মার্কিন নিষেধাজ্ঞাকে পাশ কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানো দেশগুলো

প্রকাশিত: ৬:৩৭ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২৩

মার্কিন নিষেধাজ্ঞাকে পাশ কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানো দেশগুলো

অনামিকা নাহারিন |

কোনো দেশের ওপর বিদেশি হস্তক্ষেপ সমস্যাকে আরো জটিল করে, সমাধান করে না। অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন দেশ, দেশের ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের উপর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে আসছে। বিভিন্ন দেশের উপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এ অবরোধ নতুন কিছু নয়। এই অবরোধের মাধ্যমে একটি দেশকে কীভাবে কোণঠাসা করা যেতে পারে বা অর্থনৈতিক কঠিন অবস্থার মাঝে ফেলা যেতে পারে সেই কৌশল যুক্তরাষ্ট্র ভালো করেই জানে।

বিভিন্ন সময় যুক্তরাষ্ট্র দেশ হিসাবে ইরান, উত্তর কোরিয়া, রাশিয়া, কিউবা, সিরিয়া, ভেনেজুয়েলার ওপর ব্যাপক আকারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। তবে দেশ ভেদে এসব নিষেধাজ্ঞার প্রকৃতি আলাদা। এসব দেশের সরকার বা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কোন মার্কিন প্রতিষ্ঠান কোনরকম লেনদেন বা বাণিজ্য করে না। এমনকি অন্য দেশগুলো যাদের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের ভালো সম্পর্ক তারাও নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা এ দেশগুলোর সাথে বাণিজ্য করতে পারে না।

মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে এসব দেশ বিশেষ করে ইরান বা ভেনেজুয়েলার অর্থনীতি একপ্রকার বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু বর্তমানে কেমন আছে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা সেসব দেশ? অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার বলয় থেকে বের হয়ে দেশগুলো কি ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছে?

ইরান যেভাবে নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে নিজের দেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণ হিসেবে গড়ে তুলছে:

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার প্রভাব কমাতে ইরান সব সময় চেষ্টা করেছে বাণিজ্যিক সহ অন্যান্য ক্ষেত্রে নতুন একটি বলয় তৈরি করতে। আর এই উদ্যোগে ইরান সবসময় পাশে পেয়েছে চীন এবং রাশিয়াকে। এছাড়াও আর্থিক লেনদেন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মাধ্যমেও চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছে। ইরানের তেল আয়ের সিংহভাগ চীন থেকে। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্র চীনকেও নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনার পরিকল্পনা করে। কিন্তু চীন আনুষ্ঠানিকভাবে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেই ইরানি অপরিশোধিত তেল আমদানির ঘোষণা দিয়েছে।

নিজ দেশেই অনেক প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন করছে ইরান। এর ফলে অন্যান্য দেশের উপর তাদের পরনির্ভরশীলতা কমে গেছে। অন্যদিকে আমদানিকৃত পণ্যের ঘাটতি থাকায় দেশীয় উৎপাদন বেড়েছে। আর এভাবেই ইরানিদের জন্য আরও কর্মসংস্থান তৈরি করতে পেরেছে দেশটি। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের এত অবরোধের পরেও অনেক ক্ষেত্রেই এই সকল অবরোধের প্রভাব কাটিয়ে উঠা সম্ভব হয়েছে।

এছাড়া ডলার সংকট এড়াতে ইরান নিজেদের বাণিজ্যিক রপ্তানি খাতসহ পর্যটন শিল্প এবং শিক্ষা খাতকে গুরুত্ব দিচ্ছে। ইরানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং পর্যটন কেন্দ্রগুলোকে ঘিরে বিদেশি পর্যটকদের কীভাবে আকৃষ্ট করা যায় তা নিয়ে ইরানের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা সচেষ্ট ভূমিকা পালন করছেন। এছাড়াও ইরানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পড়াশোনার মান বৃদ্ধি করে ওয়ার্ল্ড র‍্যাংকিংয়ে নিয়ে এসে সেখানে বিদেশি শিক্ষার্থীদের পড়তে আগ্রহী করে ডলারের মাধ্যমে টিউশন ফি নিয়ে নিজেদের ডলার সঞ্চয়কে বৃদ্ধি করতে তারা নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছে।

এর পাশাপাশি ইরান চিকিৎসা ব্যবস্থাকেও বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় অব্যাহত রয়েছে। যার ফলে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনেকেই বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় ইরানকে বেঁছে নিচ্ছে। ইরান সরকার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে নিজেদের সর্বোচ্চ সক্ষমতা দিয়ে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থাকে পৃথিবীর বুকে একটি স্থিতিশীল অবস্থায় নিয়ে যেতে, আর এখানে তারা সফলতার মুখও দেখেছে।

