সিলেট ১৩ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৮শে আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ১১:৪৩ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২৫, ২০২৫
বিশ্বে আজ অনেক বেশি ধনীর সংখ্যা বেড়েছে। বিশ্বে শিক্ষিতের সংখ্যাও অনেক বাড়ছে। প্রযুক্তিনির্ভরতাও বেড়েছে অনেক। কিন্তু এই অগ্রগতির জৌলুসের আড়ালে রয়ে গেছে এক অস্বস্তিকর সত্য— শ্রেণি বৈষম্যের পাহাড়। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) তাদের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে জানাচ্ছে, পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার শীর্ষ ১ শতাংশ মানুষের হাতে এখন বিশ্বের ২০ শতাংশ আয় এবং ৩৮ শতাংশ সম্পদ। অর্থাৎ অল্প কিছু মানুষের হাতে বিপুল সম্পদ কেন্দ্রীভূত হচ্ছে, আর নিচের ৫০ শতাংশ জনগোষ্ঠী প্রতিদিন ন্যূনতম জীবনযাপনেও হিমশিম খাচ্ছে।
এ এক ভয়ংকর বৈপরীত্যের ছবি।
বৈষম্যের নতুন পরিসংখ্যান
আইএলওর ‘দ্য স্টেট অব সোশ্যাল জাস্টিস: এ ওয়ার্ক ইন প্রোগ্রেস’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে। এতে বলা হয়েছে, ধনী-গরিবের ব্যবধান কমছে না, বরং স্থবির হয়ে আছে। শীর্ষ ১ শতাংশ মানুষের হাতে আয় ও সম্পদের যে নিয়ন্ত্রণ, তা বিশ্বের অর্ধেক জনগোষ্ঠীর তুলনায় অস্বাভাবিকভাবে বেশি।
অন্যদিকে, অক্সফামের এ বছরের শুরুতে প্রকাশিত আরেক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বিশ্বের ১ শতাংশ মানুষ মোট বৈশ্বিক সম্পদের ৪৫ শতাংশের মালিক। অর্থাৎ মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানেই দুই প্রতিষ্ঠানের তথ্য আমাদের সামনে বৈষম্যের ভয়াবহতা স্পষ্ট করে দিয়েছে।
আয় বাড়ছে, কিন্তু কার হাতে?
১৯৯৫ সালের পর থেকে বৈশ্বিক উৎপাদনশীলতা প্রায় ৭৮ শতাংশ বেড়েছে। উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে এ বৃদ্ধি ২১৫ শতাংশ। অর্থাৎ বিশ্ব আরও বেশি পণ্য ও সেবা তৈরি করছে, আরও বেশি সম্পদ সঞ্চিত হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো—এই বৃদ্ধির সুফল কারা পাচ্ছে?
প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, একদিকে ধনীরা আরও ধনী হচ্ছে, অন্যদিকে প্রায় ৮০০ মিলিয়ন মানুষ এখনো দিনে তিন ডলারের কম আয়ে বেঁচে আছে। যাদের ন্যূনতম ক্যালোরির চাহিদাও পূরণ হয় না। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পানি—এই মৌলিক চাহিদাগুলো থেকে কোটি কোটি মানুষ বঞ্চিত।
লিঙ্গ বৈষম্য: ধীরগতির অগ্রগতি
অর্থনৈতিক বৈষম্যের পাশাপাশি লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যও স্পষ্টভাবে বিদ্যমান। ২০২৫ সালে একজন পুরুষের প্রতি ১ ডলারের বিপরীতে নারী আয় করেছেন মাত্র ৭৮ সেন্ট। আইএলওর আশঙ্কা, এ ধারা অব্যাহত থাকলে লিঙ্গভিত্তিক মজুরি বৈষম্য ঘুচতে সময় লাগবে আরও ৫০ থেকে ১০০ বছর। বিশেষত নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে এ ব্যবধান কমতে প্রায় এক শতক লেগে যেতে পারে।
এ বাস্তবতা কেবল আয় বৈষম্যের বিষয় নয়, বরং সামাজিক মর্যাদা, শিক্ষা, কর্মক্ষেত্রে সুযোগ—সব কিছুর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। নারী-পুরুষের সমতা অর্জনকে যেখানে টেকসই উন্নয়নের অন্যতম শর্ত ধরা হয়, সেখানে এই ধীরগতি বৈশ্বিক অগ্রযাত্রার বড় অন্তরায় হয়ে উঠছে।
