সিলেট ২রা জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১৮ই আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ১২:২৮ পূর্বাহ্ণ, আগস্ট ১৮, ২০২২
বিশেষ প্রতিনিধি | ঢাকা, ১৮ আগস্ট ২০২২ : মজুরী বৃদ্ধিসহ অন্যান্য দাবীনামা নিয়ে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি সম্পাদনের নিমিত্তে চলমান দরকষাকষির অালোচনাকে টেবিলে রেখে ও অাইনী প্রক্রিয়া উপেক্ষা করে গড়ে ওঠা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে উদ্ভূত পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে দ্বিতীয় দফায় কোনো সমঝোতা ছাড়াই শেষ হয়েছে শ্রম দপ্তরের মধ্যস্থতায় মালিকপক্ষের সংগঠন বাংলাদেশীয় চা সংসদ ও বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের মেয়াদ উত্তীর্ণ কমিটির নেতৃবৃন্দের বৈঠক।
বুধবার (১৭ অাগস্ট ২০২২) ঢাকায় শ্রম অধিদপ্তরে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
শ্রম অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) খালেদ মামুন চৌধুরীর নেতৃত্বে বিকাল ৫টার শুরু হয়ে বৈঠক শেষ হয় রাত ১১টায়। বৈঠকে প্রথমে শ্রমিক নেতারা মজুরি বৃদ্ধিসহ অনান্য দাবিদাওয়া তুলে ধরেন। পরে মালিকপক্ষের সংগঠন বাংলাদেশীয় চা সংসদের প্রতিনিধিবৃন্দ তাদের বিস্তারিত বক্তব্য তুলে ধরেন।
আলোচনায় দুইপক্ষই কোনো সমঝোতায় আসতে না পারায় রাত ৮টায় চা বিরতি দেয়া হয়। পরে আবার শুরু হলেও কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই বৈঠক শেষ হয় বলে জানান শ্রমিক নেতারা।
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সহসভাপতি পংকজ এ. কন্দ জানান, বৈঠকটি কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয়েছে। চা শ্রমিকরা তাদের চলমান ধর্মঘট চালিয়ে যাবেন।
তিনি আরও বলেন, মালিকপক্ষ বৈঠকে যে মজুরি প্রস্তাব করেছেন সেটি ৩০০ টাকার ধারে কাছেও নয়। তাই আমাদের কাছে এই প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য হয়নি।
চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক ও বালিশিরা ভ্যালীর সভাপতি বিজয় হাজরা বলেন, মালিকপক্ষ শ্রমিকদের মজুরি ১২০ থেকে বাড়িয়ে ১৪০ টাকা করার প্রস্তাব করেছিলেন। আমরা তাদের এই প্রস্তব প্রত্যাখান করেছি।
মালিকপক্ষের সংগঠন বাংলাদেশীয় চা সংসদের চেয়ারম্যান শাহ আলম বলেন, শ্রমিকপক্ষ দুই দিনের সময় নিয়েছেন। তারা পরে তাদের সিদ্ধান্ত জানাবেন।
তবে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নিপেন পাল বলেন, আমরা কোনো সময় নেইনি। আমাদের আন্দোলন প্রত্যাহার করতে বলা হয়েছিল। ২০ টাকা বাড়িয়ে ১৪০ টাকা মজুরি দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। আমরা এই ২০ টাকা মজুরি বৃদ্ধির প্রস্তাব প্রত্যাখান করেছি। সরকারের ডাকে আমরা বৈঠকে এসেছি। আবার ডাকলে আবার আসব। আলোচনা করব। কিন্তু আমাদের আন্দোলন চলমান থাকবে।
শ্রম অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) খালেদ মামুন চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, মালিক-শ্রমিকদের বৈঠকে কোনো সিন্ধান্ত হয়নি। তবে আলোচনা চলবে। তারা আন্দোলন প্রত্যাহার করবেন না। তবে তারা একদিন সময় নিয়েছেন। স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলে তারা তাদের সিদ্ধান্ত জানাবেন বলেছেন।
তিনি অারো বলেন, আগামী ২৩ আগস্ট চা মালিক–শ্রমিকদের সঙ্গে শ্রম প্রতিমন্ত্রীর ত্রি-পাক্ষিক বৈঠকের কথা রয়েছে।
তিনি চা শিল্প ও দেশের অর্থনীতির স্বার্থে আগামী ২৩ তারিখ পর্যন্ত কর্মবিরতি প্রত্যাহার করার জন্য পুনরায় অনুরোধ জানিয়েছিলেন।
