ঐতিহাসিক পালাবদলের সময়ে যেমন ঘটে, অনেকটা তেমন দৃশ্যই যেন ঘটে চলেছে আমেরিকায়

প্রকাশিত: ৬:৩১ পূর্বাহ্ণ, জুন ৪, ২০২০

ঐতিহাসিক পালাবদলের সময়ে যেমন ঘটে, অনেকটা তেমন দৃশ্যই যেন ঘটে চলেছে আমেরিকায়

Manual3 Ad Code

অলোকা ব্যানার্জি, কলকাতা (ভারত), ০৪ জুন ২০২০ : এতক্ষণে সারা পৃথিবীর মতো আমরা সকলেই জেনে গিয়েছি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সদর দপ্তর মার্কিন রাষ্ট্রপতির বাসভবন হোয়াইট হাউস এখন কার্যত অবরুদ্ধ। দলে দলে বিক্ষুব্ধ, ক্ষিপ্ত প্রতিবাদী জনতা কার্যত দখল করে নিচ্ছে সরকারী ভবন, রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের প্রতীক স্বরূপ এক-একটি কেন্দ্র বা স্তম্ভ। রাষ্ট্রীয় সান্ত্রীবাহিনী ‘ন্যাশানাল গার্ড’রা লড়াকু অগ্রসরমান জনতার ওপর গুলি চালাতে অস্বীকার করেছেন। ঐতিহাসিক পালাবদলের সময়ে যেমন ঘটে, অনেকটা তেমন দৃশ্যই যেন ঘটে চলেছে আমেরিকার রাজধানী ও রাজপথে। মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প ভূগর্ভস্থ বাঙ্কারে আত্মগোপন করেছেন বলে শোনা যাচ্ছে।

Manual4 Ad Code

২৫শে মে আমেরিকার উত্তর প্রান্তে মিনেসোটা প্রদেশের মিনিয়াপোলিস শহরে একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই ব্যাপক বিক্ষোভের সূত্রপাত হয়। ৪৬ বছর বয়সী কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রো-আমেরিকান জর্জ ফ্লয়েড একটি স্টোর থেকে কুড়ি ডলার দিয়ে সিগারেট কেনার সময় চেকের বৈধতা নিয়ে সমস্যা সৃষ্টি হয়। দোকানদার পুলিশ ডেকে আনলে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে দু’হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিয়ে। চারজন পুলিশের ঐ টীমের মধ্যে থাকা ডেরেক শভিন নামে ৪৪ বছর বয়সী এক শ্বেতাঙ্গ পুলিশ তাকে গাড়ির কাছে নিয়ে যায় ও হাতকড়া পরানো অবস্থাতেই ফ্লয়েডকে শুইয়ে দিয়ে তার ঘাড়ের ওপর হাঁটু দিয়ে চেপে রাখে। ৮ মিনিট ৪৬ সেকেন্ড ধরে এই ঘটনা চলতে থাকে। পুলিশের পোষাকে লাগানো ক্যামেরা এবং সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া কিছু শহরবাসীর ভিডিও থেকে দেখা যায় যে, ফ্লয়েড কাতরভাবে শভিনকে বলছেন তিনি শ্বাস নিতে পারছেন না। তাকে যাতে না মেরে ফেলা হয়। প্রত্যক্ষদর্শী, পুলিশের ক্যামেরা আর সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া ভিডিওগুলো সহ যাবতীয় তথ্যপ্রমাণ থেকে জানা গেছে, ফ্লয়েড তার গ্রেপ্তারির সময়ে কোনো বাধা দেননি, ফ্লয়েডের কাছে কোনো অস্ত্র ছিল না এবং গ্রেপ্তারির সময় ফ্লয়েড কোনো হিংসাত্মক বা প্ররোচনামূলক কাজ বা মন্তব্য করেন নি। ভিডিওতে দেখা গেছে, গোটা ঘটনার সময় অন্য তিনজন পুলিশ পাশে দাঁড়িয়ে গোটা ঘটনাটা দেখছেন। ৮ মিনিট ৪৬ সেকেন্ড পর ফ্লয়েডের দেহ অসাড় হয়ে গেলে তাকে সেই পুলিশের টীম হাসপাতালে নিয়ে যায়, যেখানে তাকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট অনুযায়ী, ফ্লয়েডের আগে থেকেই হৃদযন্ত্রে সমস্যা ছিল, যা শভিনের হাঁটু দিয়ে অতোক্ষণ ওভাবে চেপে ধরায় দ্রুত শ্বাসরুদ্ধ হয়ে ফ্লয়েড মারা যান।

এই ঘটনা সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে যাওয়ার পর আমেরিকার একের-পর-এক শহরে বিক্ষোভ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। বর্ণবিদ্বেষকে মুছে ফেলার দাবী ছাড়াও এক্ষেত্রে রয়েছে এই চারজন পুলিশকেই গ্রেপ্তার করার দাবী। যদিও এখনও পর্যন্ত শুধুমাত্র শভিনকেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

