অবসরের গানঃ ভাঙ্গন নদীর পাড়ে বসত!

প্রকাশিত: ১২:১১ অপরাহ্ণ, জুন ৩, ২০২২

অবসরের গানঃ ভাঙ্গন নদীর পাড়ে বসত!

শরীফ শমসির |

মহান সাহিত্যিক লেভ তলস্তয় তাঁর মহৎ উপন্যাস ‘ আনা কারেনিনা’র শুরুতেই একটি গুরুবাক্য লিখেছেন যার মানে দাঁড়ায় এরকম, সকল সুখী মানুষ দেখতে একইরকম, অসুখীরা দেখতে আলাদা আলাদা। ভোগের বাজারে সুখীদের জীবনযাপন হয়তো একই রকম, কিন্তু অসুখীদের জীবনযাপন বৈচিত্র্যময়। বিত্তের বিষয়কে বাদ রেখে অসুখীদের মনের তল হয়তো সরলরৈখিক নয়; তারপরেও বলা চলে, মানুষের মন বিচিত্র, সুখী হোক বা অসুখী, ফ্রয়েড বা তদীয় চেলারা এইরকম বলেন।
মন বিচিত্র হয় কেন এর তত্ত্বতালাশ করতে এই ভাব প্রকাশ নয় বরং ভাবতে চাইছি, সকল সুস্থ মানুষ দেখতে একইরকম কিন্তু সকল অসুস্থ মানুষ আলাদা আলাদা কীনা। প্রবাদ আছে, স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল, তাহলে সকল সুস্থ বা স্বাস্থ্যবান সুখী এবং অসুস্থ মানুষ অসুখী; মানে অসুখও নানান প্রকার হয়। অসুখ মনের হতে পারে, দেহেরও হতে পারে। মন নিয়ে ঔপন্যাসিক, গল্পকার নানা লেখা লিখেছেন, মনোবিজ্ঞানীগণও কাজ করেন, সমাজবিজ্ঞান ও বিজ্ঞানও এক্ষেত্রে এগিয়ে এসেছে। মন ফ্রয়েড দিয়ে যেমন বুঝা যায় তেমনি সংস্কৃতি দিয়েও বোঝার চেষ্টা করা হয়। তবে মনের খবর রাখা কঠিন, কারণ, তার কিছুটা জ্ঞেয়, অনেকটা অজ্ঞেয়। এবিষয়ে নানা কবির নানান পদও আছে; মানুষের আগ্রহও অসীম!
আমার মন এখন মনের প্রসঙ্গ পেড়েছে শরীরের খোঁজ নিতে গিয়ে। সুস্থ শরীর সুস্থ মনের ধারক কীনা সে সরলীকরণ না করেও বলা চলে, অসুস্থ শরীর মনকে অপ্রসন্ন ও অবসাদগ্রস্ত করে বৈকি। মনের প্রসঙ্গে, আত্মা, পরমাত্মার বিষয়ে যাব না, মনের মধ্যেই থাকবো। কবি ও মরমি সাধকেরা দেহ এবং মনের সম্পর্ক নিয়ে কত কাব্যই না রচনা করেছন। খাঁচা আর পাখি রুপকতো বেশ সাধারণ শরীর রুপ খাঁচা বা মাটির দেহের খবর সকলেই জানতে চান, যারা অধিক জানেন তাঁরা মরমী সাধক, তাঁদের পদ সকলকে ছুঁয়ে যায়; যেমন মাটির দেহের গৌরব করা সমীচীন নয়, তারা দেহের রূপ-মাধুর্যের স্তাবক নন। আবার অনেক সাধক, শরীরের নানা কুঠুরির খবরও জানতে ছেয়েছেন। শরীরকে পবিত্র জ্ঞানে সাধনাও করেন কিন্তু জ্বরা, রোগ বা অসুস্থতা? এই সবের হয়তো দার্শনিক উত্তর আছে কিন্তু রোগ নিরাময়ের বিধান বা আরাম দেওয়ার জন্য বিজ্ঞান, শারীরবিজ্ঞান, কৃৎকৌশল, ওষুধবিজ্ঞানীগণ নিরন্তর চেষ্টা করে যাচ্ছে। আর এসবের এক সম্মীলন দেখা যায়, হাসপাতালে। অসুখ হাজার রকমের, বর্ণনা অবান্তর, অসুস্থ মানুষ জানেন, তারটা তার; কারো সাথে মিলে না। হাসপাতালে মানুষ জানেন এখানেই তিনি নিজের সম্পর্কে জানেন, নানা প্যাথোলজী, এক্স রে, এমআরআই, সিটি স্কেন কনডাকশন বা নানা যন্ত্রের মাধ্যমে ডাক্তার যখন রোগ ধরতে চান তখন রোগীও নিজেকে জানেন, তার ব্লাডপ্রেশার কত, সুগার কত, পালস কত এগুলো এখন সাধারণেরও জানা, নিজেকে কতটুকু জানা গেল সে দার্শনিক জিজ্ঞাসার উত্তর পাওয়া না গেলেও, নিজের শরীরকে ভালোই জানা যায়; এই জানার পরেই তিনি জানেন, ভাঙ্গনের কত কাছ তিনি, দম টিকবে কি টিকবে না, কয় সেকন্ড তিনি আছেন। নানা শারীরিক যন্ত্রণা, কষ্ট, আনন্দ বেদনা, শল্য -অশল্য চিকিৎসা, হাসপাতালে বিরাজ করে, হাসপাতালে আছেন ডাক্তার আর যার যার সৃষ্টিকর্তা, রোগী জানেন কখন তিনি কার হাতে পড়বেন, মৃত্যু যেমন এখন অমৃত, সুস্থতাও এখানে অমৃত; একটা অমৃতালোকে নিয়ে যায় অন্যটা আনন্দের অমৃত স্বাদ দেয়। হাসপাতালে মানবতার বসবাস আর হাসপাতালেই মানবতার জয় হয়! এখানে মানুষ একটা ইউনিক নাম্বার, সেই কোড নাম্বারে ডাক্তার রোগীকে জানেন, রোগী নিজেকে চিনেন। শরীরের ভাঙ্গন, ক্ষয় জীবন-নদীর পাড়ে বসত করতে শেখায়, বসে আছি ভাঙ্গন-নদীর ডাকের অপেক্ষায়। নিজের শরীরকে জেনেছি, বড় বেশী দেরীতে হয়তো! জীবনের জয় হোক! এই হোক অবসরের গান।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