প্রচেষ্টা
২০০৫ সালে প্রফেসর ইয়াং বিশেষজ্ঞ দল গঠন করেন। নির্দিষ্ট বানর দলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে পুরো এক বছর লেগেছিল। তিনি জানান, শুরুর দিকে বানররা আমাদের দেখলেই পালাতো। ধীরে ধীরে ৮০০ মিটার দূরত্ব কমে ৫০০, তারপর ২০০ মিটারে নেমে এলো। অবশেষে তারা আমাদের কাছে আসতে দিল। তখনকার ছবিতে পাহাড়গুলো প্রায় অনাবৃত দেখা গেলেও এখন বনভূমির আচ্ছাদন ৯৬% পর্যন্ত বেড়েছে। ড্রোনে ধারণ করা দৃশ্যে সেই পরিবর্তন স্পষ্ট।

পর্যটন ও নতুন জীবন
এই মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক পরিবেশ পর্যটকদেরও আকর্ষণ করেছে। লাখ লাখ পর্যটক এখানে ভ্রমণ করছেন। তবে বানর সংরক্ষণ এলাকা সাধারণ পর্যটকদের জন্য বন্ধ, সেখানে কেবল অনুমোদিত গবেষক ও কর্মীরা প্রবেশ করতে পারেন। আমরা একটি সুরক্ষিত এলাকায় রয়েছে নজরদারি ক্যামেরা, ট্রান্সমিটার ও কালো ভাল্লুক, বন্য শূকরসহ বিভিন্ন প্রাণী পর্যবেক্ষণের সরঞ্জাম। একটি উপত্যকায় যেখানে একসময় কৃষকরা বসবাস করতেন, এখন তাদের অন্যত্র স্থানান্তর করা হয়েছে। একজন সাবেক কৃষক জানান, তিনি বর্তমান জীবনে খুশি। সরকার থেকে সহায়তা পেয়ে তিনি পরিবারসহ একটি অতিথিশালা চালাচ্ছেন, যা আগের কষ্টকর জীবনের চেয়ে অনেক ভালো।

আশার আলো
তবু এই লড়াই সহজ ছিল না। স্বর্ণালি স্নাব-নোজড বানরের মাদিরা ধীরে প্রজনন করে, প্রতি দুই বছরে মাত্র একটি সন্তান জন্মায়, আবার সব সন্তান টিকে যায় না। তবু ৫০০ থেকে সংখ্যা বেড়ে এখন হয়েছে ১,৬০০। আগামী ১০ বছরে এটি ২,০০০ ছাড়াবে বলে আশা করা হচ্ছে। প্রফেসর ইয়াং আশাবাদী কণ্ঠে বলেন, বানরদের আবাসস্থল এখন নিরাপদ। তাদের খাদ্য ও পানি আছে, জীবনের চিন্তা নেই। সবচেয়ে বড় কথা, তাদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে।
#
সূত্র : বিবিসি

 

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

 


Follow for More!

Manual1 Ad Code
Manual3 Ad Code