Manual4 Ad Code

নিউ ইয়র্ক টাইমসের খবর অনুযায়ী, মিনিয়াপোলিস, নিউ ইয়র্ক, ওয়াশিংটন, সান ফ্রান্সিসকো, সান দিয়েগো, মিশিগান, আটলান্টা, ফিলাডেলফিয়া, লুইভিল সহ এই মুহূর্তে আমেরিকার কমপক্ষে ১৪০টি শহরে এই বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়েছে। ক্রমশ গোটা আমেরিকা পরিণত হচ্ছে বিক্ষোভের বারুদের স্তুপে। বিক্ষোভ কোথাও কোথাও শান্তিপূর্ণ হলেও অনেক শহরে পুলিশের গাড়িতে অগ্নিসংযোগ, বড় বড় অফিস বিল্ডিংয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া, পুলিশের সাথে খণ্ডযুদ্ধ, বড় বড় রিটেল শপ থেকে লুটপাটের মতো হিংসাত্মক ঘটনাও ঘটতে দেখা যাচ্ছে। বিক্ষোভ পৌঁছে গেছে হোয়াইট হাউস অবধি। স্থানীয় মেয়রের ২৫ বছর বয়সী কন্যাও আন্দোলনে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছেন নিউ ইয়র্কে। গতরাতে ৩৭টি বড় শহরে ন্যাশনাল গার্ডদের নেতৃত্বে কার্ফু জারি হয়েছিল, সাধারণ মানুষকে দলে দলে যা আজ ভাঙতে দেখা গেছে।

আমেরিকায় কালো মানুষদের প্রতি শ্বেতাঙ্গদের বিদ্বেষ ও হিংসা নতুন কিছু নয়। প্রায় প্রতিদিনই কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি পুলিশি হিংসার মতো প্রাতিষ্ঠানিক হিংসার অভিযোগ ওঠে। সংবাদসংস্থা আল-জাজিরার ওয়েবসাইট থেকে জানা যাচ্ছে, “ম্যাপিং পুলিশ ভায়োলেন্স” নামে একটি গবেষণা গ্রুপের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সাল থেকে ২০১৯ সাল অর্থাৎ এই মাত্র ৬ বছরে আমেরিকায় ৭৬৬৬ জন পুলিশি হিংসায় মারা গেছেন। মৃতদের মধ্যে প্রায় ৭২% হল কৃষ্ণাঙ্গ। যদিও কৃষ্ণাঙ্গরা আমেরিকার মোট জনসংখ্যার মাত্র ১৩%। মৃতদের বাকী ২৮% অকৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে সিংঘভাগ হল শরণার্থী মেক্সিকান-সহ অন্যান্য লাতিন আমেরিকানরা এবং একদম গরীব আমেরিকান শ্বেতাঙ্গরা।

বর্ণবিদ্দেষী বা জাতিবিদ্দেষী নানা মন্তব্য ও কার্যকলাপের জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সম্পর্কে নানা অংশের মানুষের অভিযোগ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ও বাইরে নতুন নয়। ফ্লয়েডের মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে ট্রাম্পের প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল, “when the looting starts, the shooting starts”. এরপর পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে ট্রাম্প ন্যায়বিচার এবং শান্তির কথা বলেন। তাতে বিক্ষোভ আরো বেড়ে যায়। সংবাদসংস্থা রয়টার্সের খবর অনুযায়ী, হোয়াইট হাউসের বাইরের বিক্ষোভের মূল দুটি শ্লোগান হল “Black lives matter”এবং “No Justice, No Peace”।

অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, আন্দোলন এত হিংসাত্মক শুধু ফ্লয়েডের খুনের ঘটনার কারণে হচ্ছে না। তাঁরা বলছেন, আমেরিকার ধুঁকতে থাকা অর্থনীতিতে এমনিতেই কৃষ্ণাঙ্গ ও অন্যান্য অশ্বেতাঙ্গ মানুষেরা সবচেয়ে বেশি সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছিলেন। করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় জারি করা লকডাউন তাঁদের সমস্যা আরো অনেকগুণ বাড়িয়ে দেয়। বিশেষজ্ঞ ডেনিস রেডমন্ড লিখছেন, এই মুহূর্তে আমেরিকায় প্রতি ৪ জনে ১ জন কর্মহীন বেকার, প্রতি ৫ জনে ১ জন স্বাস্থ্যবীমা করার ক্ষমতা হারাচ্ছেন অর্থাৎ আমেরিকার ব্যয়বহুল চিকিৎসা ব্যবস্থার কারণে চিকিৎসা করাবার ক্ষমতা প্রায় হারাতে বসেছেন, প্রতি ৬ জনে ১ জন ঘরভাড়া দিতে পারছেন না এবং প্রতি ৭ জনের মধ্যে ১ জনের খাবার কেনার ক্ষমতা নেই। স্বভাবতই সবচেয়ে খারাপ অবস্থা কালো মানুষদের। অর্থনীতিবিদদের বেশীরভাগ বলছেন, এই সময়ে এই গরীব মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর কথা ছিল সরকারের। তার বদলে সরকারী ঘোষণা অতিরিক্ত ধনীদের লাভের পরিমাণকে অটুট রাখতেই বেশি মনোযোগ দিয়েছে।