মজুরী বৃদ্ধিসহ অন্যান্য দাবীনামা নিয়ে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি সম্পাদনের দাবিতে চলমান শান্তিপূর্ণ চা শ্রমিকদের অভূতপূর্ব আন্দোলনের প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির মৌলভীবাজার জেলা সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য, সাপ্তাহিক নতুন কথার বিশেষ প্রতিনিধি, অারপি নিউজের সম্পাদক ও বিশিষ্ট কলামিস্ট কমরেড সৈয়দ অামিরুজ্জামান আলাপ আলোচনার মাধ্যমে মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপন উপযোগী যৌক্তিক মজুরি নির্ধারণের আহবান জানিয়েছেন।
সামান্য কিছু সুযোগ-সুবিধাসহ দৈনিক মাত্র ১২০ টাকা মজুরিতে আট ঘন্টা, কখনো-বা আরো অধিক সময় ধরে কাজের বিপরীতে এই সামান্য পারিশ্রমিক শোষণ-বৈষম্যমূলক ও সংবিধান পরিপন্থি। মজুরী বৃদ্ধিসহ অন্যান্য দাবীনামা নিয়ে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি সম্পাদনের জন্য চলমান দরকষাকষির অালোচনার মাধ্যমে গড়ে ওঠা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে উদ্ভূত পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে বাগান মালিকদের ঔপনিবেশিক মানসিকতা পরিহার করতে হবে ও সরকারকেও চা-শ্রমিকদের দেশের নাগরিক হিসেবে গণ্য করে ন্যায্য ও মানবিক উদ্যোগ নিতে হবে। একইসাথে, চা বাগানের শ্রমিকদের জন্য প্রযোজ্য শ্রম আইনের কার্যকর বাস্তবায়নের পাশাপাশি দেশের অন্যান্য সম-পর্যায়ের খাতের সর্বনিম্ন মজুরি বিবেচনায় নিয়ে মর্যাদাপূর্ণ জীবন ধারণের উপযুক্ত ও চা-শ্রমিকদের নিকট গ্রহণযোগ্য ন্যায্য পারিশ্রমিক নির্ধারণে বাগান মালিক, বাংলাদেশীয় চা সংসদ, শ্রম অধিদপ্তর ও সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন তিনি।
প্রতি দুই বছর পরপর চা-শ্রমিক ও বাগান কর্তৃপক্ষের মধ্যে মজুরি সংক্রান্ত চুক্তি নবায়নের রীতি রয়েছে, যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রে মজুরি নির্ধারণে বাস্তবে একতরফাভাবে বাগান কর্তৃপক্ষই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে, তথাপি গত ১৯ মাস ধরে চা-শ্রমিকরা মজুরি চুক্তির বাইরে রয়েছে। দ্রব্যমূল্যের চরম ঊর্ধ্বগতির এই সময় চলমান আন্দোলনের প্রেক্ষিতে মাত্র ২০ টাকা মজুরি বৃদ্ধির প্রস্তাব চা-শ্রমিকদের ন্যায্য দাবির প্রতি অবজ্ঞা ও নিছক উপহাসমূলক অধিকার লঙ্ঘন ছাড়া আর কিছু নয় উল্লেখ করে তিনি বলছেন, চা-শ্রমিকদের প্রাপ্ত আবাসনসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা বিবেচনায় নিয়েও একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, দেশের অন্য যে-কোনো খাতের তুলনায় চা শ্রমিকদের মজুরি সর্বনিম্ন ও শোষণ-বৈষম্যমূলক। অথচ সার্বিক বিবেচনায় এ খাতটি অর্থনৈতিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া, এখন পর্যন্ত কোনো পরিসংখ্যান বা তথ্য-উপাত্ত দিয়েও কেউ বলতে পারেননি যে, চা-বাগানের মালিক পক্ষ আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বা এমন কোনো অবস্থায় আছেন যে, যাদের অবদানের ওপর নির্ভর করে চা-শিল্প বিকাশমান, সেই শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি প্রদানে তারা অক্ষম। বরং এটি একটি লাভজনক বাণিজ্যিক খাত। অন্যদিকে চা-শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরিসহ অন্যান্য মৌলিক অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার দায়িত্ব শুধু মালিকপক্ষের মর্জির ওপর ছেড়ে দেয়া ঠিক নয়। চা শ্রমিকদের দেশের নাগরিক হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে তাদের প্রাপ্য অধিকার নিশ্চিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সমূহকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে চলমান আন্দোলনের যৌক্তিকতা অনুধাবনের পাশাপাশি সমতাভিত্তিক আলোচনার মাধ্যমে চা শ্রমিকদের নিকট গ্রহণযোগ্য মজুরি নির্ধারণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।’
