সিলেট ১৩ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৮শে আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ২:৪১ পূর্বাহ্ণ, অক্টোবর ১২, ২০২৫
ভূমিকা
বাংলা সাহিত্য ইতিহাসে যাঁদের নাম উচ্চারণ করা মানেই নারীজাগরণ, মানবতাবাদ ও সমাজসংস্কারের সুরধ্বনি শোনা যায়— তাঁদের মধ্যে অন্যতম কবি কামিনী রায়। তিনি কেবল একজন নারী কবিই নন, ছিলেন চিন্তাবিদ, শিক্ষিকা, সমাজকর্মী এবং বাংলার প্রথম স্নাতক ডিগ্রিধারী মহিলা। তাঁর কবিতায় যে আত্মপ্রত্যয়, মানবপ্রেম ও প্রগতিমুখী সমাজ চেতনা প্রকাশিত হয়েছে, তা আজও অনুপ্রেরণার উৎস। কামিনী রায় ছিলেন এমন এক যুগের সন্তান, যখন নারীশিক্ষা ছিল বিরল, সমাজে নারী ছিল সীমাবদ্ধ গৃহপরিসরে। সেই সময়েই তিনি কলম তুলে নিয়েছিলেন নারী-মুক্তির, মানব-মুক্তির এবং সমাজ-জাগরণের পক্ষে।
১৮৬৪ সালের ১২ অক্টোবর, ব্রিটিশ ভারতের বরিশাল জেলার বাসণ্ডা গ্রামে জন্ম নেওয়া এই প্রতিভা তাঁর সময়কে অতিক্রম করে এক আলোকবর্তিকা হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর বিখ্যাত কবিতা—
“সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে”—
শুধু একটি কাব্যপঙক্তিই নয়; এটি এক সামাজিক দর্শন, এক মানবতাবাদী জীবনবোধের প্রতীক।
শিক্ষাজীবন ও সমাজচেতনা
কামিনী রায়ের জীবনের প্রথম অধ্যায়ই নারীশিক্ষার ইতিহাসে এক মাইলফলক। তিনি বেথুন ফিমেল স্কুল থেকে ১৮৮০ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং বেথুন কলেজ থেকে ১৮৮৬ সালে সংস্কৃতে অনার্সসহ বিএ পাস করেন। এই অর্জন তাঁকে ব্রিটিশ ভারতের প্রথম নারী স্নাতক হিসেবে ইতিহাসে স্থান দেয়।
শিক্ষাজীবনেই কামিনী রায় উপলব্ধি করেন, শিক্ষা কেবল ব্যক্তিগত উন্নতির উপায় নয়— এটি সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার। তাঁর রচনায় বারবার ফিরে আসে নারীশিক্ষার গুরুত্ব ও আত্মসম্মানের বোধ। “বালিকা শিক্ষার আদর্শ” গ্রন্থে তিনি বলেন— “শিক্ষা মানে কেবল বই জানা নয়, নিজের মর্যাদা ও দায়িত্ববোধ জাগ্রত করা।”
তিনি শিক্ষকতা শুরু করেন বেথুন কলেজেই; অধ্যাপিকা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন দীর্ঘকাল। শিক্ষকতা ছিল তাঁর কাছে এক মহান ব্রত— নারীসমাজকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলা।
সাহিত্যজীবনের সূচনা ও বিকাশ
মাত্র আট বছর বয়সেই কামিনী রায় কবিতা লেখা শুরু করেন। প্রথম দিকে তিনি লিখতেন ‘জনৈক বঙ্গমহিলা’ ছদ্মনামে— কারণ সমাজে তখনো নারীর সাহিত্যচর্চা স্বাভাবিক ছিল না। ১৮৮৯ সালে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ “আলো ও ছায়া” প্রকাশিত হয়। বইটির ভূমিকাটি লিখেছিলেন প্রখ্যাত কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। এই গ্রন্থেই ফুটে ওঠে তাঁর মানসিক জগৎ— জীবনের দ্বন্দ্ব, বেদনা, আলোক-অন্ধকারের সমান্তরাল চলাচল।