Manual6 Ad Code

দিন পনেরো আগে সোশাল মিডিয়ায় নিউ ইয়র্কের এক হাসপাতাল থেকে এক কৃষ্ণাঙ্গ মহিলার ভিডিও বিপুল ভাইরাল হয়। ভিডিওতে দেখা যায়, উনি বলছেন কিভাবে কালো মানুষদের করোনা পরীক্ষায় কম গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। তার অভিযোগ ছিল এ কারণেই তার বোনকে প্রাণ খোয়াতে হয়, কারণ, তার মৃত্যুর পর রিপোর্ট আসে যে সে করোনায় আক্রান্ত ছিল। শুধু এই ভিডিওই নয়, ইতোমধ্যে আমেরিকা জুড়ে বিভিন্ন জায়গায় জেলবন্দীদের এই করোনা-মহামারির সময়ে শর্তসাপেক্ষে মুক্তির কথা জোরালো হচ্ছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ এই পথই নিয়েছে করোনা-সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া আটকাতে। অভিযোগ উঠেছে, কারাবন্দীদের মধ্যে বেশীরভাগ কালো মানুষ কিংবা মেক্সিকান এবং অন্যান্য লাতিন আমেরিকান শরণার্থী বলে ট্রাম্প সরকার সে কথায় আমল দিচ্ছে না। একইভাবে গুরুত্ব না দেওয়ার কথা উঠেছে আমেরিকার মধ্যেই আমেরিকান ইন্ডিয়ান ট্রাইবদের বিশেষ ভূখণ্ড নাভাজো নেশনে করোনা চিকিৎসায় উদাসীনতা নিয়ে। উল্লেখ্য এই মুহূর্তে আমেরিকার ফেডেরাল প্রিজনারদের মধ্যে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ৬০০০ এবং মৃত ৬৭। নাভাজো নেশনের পৌনে দু’লক্ষ জনসংখ্যার মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা ৫০০০-এর একটু বেশী এবং মৃত ২৩১ জন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চলমান বিদ্রোহের পরিনতি কি হবে, তা সময়ই বলবে। তবে আধুনিক পৃথিবীর সবচেয়ে এগিয়ে থাকা দেশ হিসেবে প্রচারের আলোয় যে দেশকে তুলে ধরা হয়, যে দেশের কর্তাব্যক্তিরা নিজেরাই ঘোষণা করেন সারা পৃথিবীর কাছে একবিংশ শতাব্দী নাকি হয়ে উঠবে ‘মহান আমেরিকান শতাব্দী’, সেই দেশের ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ওপর মুষ্টিমেয় অর্থবান ও ক্ষমতাশালী মানুষের বৈষম্যমূলক আচরণ, এই আধুনিক সভ্য সময়েও লক্ষ লক্ষ আমেরিকানের অমানবিক জীবনযাপন করতে বাধ্য হওয়ার বাস্তবতা, তা সারা পৃথিবীর মানুষের সামনে হাজারো প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে।

লেখাটি শেষ করবো একটি মার্কিন সংবাদ সংস্থার একটি উদ্ধৃতি দিয়ে। মব লিঞ্চিং বা গণপটুনির কায়দায় মার্কিন পুলিশ যেভাবে কৃষ্ণাঙ্গ তথা নানা বর্গের অশ্বেতাঙ্গ মানুষের নিগ্রহ ও হত্যা ঘটায়, তার সাথে আমাদের দেশ ভারতবর্ষেরও কিছু তুলনা উঠে এসেছে এই প্রসঙ্গে। ওই মার্কিন সংবাদ সংস্থা লিখছে, “Is America becoming like India?” আমেরিকা কি তবে ভারতের মতো হয়ে যাচ্ছে? এই তাদের প্রশ্ন। এক্ষেত্রে স্পষ্ট গত পাঁচ-ছয় বছরে ভারতবর্ষে অতিরিক্ত মাত্রায় দলিত, আদিবাসী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন ও গণপিটুনির মাধ্যমে তাদের হত্যা করার প্রসঙ্গটি স্মরণ করাতে চেয়েছে ওই সংস্থাটি।

Manual6 Ad Code

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

 


Follow for More!

Manual1 Ad Code
Manual8 Ad Code