ভাষা আন্দোলন প্রেরণার প্রতীক: মূখ্য ভূমিকায় অনন্য কমরেড আব্দুল মতিন

প্রকাশিত: ৩:০৭ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ৮, ২০২৫

ভাষা আন্দোলন প্রেরণার প্রতীক: মূখ্য ভূমিকায় অনন্য কমরেড আব্দুল মতিন

Manual4 Ad Code

সৈয়দ আমিরুজ্জামান |

“ওরা আমার মুখের ভাষা কাইরা নিতে চায়…”
গীতিকার ও সুরকার আবদুল লতিফের অমর এই গানটি যেন বাঙালি জাতির মর্মবাণী হয়ে আছে। যে আন্দোলনের স্রোতে এই গান জন্ম নিয়েছিল, সেই ভাষা আন্দোলন আমাদের প্রেরণার অন্যতম প্রতীক। আর এ আন্দোলনের মূখ্য ভূমিকায় অনন্য নেতৃত্ব ছিলেন কমরেড আব্দুল মতিন— আমাদের সবার প্রিয় ভাষা মতিন। আজ ৮ অক্টোবর ২০২৫, তাঁর একাদশ মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁকে স্মরণ করা মানে ভাষা আন্দোলনের অবিনাশী চেতনা ও সমাজ পরিবর্তনের আদর্শকে স্মরণ করা।

প্রথম প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর

১৯৪৮ সালের ২৪ মার্চ—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করলেন: “উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।” মুহূর্তেই সভা কেঁপে উঠেছিল “নো, নো!” ধ্বনিতে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সেই প্রতিবাদের প্রথম কণ্ঠস্বর ছিল তরুণ ছাত্র আবদুল মতিনের।
এই উচ্চারণ কেবল একটি শব্দ নয়—তা ছিল বাঙালি জাতির স্বকীয়তা, সংস্কৃতি ও ভাষাগত পরিচয়ের প্রথম সম্মিলিত উচ্চারণ ও প্রতিবাদ।

এর পরের চার বছর—১৯৪৮ থেকে ১৯৫২—ছিল এই প্রতিবাদের ধারাবাহিক প্রস্তুতির সময়। ভাষা আন্দোলন সংগঠিত রাখার মূল ভূমিকা ছিল যিনি পালন করেছিলেন, তিনিই আবদুল মতিন। তাঁর নিরলস নেতৃত্ব ও সাংগঠনিক দক্ষতায় ছাত্রসমাজ ঐক্যবদ্ধ হয়, তৈরি হয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ, আর ঢাকাসহ সারা দেশে জেগে ওঠে ভাষা-অধিকার আন্দোলনের ঢেউ।

১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত ও ইতিহাসের মোড়

১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সরকার ঢাকা শহরে সভা-মিছিল নিষিদ্ধ করে ১৪৪ ধারা জারি করে। ছাত্রনেতারা তখন দ্বিধায়—আইন অমান্য করা হবে কি না।
এই সংকটময় মুহূর্তে দৃঢ় অবস্থান নেন মতিন। তিনি যুক্তি দেন, “রাষ্ট্রভাষা বাংলার প্রশ্নে আপস নয়—প্রয়োজনে আমরা রক্ত দেব, তবু বাংলার দাবিতে পিছু হটব না।”
২০ ফেব্রুয়ারির রাতের বৈঠকে সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা ‘১৪৪ ধারা না ভাঙা’র পক্ষে মত দেন, কিন্তু আবদুল মতিনের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদ সিদ্ধান্ত নেয়—১৪৪ ধারা ভাঙতেই হবে।
এই সাহসী অবস্থানই ২১ ফেব্রুয়ারির ভোরে ইতিহাস সৃষ্টি করে। মতিনের জ্বালাময়ী ভাষণেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় ছাত্র-জনতার সভায় ১৪৪ ধারা ভাঙার প্রস্তাব গৃহীত হয়, যার পরিণতিতে গড়ে ওঠে বিশ্বের ইতিহাসে প্রথম ভাষার জন্য প্রাণবলি দানের মহাকাব্য।

‘ভাষা মতিন’: এক নাম, এক ইতিহাস

Manual6 Ad Code

১৯৫২ সালের আগেই ছাত্রদের মধ্যে ‘ভাষা মতিন’ নামটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তাঁর নেতৃত্বের জন্যই তাঁকে দেওয়া হয় এই উপাধি, যা পরবর্তীতে হয়ে ওঠে তাঁর পরিচয়ের মূল প্রতীক।
ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস রচনাকারী বদরুদ্দীন উমর, বশির আল হেলাল, এম আর আখতার মুকুল, কে জি মুস্তফা প্রমুখ ইতিহাসবিদরাও তাঁকে “ভাষা মতিন” নামেই উল্লেখ করেছেন।
বাংলা ভাষা ও জাতিসত্তার প্রশ্নে তাঁর অদম্য নিষ্ঠা তাঁকে জাতির অন্তরে স্থায়ী আসন দিয়েছে।