এরপর ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়— নির্মাল্য (১৮৯১), পৌরাণিকী (১৮৯৭), গুঞ্জন (১৯০৫), মাল্য ও নির্মাল্য (১৯১৩), অশোকসঙ্গীত (১৯১৪), অম্বা (১৯১৫), দীপ ও ধূপ (১৯২৯), জীবনপথে (১৯৩০) প্রভৃতি। প্রতিটি রচনাতেই একদিকে কাব্যিক সৌন্দর্য, অন্যদিকে সামাজিক সচেতনতার তীব্র প্রতিফলন দেখা যায়।
কবিতার বিষয়বস্তু ও নন্দনচেতনা
কামিনী রায়ের কবিতা মূলত অন্তর্মুখী, ধ্যানমগ্ন এবং মানবিক বোধে ভরপুর। তিনি জীবনকে দেখেছেন এক চিরন্তন সংগ্রাম হিসেবে, যেখানে আলো ও অন্ধকার পাশাপাশি থাকে। তাঁর কাব্যে বারবার ফিরে আসে— আশা-নিরাশা, হর্ষ-বিষাদ, প্রেম-বিরহ, শোক-বেদনা ও আত্মমুক্তির আকুতি।
“পাছে লোকে কিছু বলে” কবিতাটি তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। সমাজের নারীরা যে ভয় ও লজ্জার বেষ্টনীতে নিজেদের প্রতিভা লুকিয়ে রাখে— সেই মানসিক দুর্বলতাকে তিনি গভীর বেদনাবোধে প্রকাশ করেছেন। তিনি লিখেছেন—
“করিতে পারি না কাজ, সদা ভয় সদা লাজ,
সংশয়ে সংকল্প সদা টলে, পাছে লোকে কিছু বলে।”
এই কবিতা আজও বাঙালি নারীর আত্ম-সচেতনতার প্রতীক। কামিনী রায়ের কণ্ঠে নারী প্রথমবারের মতো আত্মপ্রত্যয়ের ভাষা পেয়েছিল।
নারীবাদী দর্শন ও সমাজভাবনা
কামিনী রায় ছিলেন বাংলার প্রথম দিককার নারীবাদী চিন্তক। তাঁর কাছে নারীবাদ মানে ছিল মানবতাবাদেরই একটি সম্প্রসারিত রূপ। তিনি বিশ্বাস করতেন— সমাজে পুরুষ-নারীর সমতা প্রতিষ্ঠা না হলে কোনো জাতি প্রকৃত অর্থে অগ্রসর হতে পারে না।
‘বালিকা শিক্ষার আদর্শ’ গ্রন্থে তিনি নারীশিক্ষার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন মানবিক গুণাবলির বিকাশ হিসেবে। ‘ঠাকুরমার চিঠি’ বইতে শিশুশিক্ষার মাধ্যমে নারীকে সমাজের নৈতিক দিশারি হিসেবে দেখেছেন।
তাঁর চিন্তায় নারীর স্বাধীনতা মানে ছিল না পুরুষবিরোধিতা; বরং ছিল সমঅধিকার, আত্মমর্যাদা ও নৈতিক নেতৃত্বের দাবি।
১৯২২–২৩ সালে তিনি নারীশ্রমিক তদন্ত কমিশনের সদস্য ছিলেন। সেখানে নারী শ্রমের পরিবেশ ও ন্যায্য মজুরির পক্ষে তিনি শক্ত কণ্ঠে কথা বলেন। এভাবেই কবি কামিনী রায় কলম ও কর্ম— দুই ক্ষেত্রেই নারীসমাজের মুক্তির পথপ্রদর্শক হয়ে ওঠেন।
রবীন্দ্রনাথের প্রভাব ও আত্মনির্মাণ
