মুফতীয়ে আজম আল্লামা রহমানপুরী (রহ.) : এক মহান আলোকবর্তিকার জীবন ও শিক্ষাধারা

প্রকাশিত: ৯:৩৮ পূর্বাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২৭, ২০২৫

মুফতীয়ে আজম আল্লামা রহমানপুরী (রহ.) : এক মহান আলোকবর্তিকার জীবন ও শিক্ষাধারা

Manual4 Ad Code

শাহজাদা সৈয়দ রায়হান শাহ |

বাংলার আধ্যাত্মিক ভুবনে পাক পাঞ্জাতন, আহলে বায়েত নির্দেশিত ইসলামের জ্যোতি ছড়িয়ে যাওয়া মহাপুরুষদের মধ্যে মুফতীয়ে আজম, মুর্শীদে বরহক, মোফাক্কেরে ইসলাম, ইমামে আহলে সুন্নাত, মুজাদ্দেদে জামান, সাবহে সাইয়ারা, আল্লামা গাজী সাইয়্যেদুনা মোহাম্মদ আবু তাহের রহমানপুরী (রহ.) আউলিয়া এক অনন্য নাম। তিনি ছিলেন বর্তমান শতাব্দীর তরীকত জগতের অন্যতম পথিকৃৎ, প্রথিতযশা ইসলামী চিন্তাবিদ, পৃথিবী বিখ্যাত ধর্মীয় নেতা, পাক পাঞ্জাতন আহলে বায়েতের প্রবক্তা ও দার্শনিক। তিনি শুধু একজন আধ্যাত্মিক সাধক নন, বরং ছিলেন ইসলামী জ্ঞানচর্চার এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানী, সত্যিকার অর্থে উম্মাহর চিন্তাশীল নেতা এবং মানবকল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ পথিকৃৎ।

প্রতি বছর তাঁর ওরুশ মোবারক উপলক্ষে দেশ-বিদেশ থেকে হাজারো ভক্ত-অনুরাগী, ওলামায়ে কেরাম ও তরীকতের সাধক-সাধিকারা সমবেত হন হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার আশাতলা গ্রামের তাঁর পবিত্র মাজার শরীফে। ২০২৫ সালের ৯ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত হয় আল্লাহ ও তাঁর হাবিবে পাক (দঃ)-এর সান্নিধ্য ও নৈকট্য লাভের তাঁর ১৩তম পবিত্র ওরুশ মোবারক।

জন্ম ও পারিবারিক পটভূমি

১৯২২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি, বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে ফজরের নামাজের পূর্ব মুহূর্তে কুমিল্লা জেলার দ. শিলমুড়ী ইউনিয়নের রহমানপুর দরবার শরীফের মহীয়ান পরিবারে তাঁর জন্ম। তিনি ছিলেন আধ্যাত্মিক জগতের মহাপুরুষ জিন্দাপীর শাহ সুফী গাজী লালমিয়া শাহ দরবেশ (রহ.)-এর যোগ্য উত্তরসূরি। পিতৃসূত্রে প্রাপ্ত ঐশী দীক্ষা ও মাতৃকোলের দোয়া তাঁকে শৈশব থেকেই ধর্মীয় জ্ঞান, আধ্যাত্মিকতা ও নৈতিকতার দিকে আকৃষ্ট করে।

শিক্ষাজীবন ও জ্ঞানচর্চা

ছোটবেলা থেকেই তাঁর মেধা ও প্রতিভা বিশেষভাবে প্রকাশ পেতে থাকে। তিনি ইসলামি জ্ঞান অর্জনের জন্য বিভিন্ন মাদ্রাসায় অধ্যয়ন করেন। সর্বোচ্চ পর্যায়ে তিনি যান বিশ্বের প্রাচীনতম ও শ্রেষ্ঠ ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্র মিশরের জামেউল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে।

১৯৫১ সালে তিনি সেখান থেকে ফেকাহ শাস্ত্রে বিশেষ কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। শুধু তাই নয়, তাঁকে “সাবহে সাইয়ারা” উপাধিতে ভূষিত করা হয় এবং “মুফতীয়ে আজম” হিসেবে সনদ ও স্বর্ণপদক প্রদান করা হয়। এই অর্জন তাঁর পরবর্তী জীবনের সব কাজের ভিত্তি স্থাপন করে।

শিক্ষকতা ও সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড

ষাটের দশকের অধিকাংশ সময় তিনি বিভিন্ন মাদ্রাসা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যাপনা করেছেন। আরবি, ফার্সি ও উর্দু ভাষা বিষয়ে তিনি ছিলেন এক অনন্য শিক্ষক। তিনি ভারতের হায়দ্রাবাদের প্রখ্যাত প্রতিষ্ঠান মাদ্রাসায়ে নিজামিয়া-তে “মোহাদ্দিসে আজম” এর দায়িত্ব পালন করেন।

শুধু শিক্ষকতা নয়, তিনি ছিলেন এক দক্ষ সংগঠক ও ইসলামী আন্দোলনের অগ্রদূত। ইসলামি সংস্কৃতি, আধ্যাত্মিক জীবন ও মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের জন্য তিনি নিরলস পরিশ্রম করেছেন।

