নারী দিবস

প্রকাশিত: ১২:০১ অপরাহ্ণ, আগস্ট ২৫, ২০২২

নারী দিবস

আলেক্সান্দ্রা কলনটাই |

নারী দিবস কি? সত্যি কি এর দরকার আছে? এটা কি পুঁজিপতি শ্রেনীর নারীদের কাছে, নারীবাদীদের এবং নারীর ভোটাধিকারের জন্য আন্দোলনকারীদের কাছে ছাড় দেয়া নয়? এটা কি শ্রমিক আন্দোলনের ঐক্যের জন্য ক্ষতিকর নয়?
বিদেশে শোনা না গেলেও এখনও রাশিয়াতে এই ধরনের প্রশ্ন শুনা যায়।

নারী সর্বহারার আন্দোলনের সাথে নারী দিবসের দীর্ঘ মজবুত যোগসূত্র আছে। সংগঠিত নারী শ্রমিকের বাহিনী প্রতি বছর বাড়ছে। ২০ বছর আগে খুবই অল্প সংখ্যক নারী পার্টির বিভিন্ন পদে ছড়ান ছিটান অবস্থানে ছিল। এখন ইংলিস ট্রেড ইউনিয়নে ২ লাখ ৯২ হাজার নারী সদস্য, জার্মানিতে প্রায় ২ লাখ সদস্য ট্রেড ইউনিয়নের সাথে এবং ১ লাখ ৫০ হাজার ওয়ার্কার্স পার্টির সাথে যুক্ত, অস্ট্রিয়ায় ৪৭ হাজার ট্রেড ইউনিয়নের সাথে তার মধ্যে ২০ হাজার পার্টির সাথে যুক্ত।

ইতালি, হাংগেরি, ডেনমার্ক, সুইডেন, নরওয়ে, সুইজারল্যান্ড সর্বত্রই নারী নিজেদের সংগঠিত করছে। সমাজতান্ত্রিক নারী বাহিনী প্রায় ১ মিলিয়ন ছাড়িয়ে গেছে। একটা শক্তিশালী শক্তি। জীবন নির্বাহ, মাতৃত্ত্বকালীন রক্ষাকবচ, শিশু শ্রম এবং নারী শ্রম সংক্রান্ত আইন প্রণয়নে বিশ্ববাসীর এই শক্তিকে স্বীকার করতে হবে।

একটা সময় ছিল যখন পুরুষ ভাবত তারা একাই পুঁজির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ভয়ানক দায়-দায়িত্ব বহন করবে। নারীর সহযোগীতা ছাড়াই পুরাতন পৃথিবীকে মোকাবেলা করবে। যেহেতু নারী শ্রমিক তাদের জায়গায় প্রবেশ করেছে, শ্রম বাজারের প্রয়োজন তাদের শ্রম বিক্রিতে বাধ্য করেছে, সত্য হচ্ছে তাদের স্বামী বা বাবা বেকার হয়েছে, ফলে পুরুষরা বুঝতে শুরু করেছে নারীদের শ্রেনী সচেতনহীন করে পিছনে রাখলে আসল উদ্দেশ্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যত বেশি সংখ্যক সচেতন যোদ্ধা যুক্ত হবে ততই সফলতার সুযোগ তৈরী হবে। সমাজে, রাস্ট্রে, পরিবারে যার কোন অধিকার নেই, সেই চুলার পাশের নারীর কতটুকু সচেতনতা আছে? সেই নারীর নিজেরও কোন ধারনা নেই। সবকিছু বাবা অথবা স্বামীর হুকুমেই হয়।

নারীর পশ্চাদপদতা, অধিকারহীনতা ,অধিনস্ততা বা উদাসীনতা কোনটাই শ্রমিক শ্রেনীর উপকারে আসে না বরং ক্ষতিই করে। কিন্তু কিভাবে নারী শ্রমিককে আন্দোলনে টেনে আনা যায় কিংবা তাকে জাগানো যায়?

