সিলেট ১৩ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৮শে আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ১১:৪০ পূর্বাহ্ণ, অক্টোবর ১২, ২০২৫
মেহেদী হাসান রাসেল, বিশেষ প্রতিনিধি | আজমির শরীফ (ভারত) থেকে ফিরে : উপমহাদেশের আধ্যাত্মিক শহর আজমিরে প্রবেশের মুহূর্তেই চোখে পড়ে এক বিশাল জলরাশি—মানবসৃষ্ট অথচ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর সেই হ্রদের নাম ‘আনা সাগর’। রাজস্থানের শুষ্ক টিলাময় ভূমির বুকে এ যেন এক সজীব নীল মরুদ্যান। কাশ্মীরের ডাল লেক যেমন উত্তরের রূপময় প্রতীক, তেমনি আজমিরের প্রাণ এই আনা সাগর।
প্রাচীন ঐতিহ্যের নিদর্শন
রাজস্থানের রাজধানী জয়পুর থেকে আজমিরের পথে যত এগোনো যায়, ততই চোখে পড়ে ইতিহাসের সাক্ষী স্থাপনা ও নিদর্শন। শহরের কেন্দ্র থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার দূরে অবস্থিত আনা সাগর—একই সঙ্গে ইতিহাস, প্রকৃতি ও আধ্যাত্মিকতার মিলনভূমি।
দ্বাদশ শতাব্দীতে রাজপুত শাসক মহারাজা পৃথ্বিরাজ চৌহানের (শাসনকাল: ১১৩৫–১১৫০ খ্রি.) বংশের কেউ এই হ্রদ নির্মাণ করেন। তারাঘুর পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত লেকটি মূলত লুনী নদীতে বাঁধ তৈরি করে গড়ে তোলা হয় অভ্যন্তরীণ পানির যোগান নিশ্চিত করতে। প্রায় ১৩ কিলোমিটার বিস্তৃত এই হ্রদের গড় গভীরতা ৪.৪ মিটার, আর পানির ধারণক্ষমতা প্রায় ৫০ লাখ কিউবিক মিটার। শত শত বছর আগে তৈরি এই হ্রদ আজও টিকে আছে সতেজ রূপে।
প্রকৃতির কোলে আনা সাগর
বিকেলের নরম আলোয় দরগা শরীফ থেকে আনা সাগরের পথে গেলে দেখা যায়, হ্রদের চারপাশ সাজানো বাহারি ফুল, ছায়াময় গাছপালা, ওয়াকওয়ে ও বিশ্রামবেঞ্চে পরিপূর্ণ। হ্রদের জলে প্রতিফলিত হয় উত্তর ভারতের খটখটে নীল আকাশ—দৃষ্টিনন্দন এক চিত্রকল্প। মুক্তভাবে ভেসে বেড়ানো হাঁস ও মাছের জলকেলি যেন মন ছুঁয়ে যায়।
দর্শনার্থীদের মতে, শহরের কোলাহল থেকে কিছুটা সময়ের জন্য মুক্তি পেতে আনা সাগরই সবচেয়ে প্রিয় আশ্রয়। সকালে কিংবা বিকেলে পরিবার-পরিজন নিয়ে এখানে ঘুরতে আসেন হাজারো মানুষ। ছুটির দিনে লেকের চারপাশে উৎসবের আবহ সৃষ্টি হয়। জোৎস্না রাতে লেকের জলে আজমির শহরের আলোকচ্ছটায় যে সৌন্দর্যের জন্ম হয়, তা বর্ণনাতীত।
মুঘল ঐতিহ্যের ছোঁয়া
আনা সাগর শুধু প্রকৃতির সৌন্দর্যেই নয়, ইতিহাসের বুকে মুঘল ঐতিহ্যের সাক্ষীও বটে। সম্রাট জাহাঙ্গির এখানেই নির্মাণ করেন ‘দৌলতবাগ’ নামে একটি সুসজ্জিত উদ্যান, আর শাহজাহান ১৬৩৭ সালে লেকের তীরে মর্মর পাথরে তৈরি করেন পাঁচটি শ্বেতপাথরের প্যাভিলিয়ন। এই স্থাপনাগুলো আজও মুঘল স্থাপত্যকলার অনন্য নিদর্শন হিসেবে পর্যটকদের আকর্ষণ করে।
