কালজয়ী কবি পাবলো নেরুদা : নিপীড়িত মানুষের কবি

প্রকাশিত: ১২:৫২ পূর্বাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২৩, ২০২৫

কালজয়ী কবি পাবলো নেরুদা : নিপীড়িত মানুষের কবি

Manual1 Ad Code

সৈয়দ আমিরুজ্জামান |

মানবসভ্যতার ইতিহাসে এমন কিছু কবি রয়েছেন, যাঁদের রচনা কেবল সাহিত্যিক রুচি পূরণের জন্য নয়, বরং যুগে যুগে নিপীড়িত মানুষের সংগ্রামের অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছে। চিলির কবি ও বিপ্লবী রাজনীতিক পাবলো নেরুদা তাঁদেরই একজন। দুনিয়া কাঁপানো কিংবদন্তি বিপ্লবী চে গুয়েভারা জীবনের শুরুতে তাঁর প্রথম প্রেমিকাকে নেরুদার কবিতা শোনাতেন এবং সারা জীবন এই কবির লেখা সঙ্গে নিয়ে ঘুরেছেন। সিয়েরা মায়েস্ত্রার গেরিলা যুদ্ধের সময় বিকেলবেলায় তিনি সহযোদ্ধাদের কবিতা পড়ে শোনাতেন ক্যান্ত জেনেরাল থেকে। এমনকি মৃত্যুর মুহূর্তে বলিভিয়ায় তাঁর ব্যাকপ্যাকে পাওয়া যাওয়া সবুজ রঙের নোটবুকে নেরুদার কবিতা ছিল সর্বাধিক।

পাবলো নেরুদা কেবল একজন নোবেল বিজয়ী কবি নন, তিনি ছিলেন সংগ্রামী চেতনার কণ্ঠস্বর। নিপীড়িত মানুষের দুঃখ, ক্ষোভ ও স্বপ্নকে তিনি কবিতার পরিশ্রমী শব্দচয়নে রূপ দিয়েছেন। ফলে তাঁর কাব্যকীর্তি বিশ্বসাহিত্যে এক অমর উচ্চতায় অবস্থান করছে।

জন্ম, নাম ও শৈশবের অভিজ্ঞতা

১৯০৪ সালের ১২ জুলাই চিলির পাররাঙ্গল নামের প্রত্যন্ত গ্রামে নেরুদার জন্ম। তাঁর প্রকৃত নাম ছিল নেফতালি রিকার্দো রেয়েস বাসোয়ালতো। মা রোসা বাসোআলতো সন্তান জন্মের এক মাস পরেই মারা যান। রেলকর্মী পিতা হোসে দেল কার্মেন রেইয়েস তাঁকে নিয়ে তেমুকো গ্রামে চলে আসেন। দরিদ্র পরিবারের এই শিশু কাদামাখা রাস্তায় ঠেলাগাড়িওয়ালাদের কষ্ট দেখে বড় হতে থাকেন। শৈশবের সেই করুণ অভিজ্ঞতা পরবর্তীতে কবিতায় রূপ নেয়—
“আমি বাস করছি তেমুকো,
আর আমার ঘরের বাতায়ন পথে
দুচোখ মেলে দেখি আমি কাদা আর কাদা…”

কৈশোরেই তিনি ছদ্মনাম ‘পাবলো নেরুদা’ গ্রহণ করেন। পিতার কঠোর মানসিকতা থেকে লেখালেখি লুকিয়ে রাখাই ছিল এর প্রধান কারণ। ‘নেরুদা’ নামটি নিয়েছিলেন চেক সাহিত্যিক জান নেরুদার কাছ থেকে, আর ‘পাবলো’ সম্ভবত ফরাসি কবি পল ভারলেইন থেকে।

সাহিত্যকর্ম : প্রেম থেকে বিপ্লব

Manual2 Ad Code

নেরুদার সাহিত্যকীর্তি বহুমাত্রিক। তাঁর প্রথম দিককার কাব্যগ্রন্থ টোয়েন্টি পোয়েমস অফ লাভ অ্যান্ড আ সং অফ ডেসপেয়ার প্রেম ও কামনার আবেগে ভরপুর। এই সংকলন তাঁকে তরুণ বয়সেই জনপ্রিয়তা এনে দেয়।