বিদেশে সোশ্যাল ডেমোক্রেসি এর সঠিক সমাধান সহসা পায় নি। নারীর জন্য শ্রমিক সংগঠন মুক্ত থাকলেও তারা খুব কম যুক্ত হয়েছে। কেন? কারণ শ্রমিক শ্রেণী প্রথমে বুঝতে পারেনি শ্রমিক শ্রেনীর একটা অংশ নারী আইনত সামাজিকভাবে সবচেয়ে বঞ্চিত, শতাব্দী ধরে তাকে চোখ রাঙ্গানো হয়েছে, ভয় দেখান হয়েছে, শাস্তি দেওয়া হয়েছ। তাই নারীর হৃদয় মনকে নাড়া দেওয়ার জন্য বিশেষ পদ্ধতি দরকার ছিল, নারী বুঝে এমন শব্দ ব্যবহারের প্রয়োজন ছিল। শ্রমিকরা সহসা বুঝতে পারেননি যে নারী শুধু অধিকারহীনতা, শোষণ, শ্রম বিক্রিজনিত কারনেই শুধু শোষিত নয় সে মা হিসাবে নারী হিসাবেও শোষিত। কিন্তু শ্রমিক শ্রেনীর সমাজতান্ত্রিক দল যখন বুঝতে পারল তারা নারীর তারা নারীর ভারাটে শ্রমিক এবং মা বা নারী দুই স্বত্বাকে রক্ষার সাহসী পদক্ষেপ নিল। সমাজতন্ত্রিরা প্রত্যেক দেশেই নারীর বিশেষ অধিকারের দাবী তুলে ধরা শুরু করল। নারী শ্রম, মাতৃত্ত্বের রক্ষাকবচ ও শিশু শ্রম, নারীর রাজনৈতিক অধিকার এবং নারীর স্বার্থ।

নারীর দ্বিতীয় বাস্তবতাকে যত স্পস্ট পার্টি বুঝতে পারল তত নারী পার্টিতে যুক্ত হওয়া শুরু করল। নারী শ্রমিক সংগঠিত সচেতন হয়ে নিজেরাই এই বাস্তবতাকে অনেকটাই স্পস্ট করল। এখন সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে শ্রমজীবি নারীদের টানার মূল দায়িত্ব নারীদেরই। প্রত্যেক দেশের পার্টিতে নারীর বিশেষ কমিটি, সম্পাদকীয় এবং ব্যুরো আছে। এই কমিটিগুলো এখন অনেকাংশে রাজনৈতিকভাবে অসচেতন নারীদের মধ্যে কাজ করে তাদের সচেতন শ্রমিক হিসাবে সংগঠিত করে। এই কমিটিগুলো সে সমস্ত প্রশ্ন এবং দাবীগুলো যাচাই করে যেগুলো ঘনিষ্ঠভাবে নারী সুরক্ষাকে প্রভাবিত করে এবং সেই আইনগুলো যেগুলি সন্তানসম্ভবা এবং যে সন্তান জন্ম দিয়েছে, নারী শ্রম, যৌনবৃত্তির বিরুদ্ধে, শিশু মৃত্যুর বিরুদ্ধে, নারীর রাজনৈতিক অধিকারের জন্য, উন্নত বাসস্থানের জন্য এবং জীবনযাপনে ব্যয় বৃদ্ধির বিরুদ্ধে। এভাবে সাধারণ শ্রেনী স্বার্থে এবং একইসাথে নারী, গৃহিনী এবং মা হিসাবে যে বিষয়সমুহ সবচেয়ে প্রভাবিত করে সেগুলো নিয়ে নারী লড়াই করছে। পার্টি দাবীগুলোকে সমর্থন করছে এবং তাদের জন্য লড়াই করছে। শ্রমজীবী নারীর স্বার্থের সাথে শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থ একাকার।

নারী দিবসে নারীর অধিকারহীনতার বিরুদ্ধে সংগঠিত বিক্ষোভ। কিন্তু কেউ কেউ বলবে কেন শ্রমজীবি নারীদের আলাদা করে দেখা? কেন বিশেষভাবে নারী দিবস, কেন নারীদের জন্য বিশেষ লিফলেট, শ্রমজীবী নারীর সভা, কনফারেন্স? শেষ বিচারে কি এটা নারীবাদীদের এবং বুর্জোয়া ভোটাধিকার আন্দোলনের কাছে ছাড় দেয়া নয়? তারাই এভাবে শুধু ভাবতে পারে যারা সমাজতান্ত্রিক নারী আন্দোলন আর বুর্জোয়া ভোটাধিকারের আন্দোলনের মধ্যে যে পার্থক্য করতে ব্যর্থ হয়।