নিষেধাজ্ঞার বলয় থেকে বেড়িয়ে কিউবার উন্নতি:

কিউবার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অবরোধের ৬ দশক পেড়িয়ে গেছে। এই নিষেধাজ্ঞার সূত্রপাত হয়েছিল মিসাইল সংকটের সময়, যেটিকে যুক্তরাষ্ট্র নিজের ক্ষমতাবলে গণবিধ্বংসী বলে আখ্যা দিয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের নাম-নিশানা নেই এখন। আর এত সময়কাল পর শত আঘাতেও ঘুরে দাঁড়িয়েছে লাতিন আমেরিকার এই দেশটি।

২০১৫ সালের দিকে আমেরিকা-কিউবা দুই দেশের দূতাবাসের পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়। চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র ও জটিল রাজনৈতিক ইতিহাসকে সরিয়ে রেখে আগামী দিনে নতুন মৈত্রীর রূপরেখা তৈরির অঙ্গীকারও করে দুই দেশের দুই রাষ্ট্রপ্রধান রাউল কাস্ত্রো ও বারাক ওবামা। এটিও একটি জয় কিউবার মহান বিপ্লবের, কারণ ওবামাও বাধ্য হয়েছিলেন কিউবাকে কুর্নিশ জানাতে।

কিউবা এখনো যুক্তরাষ্ট্রের শ্বাসরোধকারী নিষেধাজ্ঞার আওতায় রয়েছে। দেশটির খবর জানতে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমের ওপর নির্ভর করতে হয়। কিন্তু তাদের কাছ থেকে কিউবার কোনো বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পাওয়া কঠিন। বিগত কয়েক দশক ধরেই তাদের প্রধান কাজ হলো কিউবার বিপ্লব, শাসনব্যবস্থার ও ফিদেল ক্যাস্ত্রোর বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা ছড়ানো। তাদের দৃষ্টিতে কিউবার কোনো সাফল্য ও অর্জন নেই, কোনো ইতিবাচকতা নেই।

কিন্তু বর্তমান বাস্তবতা ভিন্ন। ছয় দশক ধরে মার্কিন ও তার মিত্রদের অবরোধের মধ্যে থাকা কিউবার সংকট যতটা বেশি থাকার কথা ততটা কিন্তু নেই। অনেক সংকটের মধ্যেও কিউবা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, শিল্প, মানবিক ও সামাজিক উন্নয়নে অভূতপূর্ব অগ্রগতি ঘটিয়েছে। বিশ্বের দুইশ দেশের মধ্যে মানবিক উন্নয়নে তাদের অবস্থান ৭০তম।

মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর যেভাবে ঘুরে দাঁড়লো ভেনেজুয়েলা:

ভেনেজুয়েলার ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির তেল কোম্পানির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারির মাধ্যমে মার্কিন সরকার চেয়েছিল ভেনেজুয়েলার ওপর অর্থনৈতিক চাপ বাড়াতে। কিন্তু প্রায় প্রতিটি আরব বিশ্বের বুকে খনিজ তেলের বড় বড় মজুদ থাকলেও বিশ্বের সবচেয়ে বড় জ্বালানি তেলের মজুদটি ভেনেজুয়েলার। যুক্তরাষ্ট্র জ্বালানি বিভাগের মতে, বিশ্বের সবচেয়ে বেশি জ্বালানি তেলের মজুদ আছে ভেনেজুয়েলায়। পরিমাণের দিক দিয়ে তা ৩,০০,৮৭৮ মিলিয়ন ব্যারেল।

কিন্তু ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার পর সংকটপূর্ণ এই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র নিজেই পরবর্তীতে ভেনেজুয়েলার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নটা করতে চায়। তেলসম্পদে সমৃদ্ধ দেশটির উপর বাইডেন প্রশাসন এ কারণে তাদের উপর আরোপ করা নিষেধাজ্ঞাগুলিও কিছুটা শিথিল করে। কিন্তু ভেনেজুয়েলা যুক্তরাষ্ট্রের উপরে আস্থা না রাখতে পেরে বন্ধু হিসাবে চীনকেই বেছে নিয়েছে।

ইতোমধ্যেই মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় জর্জরিত দুই দেশ ইরান ও ভেনেজুয়েলা নিজেদের মধ্যে ২০ বছরের একটি সহায়তা চুক্তি করেছে। জ্বালানি তেল, প্রতিরক্ষা, কৃষি, পর্যটন, সংস্কৃতি ও প্রযুক্তি খাতে সহায়তার বিষয় উল্লেখ করা হয় চুক্তিতে।
নিষেধাজ্ঞার কারণে অর্থনৈতিক দৈন্যদশা থাকলেও ক্রমেই তা কাটিয়ে উঠছে দেশটি।

যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কোনো প্রভাব পড়েনি নাইজেরিয়ায়:

নাইজেরিয়ায় ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেয়ার সময় দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোটারদের ভয় দেখানো, নির্বাচনের ফলাফল কারচুপি ও গণতন্ত্রবিরোধী কর্মকান্ডের জন্য কিছু ব্যক্তির বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। সর্বশেষ গত ১৫ মে নাইজেরিয়ার ওপর আরেক দফা নিষেধাজ্ঞা দেয় আমেরিকা।

২০১৯ সালের নির্বাচনের এক মাস আগে যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা করেছিল নাইজেরিয়ায় নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে এর সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ হবে। ওই বছর সাধারণ ও স্থানীয় দুই নির্বাচনের (২০১৯ ও ২০২০ সালে) পর দুই দফায় কিছু ব্যক্তির ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল আমেরিকা।

কয়েকজন ব্যক্তির ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিলেও নাইজেরিয়ার রাজনৈতিক পরিস্থিতির তেমন পরিবর্তন হয়নি বলে আন্তজার্তিক সংবাদ মাধ্যম জানিয়েছে। কারণ যাদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছিল তাদের নাম প্রকাশ করা হয়নি। ফলে তাদের পরিচয় কেউ জানে না।

২০১৯ সালে ভিসা নিষেধাজ্ঞার পরও ২০২৩ সালে নাইজেরিয়ার নির্বাচনে ব্যাপক সহিংসতা হয়েছে, নাগরিকদের ভয় দেখানো ও সহিংসতা উস্কে দেয়ার অভিযোগ উঠে প্রশাসনের বিরুদ্ধে।

রাশিয়া যেভাবে পাত্তাই দেয় না মার্কিনি নিষেধাজ্ঞাকে:

পশ্চিমা বিশ্বের সব রকমের হুমকি-ধমকির কোনোরকম তোয়াক্কা না করে রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণ করেই বসেছে। পশ্চিমা বিশ্বের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ মোটেই নতুন কোনো পদক্ষেপ নয়। এসব নিষেধাজ্ঞার কারণে সেসব দেশগুলোর সাময়িক কিছু অসুবিধা হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সার্বিক অর্থে সবকিছুই চলছে স্বাভাবিকভাবে। ২০১৪ সালে রাশিয়া যখন ক্রিমিয়া তাদের দখলে নেয় তখনও আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্বের অনেক দেশই রাশিয়ার ওপর আংশিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রেখেছে। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞায় যদি তেমন কোনো কাজ হতো তাহলে রাশিয়া আরও বড় ধরনের নিষেধাজ্ঞার ভয়ে ইউক্রেন আক্রমণ করার ঝুঁকি নিত না।

পশ্চিমা দেশগুলোর প্রবল নিষেধাজ্ঞাকে পাশ কাটিয়ে রাশিয়ার মুদ্রা রুবল বেশ নাটকীয়ভাবে শক্তি ফিরে পেয়েছে। এরই মধ্যে রাশিয়া ডিজিটাল রুবলের মুদ্রার বিকাশকে ত্বরান্বিত করাতে উদ্যোগী হয়েছে। ডিজিটাল মুদ্রার উদ্যোগটি বিশ্বব্যাপী অন্যান্য ২০টি দেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যারা এরই মধ্যে পাইলট ডিজিটাল মুদ্রা প্রোগ্রাম শুরু করেছে। ডিজিটাল রুবল আনার প্রাথমিক উদ্দেশ্য হল রাশিয়ার আর্থিক নমনীয়তা বাড়ানোর পাশাপাশি পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞাসহ আন্তর্জাতিক বিধিনিষেধের প্রভাব কমানো।

এছাড়া, রাশিয়ার কাছ থেকে ইউরোপের দেশগুলো যে গ্যাস ও তেল ক্রয় করে সেটির মূল্য পরিশোধ করা হতো ইউরোতে। রাশিয়ার সাথে এটাই ছিল তাদের চুক্তি। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পরে রাশিয়া বলেছে যে তাদের কাছ থেকে যারা তেল গ্যাস ক্রয় করবে, সেটির মূল্য পরিশোধ করতে হবে রাশিয়ার মুদ্রা রুবলের মাধ্যমে। এর ফলে ইউরোকে রুবলে পরিবর্তন করা হয়। ব্লুমবার্গ বলেছে, এ কারণে রাশিয়ার মুদ্রা রুবল শক্তিশালী হয়েছে। তাছাড়া চীন এবং ভারতের কাছে জ্বালানী বিক্রির মাধ্যমে রাশিয়ায় বৈদেশিক মুদ্রাও আসছে।

 

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