সিলেট ১লা জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১৭ই আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ২:২৬ অপরাহ্ণ, জুলাই ২৮, ২০২২
ইদানিং হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেক মানুষকে দেখা যায় নিরাপত্তার জন্যই তারা গ্রাম ছেড়ে শহরে এসে বসবাস করছে। শিক্ষা, দীক্ষা এবং চাকুরিসহ আধুনিক জীবনের জন্য শহরে বসবাসের প্রয়োজন আছে। শহরে বসবাসের কারণে তারা একদিকে যেমন ব্যাপকভাবে নাগরিক সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে। এতে তাদের জীবনমানের উন্নতি হচ্ছে। বিপরীতে আরেকটি বিষয় হচ্ছে, তা হলো- গ্রামের জমিজমা বিক্রি করে শহরে বসবাস করার কারণে তারা শেকড়হীন হয়ে যাচ্ছে। পরগাছার মত অন্যের উপরে সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল হয়ে যাচ্ছে। শহরে বসবাসের সাথে সাথে গ্রামেও পূর্বপুরুষদের ভিটা জমিজমা যথাসম্ভব রক্ষা করে রাখা উচিত। শহরে কেউ কাউকে চেনে না। একই বিল্ডিংয়ে দিনের দিন বাস করার পরে কেউ কাউকে চেনে না। পক্ষান্তরে গ্রামে যুগযুগ ধরে পূর্বপুরুষদের ভিটা হওয়ার কারণে সম্পূর্ণ গ্রামবাসী একে অন্যকে সবাই চেনে। প্রত্যকটি পরিবারেরই কিছু না কিছু ঐতিহ্য রয়েছে। সেই ঐতিহ্যের শেকড়টি ছেদ করা পূর্বপুরুষদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতার নামান্তর। তাই যথাসম্ভব চেষ্টা করা উচিত গ্রামের ভিটামাটি বিক্রি না করে রক্ষা করা। তাহলে উত্তরপুরুষেরা জানতে পারবে, তাদের পরিবারের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং পরম্পরা। একান্তই বাধ্য হয়ে বিক্রি করতেই হয়, তবে তা নিজ জ্ঞাতিগুষ্টির মানুষের কাছে বিক্রি করা উচিত। কোন পরিস্থিতিতেই কখনো আত্মীয় পরিজন জ্ঞাতিগুষ্টিদের সাথে বিরোধ করতে নেই। বিখ্যাত যদুবংশ ধ্বংস হয়েছে, শুধুই আত্মীয় পরিজন জ্ঞাতিগুষ্টিদের সাথে বিরোধ করে।মনুসংহিতায় বলা হয়েছে:
ঋত্বিক্পুরোহিতাচাৰ্যৈমাতুলাতিথিসংশ্ৰিতৈঃ।
বালবৃদ্ধাতুরৈর্বৈদ্যৈর্জ্ঞাতিসম্বন্ধিবান্ধবৈঃ ॥
মাতাপিতৃভ্যাং যামীভির্ভ্রাত্ৰা পুত্ৰেণ ভাৰ্যয়া।
দুহিত্রা দাসবর্গেণ বিবাদং ন সমাচরেৎ ॥
এতৈর্বিবাদান্ সন্ত্যজ্য সর্বপাপৈঃ প্ৰমুচ্যতে ।
এভিৰ্জিতৈশ্চ জয়তি সর্বান্ লোকানিমান্ গৃহী॥
(মনুসংহিতা:৪.১৭৯-১৮১)
“ঋত্বিক্, পুরোহিত, আচার্য, মাতুল, অতিথি, আশ্রিত লোক, বালক, বৃদ্ধ, পীড়িত ব্যক্তি, চিকিৎসক, জ্ঞাতি, জামাতা শ্যালকাদি কুটুম্ব, মাতুল পক্ষের আত্মীয়, মাতা, পিতা, যামি (ভগিনী, ভ্রাতৃবধূ প্রভৃতি), ভ্রাতা, পুত্র, পত্নী, কন্যা ও ভৃত্যবর্গের সঙ্গে বিবাদ করবে না ।
এদের সঙ্গে বিবাদ পরিত্যাগ করে সকল পাপ থেকে গৃহস্থ মুক্ত হয় এবং এদের ভালোবাসা দ্বারা জয় করলে গৃহী জগতের সকলকেই জয় করতে পারে।”
আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন, জগতে কোন জাতির যদি পরিমাণগত (quantitative) প্রবৃদ্ধি না হয়, তবে শুধু গুণগত (qualitative) প্রবৃদ্ধিতে সেই জাতির অস্তিত্ব রক্ষা হয় না। সামান্য পরিমাণে সংখ্যালঘু হওয়ার কারণে ১৯৪৭ সালে বাঙালি হিন্দুর জীবনে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা হয়েছে। লাখো লাখো মানুষকে নিজের পিতৃপুরুষের ভিটামাটি ছেড়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে উদ্বাস্তু হয়ে পশ্চিমবঙ্গে দেশান্তরি হতে হয়েছে। এদেশীয় ইতিহাস তার সাক্ষী। যে ছিলো জমিদার, সর্বস্ব হারিয়ে তাকে পথের ভিখারি হয়ে কলিকাতা এবং তার আশেপাশে আশ্রয় নিতে হয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাস বলে, ক্ষমতার চাকা গুণগত এবং পরিমাণগত এ দু’ভাবেই জগতে যুগপৎ অতিক্রম করে। এ চাকা থামে না, মানুষকে এ ঘুর্নায়মান চাকার সাথেই সাধ্যমত পথ চলতে হয়। বাঙালি হিন্দু সংখ্যালঘু হতে হতে বঙ্গভূমির প্রতি অধিকার প্রতিনিয়ত হারাচ্ছে। বেদ, রামায়ণ, মহাভারতসহ বিভিন্ন পুরাণে বঙ্গের নাম সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত। পূর্বে এই বৃহত্তর বঙ্গভূখণ্ডের সকল জনগোষ্ঠীই সনাতন ধর্মাবলম্বী ছিলো। আজ বাংলাদেশে হিন্দুসম্প্রদায় মাত্র দশ শতাংশের কাছাকাছি। পশ্চিমবঙ্গে প্রতি জনগণনায় হিন্দু সম্প্রদায়ের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। এ ক্রমবিলীয়মান অবস্থা স্বচক্ষে প্রতিনিয়ত দেখার পরেও, বাঙালি হিন্দু ভাবলেশহীন। সংখ্যা হ্রাস প্রতিরোধে কোন উদ্যোগ দেখা যায় না। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কণিকা’ কাব্যগ্রন্থের ‘অধিকার’ নামক কবিতাটির কথা মনে পড়ে যায়। একটি বনের অধিকার নিয়ে তর্ক হচ্ছে যে, কোন গাছের অধিকার বেশি। বকুল ফুলের গাছ বলে, “আমি সুগন্ধে বনকে মাতোয়ারা করে রাখি, তাই আমিই শ্রেষ্ঠ”। বকুল গাছের কথা শুনে পলাশ ফুলের গাছ বলে, “আমি আমার রঙে আমি রঙিন করে দিয়েছি, তাই আমিই শ্রেষ্ঠ”। তখন গোলাপ ফুলের গাছ বলে, তোমাদের দুজনের কারো সুগন্ধ আছে, আবার কারো রঙের রঙিন শোভা আছে। কিন্তু আমার সুগন্ধ ও মনোরম শোভা দুটোই আছে। তাই আমিই সর্বশ্রেষ্ঠ”। এভাবে যখন বনের সকল গাছের একে অন্যের সাথে তর্ক হচ্ছে, তখন কচুগাছ বনের সকল গাছের উদ্দেশ্যে পরিহাসের হাসি হেসে বলে, “সুগন্ধ, শোভা বাড়ি গিয়ে ধুয়ে খাও গিয়ে। আমি আমার অধিকার তৈরি করেছি মাটির সাথে। মাটির ভেতরে আমার মত দখল কারো নেই”।মাটির উপরে অধিকারের প্রত্যক্ষ প্রমাণে পরবর্তীতে বনে সকল গাছের মধ্যে জয় হয় কচুগাছের। সুগন্ধিযুক্ত বকুলগাছ, মনোরম শোভাযুক্ত পলাশগাছ বা সুগন্ধি-শোভা উভয়যুক্ত গোলাপগাছ সামান্য কচুগাছের কাছে অধিকারের শ্রেষ্ঠত্বে পরাজিত হয়।
“অধিকার বেশি কার বনের উপর
সেই তর্কে বেলা হল, বাজিল দুপর।
বকুল কহিল, শুন বান্ধব-সকল,
গন্ধে আমি সর্ব বন করেছি দখল।
পলাশ কহিল শুনি মস্তক নাড়িয়া,
বর্ণে আমি দিগ্বিদিক রেখেছি কাড়িয়া।
গোলাপ রাঙিয়া উঠি করিল জবাব,
গন্ধে ও শোভায় বনে আমারি প্রভাব।
কচু কহে, গন্ধ শোভা নিয়ে খাও ধুয়ে,
হেথা আমি অধিকার গাড়িয়াছি ভুঁয়ে।
মাটির ভিতরে তার দখল প্রচুর,
প্রত্যক্ষ প্রমাণে জিত হইল কচুর।”
কচুগাছে সংস্পর্শে যতই গায়ে চুলকানি হোক না কেন, মাটির মধ্যে কচুগাছের দখল প্রচুর। কচুগাছের দেহের অর্ধাংশ মাটির ভিতরে, এটাই তার বড় শক্তি। ইতিহাস থেকে শিক্ষা না নেয়া একটি সম্প্রদায় হলো বাঙালি হিন্দু। তাদের জ্ঞান, বিদ্যা, বৈভব যেমন আছে, তেমনি আছে কাণ্ডজ্ঞানের অভাব। তারা অধিকাংশই জানে না যে, কোনটি আলো এবং কোনটি আলেয়া। নিজভূমে পরবাসী হয়েও তাদের বিশ্বনাগরিক হওয়ার বাসনা। এ এক কাণ্ডজ্ঞানহীন অপরিনামদর্শী মানসিকতা। গত শতাব্দীর ত্রিশ-চল্লিশের দশকে বাঙালি হিন্দু যে ভুলগুলো করেছে। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করছে একবিংশ শতাব্দীরতে এসে। একটি কথা মনে রাখা প্রয়োজন যে, আশেপাশের সকল জাতিগোষ্ঠীর সাথে সম্প্রীতিময় অত্যন্ত সুসম্পর্ক যেমন থাকতে হবে, তেমনি নিজ স্বজাতি রক্ষার্থেও সক্রিয় উদ্যোগী হতে হবে। নিজের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য বিলিয়ে দিয়ে কখনো, সাম্যবাদী বিশ্ব নাগরিক হওয়া যায় না।
কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী
সহকারী অধ্যাপক,
সংস্কৃত বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
সম্পাদক : সৈয়দ আমিরুজ্জামান
ইমেইল : rpnewsbd@gmail.com
মোবাইল +8801716599589
৩১/এফ, তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০।
© RP News 24.com 2013-2020
Design and developed by M-W-D