শৈশব ও শিক্ষাজীবন: গেদু থেকে মতিন

Manual8 Ad Code

১৯২৬ সালের ৩ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জের চৌহালি উপজেলার ধুবুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আবদুল মতিন। তাঁর পিতা আবদুল জলিল ছিলেন কৃষক, মা আমেনা খাতুন ছিলেন গৃহিণী। ছোটবেলায় সবাই তাঁকে ডাকতেন “গেদু” নামে।
১৯৩০ সালে যমুনার ভাঙনে বাড়ি হারিয়ে পরিবার চলে যায় ভারতের দার্জিলিংয়ে। সেখানে মহারাণী বালিকা বিদ্যালয়ে তাঁর শিক্ষা শুরু।
শৈশবেই মা’কে হারান মাত্র আট বছর বয়সে। সেই শোকের মধ্য দিয়েও তিনি দৃঢ়তা হারাননি। পরবর্তীতে দার্জিলিং গভর্নমেন্ট হাই স্কুল থেকে ১৯৪৩ সালে মাধ্যমিক পাস করেন।
১৯৪৫ সালে রাজশাহী গভর্নমেন্ট কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট ও পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন।
এই শিক্ষাজীবনই তাঁকে যুক্তিবাদী, পরিশ্রমী ও চিন্তাশীল নেতা হিসেবে গড়ে তোলে।

ছাত্রনেতা থেকে বিপ্লবী কমরেড

ভাষা আন্দোলনের পর আবদুল মতিন ছাত্র ইউনিয়ন গঠনে প্রধান ভূমিকা পালন করেন এবং সংগঠনটির সভাপতি হন।
এরপর তিনি সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন কমিউনিস্ট আন্দোলনে। ১৯৫৪ সালে পাবনা জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক নির্বাচিত হন। মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাপ গঠিত হলে ১৯৫৭ সালে তাতে যোগ দেন।
১৯৬৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল)-এর মধ্যে আলাউদ্দিন আহমদের সঙ্গে মিলে এক উপদল গঠন করেন এবং পরে দেবেন শিকদার, নুরুল হক চৌধুরীদের সহায়তায় পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন।

তাঁর রাজনৈতিক জীবন ছিল চিরবিপ্লবী—সাম্যবাদ, অসাম্প্রদায়িকতা ও শোষণমুক্ত সমাজের স্বপ্নে তিনি আমৃত্যু নিবেদিত ছিলেন।
১৯৯২ সালে বাংলাদেশের ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ ও ওয়ার্কার্স পার্টির ঐক্যের পর তিনি ওয়ার্কার্স পার্টির কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা হন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সেই দায়িত্ব পালন করেন।

মুক্তিযুদ্ধ ও পরবর্তী সময়

পাবনা ও সিরাজগঞ্জ অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর নেতৃত্বে অনেক কমরেড ও ছাত্রসমাজ সংগঠিত হয়েছিল। টিপু বিশ্বাস, আলাউদ্দিন আহমদসহ তাঁর সহযোদ্ধারা সম্মুখযুদ্ধে সাহসিকতার পরিচয় দেন।
মতিন ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের নেপথ্যের অন্যতম সংগঠক—বাঙালি মুক্তিকামী চেতনার ধারক ও বাহক।

সাহিত্য, চিন্তা ও দর্শন

ভাষা মতিন কেবল রাজনীতিবিদ নন, ছিলেন এক চিন্তাশীল লেখক। সমাজ-অর্থনীতি, মুক্তিযুদ্ধ, আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও ইতিহাস নিয়ে তাঁর লেখা বইগুলো আজও প্রাসঙ্গিক।
তাঁর রচিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য—
ইউরোপের দেশে দেশে (১৯৬০), কাস্তে (১৯৮৭), স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রবাসী বাঙালি (১৯৮৯), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব: কয়েকটি প্রাসঙ্গিক বিষয় (১৯৯৩), রোমের উত্থান ও পতন (১৯৯৫), ভলতেয়ার: একটি অনন্য জীবনকাহিনি (২০০২), কামাল আতাতুর্ক: আধুনিক তুরস্কের জনক (২০০৩), বিজয় দিবসের পর: বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ (২০০৯) প্রভৃতি।
তাঁর লেখায় যেমন আছে যুক্তির দৃঢ়তা, তেমনি আছে এক বুদ্ধিজীবী বিপ্লবীর বিশ্লেষণধর্মী দৃষ্টিভঙ্গি।

Manual6 Ad Code

একজন মানবতাবাদী: মৃত্যুর পরও দান

জীবনের মতো মৃত্যুতেও ছিলেন উদার ও মানবিক। মৃত্যুর আগেই তিনি নিজের দেহ ও চোখ চিকিৎসা বিজ্ঞানের কাজে দান করেন।
২০১৪ সালের ৮ অক্টোবর, সকাল ৯টায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর জীবনাবসান ঘটে।
মৃত্যুর পর তাঁর দেহটি শিক্ষা ও গবেষণার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজে দান করা হয়—যা ভাষা সৈনিকদের মধ্যে একটি বিরল দৃষ্টান্ত।

সম্মাননা ও স্বীকৃতি

কমরেড আবদুল মতিন পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য—

একুশে পদক (২০০১)

বাংলা একাডেমি ফেলোশিপ (২০০১)

শেরে বাংলা জাতীয় পুরস্কার (২০০৪)

Manual4 Ad Code

ডক্টর অব ল’জ (সম্মানসূচক ডিগ্রি), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (২০০৮)

মহাত্মা গান্ধী পিস অ্যাওয়ার্ড, ভাসানী স্মৃতি পুরস্কার, একুশে টিভি আজীবন সম্মাননা, প্রভৃতি।

তাঁর প্রতি এই সম্মাননা কেবল একজন ব্যক্তিকে নয়, পুরো ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে শ্রদ্ধা জানানো।

ভাষা আন্দোলনের উত্তরাধিকার

ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতিসত্তার ভিত্তি স্থাপন করেছে। মাতৃভাষার জন্য আত্মদান শুধু ভাষার প্রশ্ন নয়—তা ছিল স্বাধীনতা, স্বকীয়তা ও আত্মমর্যাদার প্রশ্ন।
এই আন্দোলনের সূতিকাগারে ছিলেন যে মানুষটি, তিনি ছিলেন আবদুল মতিন। তাঁর নেতৃত্ব ও সংগ্রাম না থাকলে হয়তো ২১ ফেব্রুয়ারির ইতিহাস অন্যরকম হতো।
তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল—“ভাষার স্বাধীনতা ছাড়া কোনো জাতি স্বাধীন নয়।” এই দর্শনই পরবর্তীতে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের বীজ বপন করে।

সমাজতান্ত্রিক মানবতার স্বপ্ন

কমরেড আবদুল মতিন বিশ্বাস করতেন, ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত লক্ষ্য শুধু ভাষার স্বীকৃতি নয়, বরং এমন এক সমাজব্যবস্থা যেখানে সব মানুষ সমান মর্যাদা ও অধিকার পায়।
তিনি লিখেছিলেন—
“যে দেশে ভাষার জন্য মানুষ জীবন দিতে পারে, সে দেশ দারিদ্র্য ও বৈষম্যের কাছে মাথা নোয়াবে কেন?”
তাঁর এই সমাজতান্ত্রিক দর্শন আজও বাংলাদেশের প্রাসঙ্গিক রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতায় অনুপ্রেরণার উৎস।

উপসংহার: এক অনন্য জীবন, এক অবিনাশী আদর্শ

কমরেড আবদুল মতিনের জীবন কেবল এক ব্যক্তির কাহিনি নয়, এটি বাঙালি জাতির চেতনার ইতিহাস।
তিনি যেমন ছিলেন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মূখ্য নেতা, তেমনি ছিলেন শোষণমুক্ত সমাজের স্বপ্নদ্রষ্টা।
ভাষা মতিন আজ কেবল ইতিহাসের পাতায় নয়—তিনি রয়েছেন প্রতিটি সচেতন নাগরিকের হৃদয়ে, প্রতিটি তরুণের প্রতিবাদের প্রেরণায়, প্রতিটি ভাষার উচ্চারণে।

আজ তাঁর একাদশ মৃত্যুবার্ষিকীতে আমাদের প্রত্যয় হোক—
যে আদর্শে তিনি জীবন উৎসর্গ করেছেন, সে আদর্শেই গড়ে উঠুক বৈষম্যহীন, গণতান্ত্রিক ও মানবিক বাংলাদেশ।

ভাষা সৈনিক কমরেড আবদুল মতিনের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও চিরস্মরণ।

লেখক:
সৈয়দ আমিরুজ্জামান
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট
বিশেষ প্রতিনিধি, সাপ্তাহিক নতুনকথা
সম্পাদক, আরপি নিউজ
কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, জাতীয় কৃষক সমিতি
E-mail: syedzaman.62@gmail.com
মুঠোফোন: ০১৭১৬৫৯৯৫৮৯

 

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

 


Follow for More!

Manual1 Ad Code
Manual7 Ad Code