কামিনী রায়ের কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রভাব অনস্বীকার্য। তবে তাঁর কাব্যচিন্তা শুধু রবীন্দ্রনাথের অনুসরণ নয়— বরং নারীমানসের গভীর আত্মপ্রকাশ। তিনি সংস্কৃত সাহিত্য ও পুরাণ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নারীচরিত্রকে নতুন আলোয় দেখেছেন। ‘অম্বা’ নাটকে মহাভারতের অম্বাকে তিনি নারী প্রতিবাদের প্রতীক হিসেবে পুনর্গঠন করেছেন।
তাঁর ‘অশোকসঙ্গীত’ ও ‘জীবনপথে’ গ্রন্থে দেখা যায় আত্মচিন্তা ও দার্শনিক ভাবনার গভীরতা। মৃত্যুচিন্তা, জীবনের ক্ষয়, আত্মার মুক্তি— এসব বিষয় তিনি কাব্যিকভাবে প্রকাশ করেছেন।
স্বামীবিয়োগ ও সাহিত্যজীবনের নতুন দিগন্ত
১৮৯৪ সালে কামিনী রায় বিবাহ করেন স্ট্যাটিউটরি সিভিলিয়ান কেদারনাথ রায়কে। কেদারনাথ ছিলেন তাঁর সাহিত্যভক্ত ও সমর্থক। কিন্তু ১৯০৯ সালে স্বামীর অকালমৃত্যু কামিনী রায়ের জীবনে গভীর দুঃখের ছায়া ফেলে। এই সময় থেকেই তাঁর কবিতায় বেদনা ও একাকিত্বের সুর প্রকট হয়। তবু এই শোককে তিনি পরিণত করেন দার্শনিক মানবচিন্তায়— ব্যক্তিগত বেদনা থেকে তিনি সমাজের বেদনা উপলব্ধি করেন।
তাঁর “দীপ ও ধূপ” ও “জীবনপথে” কাব্যগ্রন্থে জীবনের অন্তিম পর্যায়ের শান্ত, তপস্বিনীর কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হয়েছে।
সমাজনেত্রী ও সংগঠক হিসেবে ভূমিকা
কামিনী রায় শুধু কবিতা লেখেননি— কাজ করেছেন নারীশিক্ষা ও সমাজকল্যাণে। তিনি ছিলেন বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সহসভাপতি (১৯৩২–৩৩), বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের সাহিত্য শাখার সভানেত্রী (১৯৩০)। এসব পদে থেকে তিনি নারীসাহিত্যিকদের উৎসাহিত করেছেন।
তিনি নারীশ্রম, মাতৃত্ব ও সামাজিক ন্যায়ের প্রশ্নে সরব ছিলেন। তাঁর সময়কার সমাজে যখন নারীরা নীরব, তিনি ছিলেন কণ্ঠস্বর। তাঁর জীবন ও কাজ এক কথায় “কর্মে কবিতা, কবিতায় কর্ম”।
১৯২৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে “জগত্তারিণী স্বর্ণপদক” প্রদান করে। এটি ছিল তাঁর সাহিত্যজীবনের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি।
সাহিত্যিক উত্তরাধিকার ও প্রভাব
কামিনী রায় ছিলেন রবীন্দ্র-যুগের নারী কণ্ঠস্বর। তাঁর সাহিত্য পরবর্তীকালে সুচিত্রা ভট্টাচার্য, আশাপূর্ণা দেবী, সেলিনা হোসেন, মেহেরুন্নিসা পারভীন প্রমুখ নারী লেখকদের জন্য ভিত্তি তৈরি করে দেয়।
তাঁর “পাছে লোকে কিছু বলে” কবিতাটি যেন নারীমুক্তির এক অন্তর্লীন গান— শত বছর পরেও তা প্রাসঙ্গিক। আধুনিক নারীবাদী সাহিত্যচর্চায় কামিনী রায়কে দেখা হয় বাংলার প্রথম দিককার তাত্ত্বিক কণ্ঠ হিসেবে।
তিনি দেখিয়েছেন— নারী যদি নিজের শক্তি ও চিন্তা প্রকাশে ভয় পায়, তবে সমাজও স্থবির হয়ে যায়। তাই তাঁর কবিতা নারীর আত্মজাগরণের আহ্বান।
