অনাক্রম্যতার শান্তিদূত: ২০২৫ সালের চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেলজয়ের গল্প

প্রকাশিত: ৯:১৩ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ৬, ২০২৫

অনাক্রম্যতার শান্তিদূত: ২০২৫ সালের চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেলজয়ের গল্প

Manual8 Ad Code

পঞ্চানন মণ্ডল |

একটি ক্ষুদ্র ভুলই কখনও কখনও মহাবিপর্যয়ের কারণ হয়। যেমন ধরুন – কোনো সেনাবাহিনী যদি নিজের সৈন্যদের শত্রু ভেবে আক্রমণ শুরু করে, তাহলে ফল কী হবে? ধ্বংস।
ঠিক তেমনই ভয়ানক বিপর্যয় ঘটে আমাদের শরীরেও, যখন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা—যাকে আমরা ইমিউন সিস্টেম বা অনাক্রম্যতা তন্ত্র বলি—নিজের কোষকেই শত্রু ভেবে আক্রমণ শুরু করে। এরই নাম অটোইমিউন রোগ।

টাইপ-১ ডায়াবেটিস, লুপাস, রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস, ক্রোন’স ডিজিজ—এইসব ভয়ংকর রোগের মূলে রয়েছে শরীরের নিজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা।
কিন্তু আশ্চর্য বিষয় হলো—বেশিরভাগ মানুষের শরীরে এই যুদ্ধ হয় না। কেন?
কারণ, আমাদের ভেতরে কিছু “শান্তিদূত” আছে, যারা ইমিউন সিস্টেমকে শৃঙ্খলায় রাখে।

২০২৫ সালের নোবেল পুরস্কার সেই শান্তিদূতদের গল্পই বলেছে—

Manual6 Ad Code

গল্প, তিন বিজ্ঞানীর আবিষ্কারের; গল্প, মানবদেহের আত্মরক্ষার অন্তর্গত সামঞ্জস্যের।

তিন বিজ্ঞানী, এক আবিষ্কার
এ বছরের নোবেল পেয়েছেন তিনজন বিজ্ঞানী—
Mary E. Brunkow ও Fred Ramsdell (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র), এবং Shimon Sakaguchi (জাপান)।

Manual6 Ad Code

তিনজনই ভিন্ন পথে কাজ করলেও, তাঁদের গবেষণার সুতো গিয়েছিল এক জায়গায়— আমাদের শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ‘অভ্যন্তরীণ ব্রেক সিস্টেম’ কীভাবে কাজ করে, সেই রহস্য উন্মোচন করা।

Manual4 Ad Code

Brunkow, Institute for Systems Biology-এর গবেষক, শিশুদের এক বিরল রোগ (IPEX syndrome) নিয়ে কাজ করতে গিয়ে খুঁজে পেলেন FOXP3 নামের এক জিন।

Ramsdell, Sonoma Biotherapeutics-এর বিজ্ঞানী, প্রমাণ করলেন—এই জিনের ত্রুটিতেই শরীর নিজের কোষকে আক্রমণ করে ফেলে।

আর Sakaguchi, Osaka University-এর অধ্যাপক, ১৯৯৫ সালেই আবিষ্কার করেছিলেন regulatory T cell (Treg) নামের এক বিশেষ ধরনের কোষ, যা অন্য ইমিউন কোষদের অতিসক্রিয়তা থামিয়ে দেয়।

তিনজনের আবিষ্কারের যোগসূত্র- FOXP3 হলো সেই জিন যা Treg কোষ তৈরি করে, আর Treg-ই হলো শরীরের শান্তিদূত।

যেমন ট্রেনের ব্রেক কাজ না করলে দুর্ঘটনা ঘটে, তেমনি FOXP3-এর ত্রুটিতে ইমিউন সিস্টেমের ব্রেক কাজ করে না—ফল, নিজের শরীরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ!