শিশুশ্রম: হার কমলেও সমস্যা রয়ে গেছে
শিশুশ্রমের হার অবশ্য গত তিন দশকে উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। ১৯৯৫ সালে ৫–১৪ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে ২০.৬ শতাংশ শ্রমে নিয়োজিত থাকলেও ২০২৪ সালে তা নেমে এসেছে ৭.৮ শতাংশে। কিন্তু সংখ্যার হিসাবে এখনো প্রায় ১০.৬ কোটি শিশু শ্রমে নিয়োজিত। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেকই বিপজ্জনক কাজে জড়িত, যা তাদের শিক্ষা ও শৈশবকে কেড়ে নিচ্ছে।
অতএব, শুধু হার কমেছে বলেই নিশ্চিন্ত হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, একেকটি শিশুর বঞ্চনা মানে একেকটি সমাজের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার ক্ষতি।
ইতিবাচক দিকগুলো কী?
প্রতিবেদনে যদিও বৈষম্যের ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে, তবু সবকিছুই হতাশার নয়। আইএলও জানিয়েছে—
বৈশ্বিক চরম দারিদ্র্যের হার ১৯৯৫ সালের ৩৯ শতাংশ থেকে ২০২৩ সালে নেমে এসেছে মাত্র ১০ শতাংশে।
কর্মরত দারিদ্র্যের হার ২০০০ সালের ২৭.৯ শতাংশ থেকে ২০২৪ সালে দাঁড়িয়েছে ৬.৯ শতাংশে।
বিশ্বব্যাপী প্রাথমিক, নিম্ন মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষাসমাপ্তির হার যথাক্রমে ১০, ১৭ ও ২২ শতাংশ পয়েন্ট বেড়েছে।
সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় এখন বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ এসেছে, যদিও এখনও প্রায় ৫০ শতাংশ এর বাইরে।
অর্থাৎ অগ্রগতি ঘটেছে, তবে তা সবার জন্য সমানভাবে নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি।
বৈষম্যের প্রভাব: শুধু অর্থনৈতিক নয়
প্রশ্ন হতে পারে, ধনী হলে ক্ষতি কী? কেউ বেশি আয় করলে অন্যের সমস্যা কোথায়? এর উত্তর লুকিয়ে আছে বৈষম্যের বিস্তৃত প্রভাবে।
অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়তে থাকলে—
১. সামাজিক অস্থিরতা বাড়ে: ধনী-গরিবের ব্যবধান অসন্তোষ সৃষ্টি করে, যা সংঘাত ও সহিংসতার ঝুঁকি বাড়ায়।
২. অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি টেকসই থাকে না: যখন অর্ধেক জনগণ ন্যূনতম ভোগক্ষমতাই রাখে না, তখন সামগ্রিক বাজার সংকুচিত হয়।
৩. মানবসম্পদ উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়: শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানে বৈষম্য মানে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে ওঠে না।
৪. রাজনৈতিক প্রভাব বাড়ে ধনীদের হাতে: সম্পদ কেন্দ্রীভূত হলে নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় ধনীদের প্রভাব বাড়ে, ফলে সাধারণ মানুষের স্বার্থ উপেক্ষিত হয়।
অতএব, বৈষম্য কেবল নৈতিক বা সামাজিক সমস্যা নয়, বরং অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্যও হুমকি।
ভবিষ্যতের ঝুঁকি
আইএলওর মহাপরিচালক গিলবার্ট এফ হুংবো একেবারেই স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, সামাজিক ন্যায়বিচার কেবল নৈতিক দায়িত্ব নয়, বরং অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, সামাজিক সংহতি ও শান্তির অপরিহার্য শর্ত।