সমসাময়িক প্রাসঙ্গিকতা
আজকের বাংলাদেশে যখন লিঙ্গ-সমতা, নারীর মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়ের প্রশ্নে আমরা লড়াই করছি— তখন কামিনী রায়ের সাহিত্য আমাদের পথ দেখায়। তিনি ছিলেন একাধারে মানবতাবাদী ও সমাজতান্ত্রিক চিন্তক। তাঁর মানবপ্রেম, ন্যায়বোধ ও সমতার বার্তা আজও যুগোপযোগী।
তাঁর কবিতা আমাদের মনে করিয়ে দেয়—
“নিজেকে নিয়ে বিব্রত নয়, অন্যের জন্য বাঁচাই জীবন।”
এই বোধই আসলে সমাজতন্ত্রের ও মানবিক রাষ্ট্রচিন্তার মূল।
সমালোচনামূলক মূল্যায়ন
কামিনী রায়ের ভাষা ছিল সংস্কৃতঘেঁষা, তবে কাব্যের মর্ম গভীর ও স্পষ্ট। তিনি যুক্তিবাদী মন নিয়ে কবিতা লিখেছেন— আবেগ নয়, বোধ তাঁর কেন্দ্র। তাঁর কাব্যে প্রকৃতি আছে, তবে তা রোমান্টিক নয়; বরং প্রতীকী।
কামিনী রায় নারীজীবনের বাস্তবতা তুলে ধরেছেন সমাজের ভেতর থেকেই। তিনি প্রতিবাদ করেছেন, কিন্তু বিনয় ও সৌন্দর্যের ভাষায়। তাঁর কবিতা নারীকে গৃহিণী থেকে রূপান্তরিত করেছে চিন্তাশীল মানবিক সত্তায়।
তাঁর সাহিত্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়—
বিষয়বস্তু: মানবতা, সমাজচেতনা, নারীজাগরণ
ভাষা: সংস্কৃতঘেঁষা কিন্তু মর্মবাণীপূর্ণ
রূপ: সনেট, গীতিকবিতা, ছড়াকবিতা
ভাব: ধ্যানমগ্ন, বেদনা ও আলোর সন্ধানী
উপসংহার
কবি কামিনী রায় বাংলা সাহিত্য ইতিহাসে এক কিংবদন্তি নাম। তিনি নারীজাগরণের পথিকৃৎ, মানবপ্রেমের কবি এবং সমাজচিন্তার প্রেরণাদাত্রী। তাঁর জীবনের প্রতিটি অধ্যায় প্রমাণ করে— শিক্ষা, সাহিত্য ও সমাজকর্ম একসঙ্গে মানুষকে আলোকিত করতে পারে।
আজ তাঁর ১৬১তম জন্মবার্ষিকীতে আমরা শুধু একজন কবিকে স্মরণ করছি না; স্মরণ করছি এমন এক নারীর কথা, যিনি সমাজকে চিন্তার নতুন দিগন্ত দেখিয়েছিলেন।
কামিনী রায়ের জীবন ও সাহিত্য আমাদের শেখায়—
“সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।”
এই পঙক্তিই যেন তাঁর জীবনদর্শনের সারমর্ম—
মানুষের কল্যাণে, সমাজের মুক্তিতে, নারীর মর্যাদায় নিবেদিত এক কবির অমর উত্তরাধিকার।
#
লেখক:
সৈয়দ আমিরুজ্জামান
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট;
বিশেষ প্রতিনিধি, দ্য ফিনান্সিয়াল পোস্ট ও সাপ্তাহিক নতুনকথা;
সম্পাদক, আরপি নিউজ;
কেন্দ্রীয় সদস্য, জাতীয় কৃষক সমিতি;
সাবেক সংগঠক, ’৯০-এর গণঅভ্যুত্থান;
E-mail: syedzaman.62@gmail.com
WhatsApp: 01716599589
সম্পাদক : সৈয়দ আমিরুজ্জামান
ইমেইল : rpnewsbd@gmail.com
মোবাইল +8801716599589
৩১/এফ, তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০।
© RP News 24.com 2013-2020
Design and developed by ওয়েব নেষ্ট বিডি