তিনি বলেন, দেশের “ন্যূনতম মজুরি বোর্ড” অন্যান্য খাতের ন্যূনতম মজুরি যেখানে কয়েক গুণ বেশি নির্ধারণ করেছে, সেখানে কোন অদৃশ্য শক্তির প্রভাবে শ্রম মন্ত্রণালয়ের “গাইড লাইন” উপেক্ষা করে বারবার চা বাগান মালিক পক্ষের নির্ধারণ করা ন্যূনতম মজুরির হার বহাল রেখে শ্রম মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করছে, তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
উল্লেখ্য, দৈনিক ৩০০ টাকা মজুরিসহ নতুন দ্বিপাক্ষিক চুক্তি সম্পাদনের দাবিতে গত শনিবার (১৩ অাগস্ট ২০২২) থেকে দেশের দেশের ১৬৭টি চা বাগানে একযোগে দুইঘন্টার কর্মবিরতি ও পরবর্তীতে অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট শুরু করেন শ্রমিকরা।
অন্যদিকে চা শ্রমিক ইউনিয়নের অপর একটি অংশ অ্যাডহক কমিটির ব্যানারে ৫০০ টাকা মজুরির দাবিতে অান্দোলন শুরু করেছে।
এডহক কমিটির সভাপতি ও রাজঘাট ইউপি চেয়ারম্যান বিজয় বুনার্জি এ অংশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তারাও বাগানে বাগানে গণসংযোগসহ বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ অব্যাহত রেখেছেন। তারা শ্রম অধিদপ্তর, উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও স্থানীয় সংসদ সদস্য উপাধ্যক্ষ ড. মো. আব্দুস শহীদ এমপির কাছেও স্মারকলিপি প্রদান করেছেন।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান এডহক কমিটির সভাপতি বিজয় বুনার্জি ৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে আন্দোলরত শ্রমিক নেতাদের কমিটিকে মেয়াদোত্তীর্ণ ও অবৈধ দাবি করে বলেন, তারা মালিক পক্ষের সঙ্গে আঁতাত করে দুর্নীতির মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এই শ্রমিক নেতারা চা মালিকদের সঙ্গে আঁতাত করে ১২০ টাকা মজুরির কাজ করে অট্টালিকার মালিক হয়ে গেছেন।
চা শ্রমিক ইউনিয়নের বর্তমান এডহক কমিটির সভাপতি বিজয় বুনার্জি বলেন, গত ১৯ মাস থেকে শ্রমিকদের স্বার্থে কোনো দাবি আদায় করতে পারেননি তারা। এখন আবার ৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে আন্দোলনের নামে কারখানা বন্ধ করে শ্রমিকদের রাস্তায় নামিয়েছেন।
বিজয় বুনার্জি আরো বলেন শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া আদায়ের জন্য ইউনিয়নের নেতাদের প্রতি মাসে ১৫ টাকা করে চাঁদা দেয়া হয়। সব মিলিয়ে মাসে ১৫ লক্ষাধিক টাকা ইউনিয়ন নেতাদের হাতে আসে। যে আন্দোলন শ্রমিক ইউনিয়নের নেতাদের করার কথা ছিল সে আন্দোলন শ্রমিকরা কাজ বন্ধ করে করবে কেন।
বিজয় বুনার্জী শ্রমিক ইউনিয়নের বর্তমান কমিটিকে মেয়াদ উত্তীর্ণ, ব্যর্থ এবং অবৈধ আখ্যায়িত করে তাদের দ্রুত পদত্যাগ করে লেবার হাউস ত্যাগ করার আহ্বান জানান।
এ ব্যাপারে উপাধ্যক্ষ ড. মো. আব্দুস শহীদ এমপি বলেন, বর্তমান সরকার শ্রমিক বান্ধব সরকার, শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে আমাদের মাধ্যমে সরকার বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে চলছে। শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির দাবি অনেক আগে থেকেই আমি জাতীয় সংসদে উত্থাপন করে আসছি।
তিনি শ্রমিকদের সংকট নিরসনে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে আলোচনা করবেন বলেও জানান।
সম্পাদক : সৈয়দ আমিরুজ্জামান
ইমেইল : rpnewsbd@gmail.com
মোবাইল +8801716599589
৩১/এফ, তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০।
© RP News 24.com 2013-2020
Design and developed by M-W-D