আন্তর্জাতিক খ্যাতি ও সফর

তাঁর খ্যাতি শুধু উপমহাদেশে সীমাবদ্ধ ছিল না। ইসলামী শিক্ষা ও ছবকদানের উদ্দেশ্যে তিনি মক্কা, মদিনা, ইরাক, ইরান, মিশর, আরব আমিরাত, কুয়েত, আজমীর শরীফ, পাকিস্তান, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রসহ বহু দেশে সফর করেছেন।

১৯৮৯ সালে যুক্তরাজ্যের বার্মিংহামে অনুষ্ঠিত “ইমাম আহমদ রেজা আন্তর্জাতিক ইসলামী কনফারেন্স”-এ বাংলাদেশ থেকে চিফ গেস্ট হিসেবে যোগ দেন। সেখানে তিনি আন্তর্জাতিক ফেকাহ সম্রাট ও ইসলামী চিন্তাবিদ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন। পরবর্তীতেও যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন ইসলামী কনফারেন্সে তিনি সম্মানিত অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত হয়ে উম্মাহকে দিকনির্দেশনা প্রদান করেছেন।

মহান মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা

বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। দেশমাতৃকার স্বাধীনতার জন্য তাঁর অবদান তাঁকে শুধু আধ্যাত্মিক নেতা নয়, বরং জাতির বীর সন্তান হিসেবে ইতিহাসে প্রতিষ্ঠিত করেছে। স্বাধীনতার পরও তিনি সমাজে ন্যায়, সাম্য ও প্রকৃত দ্বীন ইসলামী তথা আহলে বায়েতের আদর্শ প্রতিষ্ঠায় আজীবন কাজ করেছেন।

Manual3 Ad Code

সাহিত্যকীর্তি

Manual6 Ad Code

আল্লামা রহমানপুরী (রহ.) শুধু বক্তা বা শিক্ষক ছিলেন না; তিনি ছিলেন এক উর্বর কলমের অধিকারী। তাঁর রচিত অসংখ্য গ্রন্থ ইসলামী ফেকাহ, আধ্যাত্মিকতা ও চিন্তাচর্চায় দিকনির্দেশক হিসেবে বিবেচিত। তাঁর গ্রন্থাবলি আজও মাদ্রাসা ও গবেষকদের জন্য মূল্যবান সম্পদ।

Manual2 Ad Code

আধ্যাত্মিক সাধনা ও দরবার শরীফ

তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থে মুর্শীদে বরহক। অসংখ্য মুরিদ তাঁর হাত ধরে আত্মশুদ্ধি ও আধ্যাত্মিক উন্নতি লাভ করেছেন। রহমানপুর দরবার শরীফ ও পরবর্তীতে আশাতলায় মাজার শরীফ হয়ে ওঠে অসংখ্য মানুষের আধ্যাত্মিক আশ্রয়স্থল।

আল্লাহ ও তাঁর হাবিবে পাক (দঃ)-এর সান্নিধ্য এবং নৈকট্য লাভে

Manual2 Ad Code

দুনিয়ার সফর সমাপ্ত করে আল্লাহ ও তাঁর হাবিবে পাক (দঃ)-এর সান্নিধ্য ও নৈকট্য লাভে আমাদের মাঝ থেকে বিদায় নিয়েছিলেন তিনি। দীর্ঘ সাধনাময় জীবনের শেষে ২০১২ সালের ৯ সেপ্টেম্বর শ্রীমঙ্গলের কলেজ রোডস্থ নিজ বাসভবনে তিনি পর্দা করেন। দুনিয়া থেকে বিদায়কালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯০ বছর। বর্তমানে তিনি হবিগঞ্জ জেলার বাহুবল উপজেলার আশাতলার পবিত্র মাজার শরীফে শায়িত আছেন।

উত্তরাধিকার ও প্রভাব

আজও তাঁর শিক্ষা, আদর্শ ও ত্যাগ নতুন প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করে। তাঁর জীবনদর্শন আমাদের শিখায়—ইসলামী জ্ঞানার্জন, আধ্যাত্মিক সাধনা, মানবসেবা ও জাতীয় দায়িত্ব একে অপরের পরিপূরক।

উপসংহার

আল্লামা গাজী সাইয়্যেদুনা মোহাম্মদ আবু তাহের রহমানপুরী (রহ.) ছিলেন একাধারে আধ্যাত্মিক সাধক ও ওলি-আউলিয়া, আলিমে দ্বীন, মুক্তিযোদ্ধা, মহান দার্শনিক ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইসলামী চিন্তাবিদ। তাঁর যাপিতজীবন, শিক্ষা-ছবক, কর্মযজ্ঞ ও সাধনা আমাদের জন্য দিকনির্দেশক।

৯ সেপ্টেম্বর তাঁর পবিত্র ওরুশ মোবারক শুধু স্মরণ নয়, বরং শিক্ষা গ্রহণেরও সুযোগ। আজকের তরুণ প্রজন্ম যদি তাঁর জীবনাদর্শকে ধারণ করে, তবে সমাজে ন্যায়, সাম্য, শান্তি ও ইসলামী মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা সহজ হবে।

 

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

 


Follow for More!

Manual1 Ad Code
Manual2 Ad Code