আমাদের ইমিউন সিস্টেম আসলে এক জটিল যান্ত্রিক জগৎ— এখানে কিছু কোষ সৈনিক, কিছু গোয়েন্দা, কেউ কমান্ডার, কেউবা ডাক্তার!

এই বিশাল বাহিনী প্রতিনিয়ত ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া বা ক্যান্সার কোষের সঙ্গে যুদ্ধ করছে।
কিন্তু যুদ্ধের মধ্যেও দরকার শান্তিরক্ষা বাহিনী—যারা অকারণে যুদ্ধ থামাতে পারে, সামঞ্জস্য রক্ষা করতে পারে।
এই শান্তিরক্ষাকারী বাহিনীই Regulatory T cell (Treg)।

তারা অন্য ইমিউন কোশদের বলে—’এটা নিজের শরীরের অংশ, একে আক্রমণ করো না।’
এদের না থাকলে শরীর পাগল হয়ে যায়—নিজের চামড়া, পেশি, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ—সবকিছুকে শত্রু ভাবতে শুরু করে।

Treg কোষগুলো মূলত FOXP3 জিনের নির্দেশে গড়ে ওঠে।
এই জিনটি এক ধরনের ‘ট্রান্সক্রিপশন ফ্যাক্টর’, যা ডিএনএ থেকে প্রোটিন তৈরির সময় একাধিক ইমিউন জিনকে নিয়ন্ত্রণ করে।
এ যেন পুরো প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে বসানো এক স্মার্ট কন্ট্রোল প্যানেল।

এই আবিষ্কার চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে এক অনন্য মাইলফলক।
কারণ এটি প্রথম দেখাল—ইমিউন সিস্টেম শুধু ‘লড়াই’ জানে না, ‘সহনশীলতা’ও জানে।
এবং এই সহনশীলতাই (immune tolerance) জীবনধারণের পূর্বশর্ত।

এই গবেষণার ফলাফল ইতিমধ্যেই এখন নানা ক্ষেত্রে প্রয়োগ হচ্ছে:

১। অটোইমিউন রোগের চিকিৎসায় – Treg কোষ সক্রিয় করে রোগ থামানোর প্রচেষ্টা চলছে।
২। ক্যান্সার থেরাপিতে – কিছু টিউমার Treg-কে কাজে লাগিয়ে প্রতিরোধ থেকে বাঁচে; এখন নতুন ওষুধ তৈরি হচ্ছে সেই ব্রেক খুলে দেওয়ার জন্য।
৩। অঙ্গ প্রতিস্থাপনে – নতুন অঙ্গকে শরীর যাতে প্রত্যাখ্যান না করে, তার জন্য Treg-ভিত্তিক থেরাপি এক আশার আলো হয়ে উঠেছে।
৪।এলার্জি ও প্রদাহজনিত রোগে – Treg কোষ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ (chronic inflammation) কমানোর চেষ্টা চলছে।
অর্থাৎ, তাদের আবিষ্কার শুধু একটি জিন বা কোষের নয়, বরং আমাদের শরীরের “স্ব-সহনশীলতার দর্শন” ব্যাখ্যা করেছে।

আজ চিকিৎসা গবেষণার বহু প্রতিষ্ঠান Treg-এর ওপর নির্ভর করে নতুন থেরাপি তৈরি করছে।
জিন থেরাপি, কোষ থেরাপি, এমনকি কৃত্রিম ইমিউন মডেল—সবখানেই FOXP3-এর নাম আলোচিত।

আমাদের শরীরের ভেতর কোটি কোটি যুদ্ধ চললেও, শেষ পর্যন্ত জীবন টিকে থাকে শান্তির ওপর, সহনশীলতার উপর।
আর সেই শান্তিরক্ষাকারী সৈন্যরা—regulatory T cell—আজ নোবেল পুরস্কারের আলোয় মহিমান্বিত।
#

লেখক
পঞ্চানন মণ্ডল
৬ অক্টোবর ২০২৫

Manual5 Ad Code

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

 


Follow for More!

Manual1 Ad Code
Manual7 Ad Code