Manual8 Ad Code

তবে সময়ের সাথে সাথে তাঁর কলম হয়ে ওঠে ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের অস্ত্র। স্পেনের গৃহযুদ্ধ তাঁকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। ফ্যাসিস্ট ফ্রাংকোর বিরুদ্ধে স্পেনের সংগ্রামে অংশ নিয়ে তিনি রচনা করেন প্রাণের স্পেন (১৯৩৮)। এই কাব্যগ্রন্থ কেবল সাহিত্য নয়, একেবারে রাজনৈতিক ঘোষণা হয়ে দাঁড়ায়। পরবর্তীতে তাঁর মহাকাব্য ক্যান্ত জেনেরাল লাতিন আমেরিকার বিপ্লবী কণ্ঠস্বর হিসেবে বিশ্বব্যাপী আলোচিত হয়।

তেরো শতাধিক কবিতা রচনা করেছেন নেরুদা, যার মধ্যে প্রেম, প্রকৃতি, ইতিহাস, নিপীড়িত মানুষের সংগ্রাম—সবই সমানভাবে স্থান পেয়েছে। তাঁর কবিতা প্রেমের কোমল স্পর্শে যেমন ভরপুর, তেমনি সেখানে আছে শোষিত শ্রমিকের রক্তাক্ত আর্তনাদ।

কূটনৈতিক জীবন ও রাজনৈতিক সংগ্রাম

মাত্র তেইশ বছর বয়সে তাঁকে রেঙ্গুনে কূটনৈতিক পদে নিয়োগ করা হয়। পরে ভারত, জাপান, চীন, মেক্সিকোসহ নানা দেশে দায়িত্ব পালন করেন। এই ভ্রমণ তাঁকে বিশ্বসাহিত্যের নানা ধারার সঙ্গে পরিচিত করে।

১৯৪৫ সালে তিনি চিলির কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন এবং সিনেটর নির্বাচিত হন। খনি শ্রমিকদের আন্দোলন গড়ে তোলায় তিনি শ্রমিকনেতা হিসেবেও পরিচিত হন। তবে রাষ্ট্রপতি গঞ্জালেস ভিদেলার কমিউনিজমবিরোধী অভিযানে তাঁকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেওয়া হলে তিনি আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যান। মাইহু হ্রদের গিরিপথ পেরিয়ে আর্জেন্টিনায় পালিয়ে যান এবং সেখান থেকেই তাঁর বিখ্যাত কবিতা পলাতক রচিত হয়।

পরবর্তীতে সালভাদর আলেন্দের ঘনিষ্ঠ সহকারী হয়ে ওঠেন তিনি। আলেন্দে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলে নেরুদার রাজনৈতিক মর্যাদা আরও বৃদ্ধি পায়।

নোবেল পুরস্কার ও বিশ্বজনীন স্বীকৃতি

১৯৭১ সালে নেরুদা সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার কারণে বিতর্ক থাকলেও বিশ্বসাহিত্য তাঁকে উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস তাঁকে বর্ণনা করেছিলেন—“বিংশ শতাব্দীর সকল ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি।”

নোবেল বক্তৃতায় নেরুদা বলেন—
“আমরা আমাদের শোণিত ও তমসা দিয়েই তার বুক ভরে তুলি; কবিতা তো লিখতে হয় শোণিত ও তমসা দিয়েই।”

এই উক্তি তাঁর সাহিত্য ও রাজনৈতিক জীবনের মূল দর্শনকেই প্রকাশ করে।

প্রেমের কবিতার রসায়ন

কেরুদাকে অনেকেই কেবল বিপ্লবী কবি বলে জানেন। কিন্তু তিনি একইসঙ্গে অসাধারণ প্রেমের কবিও। নারীর শরীর, প্রেম, অভিলাষ ও বেদনা—সবকিছুকে তিনি নতুন ব্যঞ্জনায় কবিতায় তুলে ধরেছেন।

তাঁর একটি বিখ্যাত কবিতায় তিনি নারীকে পৃথিবীর উর্বর মাটির সঙ্গে তুলনা করেছেন—
“নারীর রমণীয় শরীর, সাদা পাহাড়, শুভ্র উরু…
আমার এ চাষাড়ে দেহ তোমাকে গভীরভাবে কর্ষণ করছে
যাতে মাটির গহন থেকে লাফিয়ে উঠতে পারে শিশু।”

