সিলেট ১০ই জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৬শে পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ২:২৯ অপরাহ্ণ, জুন ২১, ২০২০
রাশেদ খান মেনন | ২১ জুন ২০২০ : করোনাকালে চলে গেলেন কামাল লোহানী। শেষ পর্যন্ত করোনা তাকে পরাজিত করল। অবশ্য বার্ধক্যজনিত অনেক সমস্যাই তার দেহে বাসা বেঁধেছিল। কিন্তু ঐসব রোগের সঙ্গে লড়াই করে প্রতিবারই তিনি জীবনে ফিরে এসেছেন। এবারও সে রকমই আশা করেছিলাম। কিন্তু করোনা সংক্রমণ ঐসব রোগকে প্রকট করে তাকে জীবনে ফিরতে দিল না। কেবল এই ক্ষেত্রেই নয়, জীবনের সব ক্ষেত্রেই ছিলেন তিনি লড়াকু ব্যক্তিত্ব।
আজীবন সংগ্রামী এই মানুষটির পুরো নাম ছিল আবু নঈম মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল খান লোহানী। তার জন্ম সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া থানার খান সনতলা গ্রামে ১৯৩৪ সালের ২৬ জুন। মাকে হারান মাত্র ৬-৭ বছর বয়সে। এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকার মধ্যেই তার স্কুলজীবন শুরু হয়। ১৯৪৮ সালে চলে আসেন পাবনায়। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের বছরই মাধ্যমিক পরীক্ষা পাস করেন। ভাষা আন্দোলনেই তার রাজনীতির শুরু। এরপর পাবনার এডওয়ার্ড কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ইতি টানেন। রাজনীতি, সাংবাদিকতা ও সংস্কৃতিচর্চা মনপ্রাণ ঢেলে দিয়ে কাজ করতে থাকেন।
১৯৫৩ সালে পাবনার তৎকালীন জিন্নাহ্ পার্কে মুসলিম লীগের কাউন্সিল অনুষ্ঠানে নুরুল আমীনের আগমনের প্রতিবাদে যে শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদী বিক্ষোভ করেন, তাদেরই একজন ছিলেন কামাল লোহানী। পাবনার রাজনৈতিক নেতা, এডওয়ার্ড কলেজের অধ্যাপক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কামাল লোহানীও গ্রেপ্তার হন। এরপর একাধিকবার তার জায়গা হয় জেলখানায়।
এভাবে স্কুল পাস করার সময় ভাষা আন্দোলনে যোগদান করে তার যে রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় তা অব্যাহত থাকে আজীবন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের পক্ষে কাজ করেন। ১৯৫৪ সালের ২৯ মে ৯২-(ক) ধারা দিয়ে পূর্ববাংলায় ‘গভর্নরের শাসন’ চালু করার পর আবার ধরপাকড় শুরু হয়। এ সময় আবার গ্রেপ্তার হন তিনি। ১৯৫৫ সালের জুলাই মাসে ছাড়া পান। বাড়িতে পড়াশোনা নিয়ে মতবিরোধ হয়। ছোট চাচা তাসাদ্দুক লোহানীর কাছ থেকে ১৫ টাকা নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। শুরু হয় জীবনসংগ্রাম। তিনি ততদিনে মার্ক্সবাদের অনুসারী হয়ে উঠেছেন। শুরু হয় সাংবাদিকতার জীবন। ১৯৫৫ সালে যোগ দেন দৈনিক ‘মিল্লাত’ পত্রিকায়। ইতিমধ্যে গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাপ গঠিত হলে যোগ দিয়েছেন তাতে।
গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কর্মী হিসেবে যেমন, তেমনি সাংবাদিকতায়ও তিনি বিশিষ্ট হিসেবে পরিচিত হন। বাষট্টির সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে আবার জেলে। এর আগে আইয়ুবের রবীন্দ্রবিরোধী চক্রান্তের বিরোধিতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মশতবার্ষিকী পালনে রাখেন বিশিষ্ট ভূমিকা। সংস্কৃতি জগতে কেবল নাটকেই বিশিষ্ট নন, নৃত্যে ও নৃত্যনাট্যে হয়ে ওঠেন অনন্য। এ দেশের প্রথিতযশা সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ছায়ানট গড়ে তুলতে যেমন ভূমিকা রাখেন, তেমনি রাজনৈতিক মতান্তরের কারণে গড়ে তোলেন ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠী। এই ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠীই ষাটের দশকে গণসঙ্গীত, গণনাট্য ও গণধর্মী নৃত্যনাট্য প্রসারে বিশিষ্ট ভূমিকা রাখে। ঢাকার পল্টন ময়দানে নৃত্যনাট্য ‘আলোর পথ যাত্রী’ লাখো মানুষকে মাতিয়েছিল।