নারীবাদীদের লক্ষ্য কি? পুঁজিবাদি সমাজের ভিতরে থেকে তাদের স্বামি, পিতা ভাই যে সুবিধা, ক্ষমতা অধিকার ভোগ করছে একই সুবিধা আদায় হচ্ছে তাদের লক্ষ্য। শ্রমজীবি নারীদের লক্ষ্য কি? তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে জন্মের কারনে বা সম্পত্তির কারনে মানুষ যে সুবিধাদি প্রাপ্ত হয় তা বিলুপ্ত করা। পুরুষ নাকি নারী কর্তৃত্ব করছে শ্রমজীবি নারীর কাছে তা বড় প্রশ্ন নয়। সমগ্র শ্রেনীর স্বার্থে শ্রমিক হিসাবে সে তার অবস্থান ছেড়ে দিতে পারে।

নারীবাদী সকল সময় সর্বত্র সমান অধিকার দাবী করে। শ্রমিক শ্রেনীর নারীর জবাব হচ্ছে আমরা নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকল নাগরিকের অধিকার চাই। আমরা এটা ভুলে যেতেও রাজি নয় যে আমরা শুধু শ্রমিক এবং নাগরিক নয় আমরা একই সাথে মা এবং মা হিসাবে নারী হিসাবে ভবিষ্যতকে জন্ম দেই তাই আমাদের এবং সন্তানদের নিয়ে আমাদের বিশেষ দাবী আছে। রাষ্ট্র এবং সমাজ থেকে বিশেষ সুরক্ষার দাবী।
নারীবাদিরা রাজনৈতিক অধিকারের জন্য লড়াই করছে। এখানেও আমাদের পথ ভিন্ন। বুর্জোয়া নারীর রাজনৈতিক অধিকার মানে শ্রমিকশ্রেনীকে শোষনের উপর প্রতিষ্ঠিত দুনিয়ায় তাদের সুবিধাজনক অধিক নিরাপদ অধিকার। অন্যদিকে শ্রমিক শ্রেনীর নারীর অধিকার মানে প্রস্তরময় এবং কঠিন পথে নিজেদের পরিচালিত করে শ্রমিক রাজ কায়েম করা।

বুর্জোয়া ভোটাধিকারের জন্য যারা লড়ছে তাদের সাথে শ্রমিক শ্রেনীর নারীর যোজন যোজন দূরত্ত্ব। তাদের উদ্দেশ্যের মধ্যে বিড়াট পার্থক্য। শ্রমিক শ্রেনীর নারী এবং সম্পত্তিবান নারীর স্বার্থের মধ্যে, মালকিন এবং চাকরানির স্বার্থের মধ্যে বিশাল দ্বন্দ্ব। তাদের মধ্যে সংযোগ, সমঝোতা, মিলন কোনটাই হয় না হতে পারে না। সুতরাং, শ্রমিক পুরুষকে আলাদা নারী দিবস নিয়ে ভীত হবার কিছু নেই, কিছু নেই আলাদা নারী কনফারেন্স অথবা বিশেষ সংবাদ মাধ্যমের।
শ্রমিক শ্রেনীর নারীর প্রত্যেকটা বিশেষ, বিশিষ্ট কাজ শ্রমজীবি নারীদের সচেতন করে উন্নত ভবিষ্যত নির্মানের আন্দোলনে সামিল করার জন্য প্রয়োজন। নারী দিবস, ধীর, স্পস্ট যে কাজের মাধ্যমে নারীর আত্নসচেতনতা বৃদ্ধি হবে সকলই শ্রমিক শ্রেনীর স্বার্থে, শ্রমিক শ্রেনীর ঐক্যবদ্ধতার জন্য বিচ্ছিন্নতার জন্য নয়। আসুন আমরা সাধারন শ্রেনী স্বার্থে এবং একই সাথে নারী মুক্তির লক্ষ্যে শ্রমজীবি নারীদের নারীদিবস উদযাপনে উৎসাহিত করি।
#
লেখাটি ১৯১৩ সালে প্রাভদায় প্রকাশিত হয়।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