এখানে প্রেম, প্রকৃতি ও জীবনের চিরন্তনতা একাকার হয়ে গেছে।

প্রশ্নপুস্তক : দার্শনিক কাব্যের মহার্ঘ দলিল

নেরুদার পড়ন্ত বয়সের রচনা প্রশ্নপুস্তক কাব্যগ্রন্থটি অনন্য। এই গ্রন্থজুড়ে আছে কেবল প্রশ্ন—জীবন, মৃত্যু, প্রকৃতি ও অস্তিত্ব নিয়ে।

তিনি জিজ্ঞাসা করেছেন—
“আমায় বলো, গোলাপ কি নগ্ন?
নাকি ওইটাই তার একমাত্র পোষাক?”

Manual8 Ad Code

এই প্রশ্ন সৌন্দর্যের দর্শনকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করে। আবার আরেক জায়গায় লিখেছেন—
“যেখানে স্থানের শেষ
সেটাই কি মৃত্যু নাকি অনন্ত?”

এখানে ফুটে উঠেছে মৃত্যুর পরবর্তী অজানাকে ঘিরে তাঁর গভীর চিন্তা।

মৃত্যু ও উত্তরাধিকার

১৯৭৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর সামরিক অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে ক্যান্সারে আক্রান্ত অবস্থায় নেরুদা মারা যান। একনায়ক অগাস্তো পিনোচেট তাঁর অন্ত্যেষ্টিকে জনসমক্ষে করার অনুমতি দেননি। তবুও হাজারো মানুষ কারফিউ ভেঙে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে রাস্তায় নেমে আসে। এই অন্ত্যেষ্টিই চিলির একনায়কতন্ত্রবিরোধী প্রথম গণআন্দোলনে রূপ নেয়।

বিশ্বজনীন প্রাসঙ্গিকতা

নেরুদা প্রেমের কবি, বিপ্লবের কবি, মানবতার কবি—সব পরিচয়েই তিনি সমানভাবে অনন্য। তাঁর কবিতা নিপীড়িত মানুষের কণ্ঠস্বর হয়ে আজও প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।

বাংলাদেশের মতো দেশ, যেখানে বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের স্বপ্ন এখনও অসম্পূর্ণ, সেখানে নেরুদা পাঠ অপরিহার্য। তাঁর প্রশ্নপুস্তক আমাদের শেখায় প্রশ্ন করতে, আর তাঁর বিপ্লবী কবিতা শেখায় প্রতিরোধ গড়তে।

Manual7 Ad Code

উপসংহার

পাবলো নেরুদা শুধু সাহিত্যিক নন; তিনি ছিলেন সময়ের সাক্ষী, সংগ্রামী, বিপ্লবী এবং মানবতার সৈনিক। নিপীড়িত মানুষের যন্ত্রণা, প্রেমের আবেগ, প্রকৃতির সৌন্দর্য—সবকিছু তিনি কবিতার দ্যুতিতে অমর করে রেখেছেন।

আজ তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে আমাদের অঙ্গীকার হোক—সমাজতন্ত্র অভিমুখী অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যহীন ও মানবিক রাষ্ট্র গঠনের। বিশ্বজনীন এই কবির সাহিত্য, জীবন ও সংগ্রাম আমাদের পথ দেখাক।

নোবেল বিজয়ী কবি কমরেড পাবলো নেরুদার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
#

✍️ সৈয়দ আমিরুজ্জামান
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট
বিশেষ প্রতিনিধি, সাপ্তাহিক নতুনকথা ও ইংরেজি দৈনিক দ্য ফিনান্সিয়াল পোস্ট,
সম্পাদক, আরপি নিউজ
কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, জাতীয় কৃষক সমিতি
সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, মৌলভীবাজার জেলা
‘৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের সংগঠক ও সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা, বাংলাদেশ ছাত্রমৈত্রী
সাবেক কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, বাংলাদেশ খেতমজুর ইউনিয়ন
E-mail : syedzaman.62@gmail.com  01716599589

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

 


Follow for More!

Manual1 Ad Code
Manual5 Ad Code