লেকের একপাশে পাহাড়চূড়ায় ব্রিটিশ আমলে নির্মিত সার্কিট হাউসও আজ দর্শনীয় স্থান হিসেবে পরিচিত। বাগান, ভাস্কর্য ও স্থাপত্যের সমন্বয়ে পুরো এলাকাটি যেন জীবন্ত ইতিহাসের পটচিত্র।
ব্যবস্থাপনায় প্রশংসনীয় উদ্যোগ
বহু প্রাচীন হলেও আনা সাগরের পানি এখনও স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন। স্থানীয় প্রশাসনের কঠোর নজরদারি ও সচেতন ব্যবস্থাপনার কারণেই এই পরিচ্ছন্নতা টিকে আছে। হ্রদে যাতে বর্জ্য বা নোংরা পানি না পড়ে, সে জন্য নির্মাণ করা হয়েছে আটটি নিষ্কাশন ড্রেন। রাজস্থানের উষর আবহাওয়ায় এমন একটি হ্রদকে টিকিয়ে রাখা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় উদ্যোগ।
আধ্যাত্মিক কিংবদন্তির রেশ
আনা সাগরের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক আধ্যাত্মিক কিংবদন্তি। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ইসলাম ধর্মপ্রচারক ও চিশতিয়া তরিকার প্রতিষ্ঠাতা হযরত খাজা মঈনউদ্দিন চিশতি (রহ.) আজমিরে আগমন করেন। কথিত আছে, স্থানীয়রা প্রথমে তাঁকে হ্রদের পানি ব্যবহার করতে নিষেধ করেন। তিনি কেবল এক পেয়ালা পানি চেয়ে নেন—এবং পরদিন অলৌকিকভাবে হ্রদের সব পানি শুকিয়ে যায়। এতে স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়, পরে তাঁরা ক্ষমা প্রার্থনা করলে খাজা সাহেব (রহ.) দোয়া করে সেই পেয়ালা পানিই হ্রদে ঢেলে দেন, আর আল্লাহর কৃপায় হ্রদ পুনরায় পূর্ণ হয়ে যায়।
তখন থেকেই আনা সাগরকে বলা হয় ‘খাজা সাহেবের কেরামতের হ্রদ’। আজও স্থানীয়দের বিশ্বাস—এই হ্রদের পানি কখনও সম্পূর্ণ শুকায় না। শত শত বছর পেরিয়েও এই বিশ্বাস জীবন্ত রয়েছে আজমিরবাসীর হৃদয়ে।
শেষকথা
আজমিরের আনা সাগর শুধু একটি লেক নয়—এ যেন ইতিহাস, ঐতিহ্য ও আধ্যাত্মিকতার এক মেলবন্ধন। রাজপুত স্থাপত্য, মুঘল ঐতিহ্য, ব্রিটিশ নিদর্শন এবং খাজা মঈনউদ্দিন চিশতি (রহ.)-এর কেরামতের গল্প—সব মিলিয়ে আনা সাগর আজও উপমহাদেশের আধ্যাত্মিক রাজধানী আজমিরের হৃদয়ে অমলিন স্মৃতি হয়ে আছে।
সম্পাদক : সৈয়দ আমিরুজ্জামান
ইমেইল : rpnewsbd@gmail.com
মোবাইল +8801716599589
৩১/এফ, তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০।
© RP News 24.com 2013-2020
Design and developed by ওয়েব নেষ্ট বিডি