ষাটের দশকের শেষভাগে এসে মস্কো-পিকিং প্রশ্নে কমিউনিস্ট পার্টি বিভক্ত হলে তিনি পিকিং অংশে অবস্থান নেন। সে সময় তার নয়া পল্টনের বাসা যেমন ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠীর কেন্দ্র ছিল, ছিল আমাদের মতো কমিউনিস্ট কর্মীদের আড্ডার জায়গা।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে অনন্য ভূমিকা রাখেন কামাল লোহানী। এই সময় চিত্রপরিচালক জহির রায়হানসহ তিনি ‘কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি’র বুদ্ধিজীবী সেলে অন্তর্ভুক্ত হয়ে কাজ করেন।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি দেশে ফিরে বাংলাদেশ বেতার পুনর্গঠন করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে ঢাকায় ফিরে এলে তিনি সেই স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ঘটনার সরাসরি ধারা বিবরণী দেন রেডিওতে। পরে তিনি আবার সাংবাদিকতায় ফিরে আসেন এবং প্রথমে সাপ্তাহিক নয়াযুগ ও দৈনিক বঙ্গবার্তা গড়ে তুলতে কাজ করেন।
বাকশাল গঠন করা হলে সাংবাদিকদের মধ্যে কামাল লোহানী, নির্মল সেন, কবি শামসুর রাহমানসহ তাতে যোগ দিতে অস্বীকার করেন। পঁচাত্তর পরবর্তীকালে রাজশাহী থেকে প্রকাশিত ‘দৈনিক বার্তা’র সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। তবে বিএনপির তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে মতান্তর হওয়ায় ‘দৈনিক বার্তা’ ছেড়ে দেন। আশির দশকে সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রামে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের হয়েও তিনি অনন্য ভূমিকা রাখেন। এ কারণে এরশাদের পতনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাকে শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয়। কিন্তু এবারও বিএনপির সংস্কৃতিমন্ত্রীর সঙ্গে মতবিরোধ হওয়ায় ঐ পদ ছেড়ে দেন। শেখ হাসিনার সরকার তাকে পুনরায় শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয়।
কিন্তু প্রথাবিরোধী কামাল লোহানী আবার সাংস্কৃতিক ও সাংবাদিকতার জীবনে ফিরে আসেন। এই সময়কালে তিনি পত্র-পত্রিকায় কলাম লেখার পাশাপাশি ওয়ার্কার্স পার্টির মুখপত্র সাপ্তাহিক ‘নতুন কথা’র উপদেষ্টা সম্পাদকের দায়িত্ব নেন এবং পত্রিকাটিকে নতুন রূপ দেন।
কামাল লোহানী পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ গণশিল্পী সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করলেও শেষদিকে সংগঠনটি নিয়ে তার সাংগঠনিক অতৃপ্তি কাজ করছিল। এ সময় ‘উদীচী’ তাকে সভাপতি করে তাদের সংগঠনে নিয়ে যায় এবং জানা যায় এই সময় সিপিবিও তাকে তাদের পার্টির সদস্যপদ দেয়।
শেষ দিকে তার চোখ নষ্ট হয়ে যাওয়ার পরও তিনি তার কলাম লেখার কাজ অব্যাহত রেখেছিলেন। আর মাঠে সক্রিয় ছিলেন সাম্প্রদায়িকতাবিরোধিতা ও ধর্মীয় রাজনীতির বিরুদ্ধে। সারা জীবনের লড়াকু যোদ্ধা কামাল লোহানী শেষ পর্যন্ত করোনা সংক্রমণে চলেই গেলেন। তবে বাংলাদেশের সংস্কৃতি জগৎ ও সাংবাদিকতার জগৎই কেবল নয়, দেশের অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাজনীতি তাকে স্মরণ করবে চিরকাল।
#
লেখক
সংসদ সদস্য এবং সভাপতি বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি
সম্পাদক : সৈয়দ আমিরুজ্জামান
ইমেইল : rpnewsbd@gmail.com
মোবাইল +8801716599589
৩১/এফ, তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০।
© RP News 24.com 2013-2020
Design and developed by M-W-D