প্রতিবেদন সতর্ক করেছে, যদি এখনই কার্যকর নীতি গ্রহণ না করা হয়, তবে আসন্ন পরিবেশগত সংকট, প্রযুক্তিগত রূপান্তর এবং জনমিতি পরিবর্তনের ফলে বৈষম্য আরও গভীর হবে। যেমন—ডিজিটাল বিভাজন প্রযুক্তির সুফল কিছু মানুষের হাতে সীমাবদ্ধ রাখবে; জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি সবচেয়ে বেশি ভোগ করবে দরিদ্র জনগোষ্ঠী।
করণীয়
বৈষম্য কমানো সহজ কাজ নয়। তবে অসম্ভবও নয়। নীতি পর্যায়ে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি—
আয় ও সম্পদের ন্যায্য বণ্টন: প্রগতিশীল করনীতি ও সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি জোরদার করা।
শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি: দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে মানসম্পন্ন সেবা নিশ্চিত করা।
নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানো: সমান মজুরি, মাতৃত্বকালীন সুবিধা ও কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে নারীর জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করা।
শিশুশ্রম নিরসন: পরিবারগুলোর জন্য সামাজিক নিরাপত্তা জোরদার করা, যাতে তারা শিশুদের কাজের জায়গায় পাঠিয়ে না দিয়ে স্কুলে পাঠায়।
আন্তর্জাতিক সহযোগিতা: বৈশ্বিক বৈষম্য কমাতে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে ন্যায্য বাণিজ্যনীতি ও অর্থনৈতিক সহায়তা জরুরি।
উপসংহার
বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যতই হোক না কেন, যদি তা কেবল কিছু মানুষের হাতে সীমাবদ্ধ থাকে তবে সমাজের বৃহত্তর অংশ উপকৃত হবে না। বৈষম্য কেবল সংখ্যার খেলা নয়, এটি সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদার প্রশ্ন।
আইএলওর প্রতিবেদন আমাদের মনে করিয়ে দিল, এখনই পদক্ষেপ না নিলে ভবিষ্যতের বিশ্ব আরও বিভক্ত, আরও অস্থির হয়ে উঠবে। বৈষম্যের এই দেয়াল ভাঙতে হলে বিদ্যমান শোষণমূলক আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তন দরকার। দরকার জনগণের মৌলিক মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় সুশাসন নিশ্চিত করা। আর সেটি করতে হলে পৃথিবীর দেশে দেশে আমাদের বৈষম্যহীন ব্যবস্থা চালু করতে হবে। দরকার সমান সুযোগ, ন্যায়সঙ্গত বণ্টন এবং সবার জন্য মর্যাদাপূর্ণ জীবনের নিশ্চয়তা।
#
সৈয়দ আমিরুজ্জামান
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট;
বিশেষ প্রতিনিধি, ইংরেজি দৈনিক দ্য ফিনান্সিয়াল পোস্ট ও সাপ্তাহিক নতুনকথা;
সম্পাদক, আরপি নিউজ;
কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, জাতীয় কৃষক সমিতি;
‘৯০-এর মহান গণঅভ্যুত্থানের সংগঠক ও সাবেক কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, বাংলাদেশ ছাত্রমৈত্রী।
সাবেক কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, বাংলাদেশ খেতমজুর ইউনিয়ন।
সাধারণ সম্পাদক, মাগুরছড়ার গ্যাস সম্পদ ও পরিবেশ ধ্বংসের ক্ষতিপূরণ আদায় জাতীয় কমিটি।
প্রাক্তন সভাপতি, বাংলাদেশ আইন ছাত্র ফেডারেশন।
E-mail : syedzaman.62@gmail.com
WhatsApp : 01716599589
মুঠোফোন: ০১৭১৬৫৯৯৫৮৯
Bikash number : +8801716599589 (personal)
সম্পাদক : সৈয়দ আমিরুজ্জামান
ইমেইল : rpnewsbd@gmail.com
মোবাইল +8801716599589
৩১/এফ, তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০।
© RP News 24.com 2013-2020
Design and developed by ওয়েব নেষ্ট বিডি