বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি

প্রকাশিত: ৯:৪৩ পূর্বাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২৪

বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি

Manual1 Ad Code
অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ |

‘মোদের গরব মোদের আশা আ-মরি বাংলা ভাষা’- অতুলপ্রসাদ সেনের এই গানের কথা প্রতিটি বাঙালিরই মনের কথা। মা, মাটি আর মুখের বোল- এই তিনে মনুষ্য জন্মের সার্থকতা। নিজের মুখের ভাষার চেয়ে মধুর আর কিছু হতে পারে না। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পর পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী সচেতনভাবে বাঙালির কাছ থেকে ভাষার অধিকার হরণ করতে চেয়েছিল। তারা চেয়েছিল সংখ্যালঘু জনগণের ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দিতে। কিন্তু তাদের সেই অপতৎপরতার বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন বাঙালির ত্রাণকর্তা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আজীবন মাতৃভাষাপ্রেমী এই মহান নেতা ১৯৪৭ সালে ভাষা আন্দোলনের সূচনা পর্বে ১৯৪৮ সালে রাজপথে আন্দোলন ও কারাবরণ, পরে আইনসভার সদস্য হিসেবে রাষ্ট্রভাষার সংগ্রাম ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় অতুলনীয় ভূমিকা রাখেন। এক কথায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার আন্দোলন ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর সক্রিয় অংশগ্রহণ ইতিহাসের অনন্য দৃষ্টান্ত।

২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশসহ পশ্চিমবঙ্গ তথা সব বাংলা ভাষা ব্যবহারকারী জনগণের গৌরবোজ্জ্বল একটি দিন। এটি শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবেও সুপরিচিত। ভাষার জন্য ১৯৫২ সালে বাঙালীর দেওয়া রক্ত আজ বিশ্বের কাছে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। যা সম্ভব হয়েছে জাতির পিতা ভাষাসৈনিক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্যকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্বের গুণে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ উদ্যোগ ইতিহাস আবহমানকাল শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে। ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। সেজন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারের আন্তরিক সহযোগিতা ও যথেষ্ট অবদান রয়েছে। মনে হতে পারে যে, এ সবই ঘটে গেছে রাতারাতি। কিন্তু এ দিনটিকে ইউনেস্কোর কাছে তুলে ধরতে, তাৎপর্য বোঝাতে, বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে নিতে জননেত্রী শেখ হাসিনার যে কত প্রতিকূলতা পার হতে হয়েছে, কত কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে, স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কতটা কাজ করতে হয়েছে, তা অনেকেরই অজানা। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রথমবার দায়িত্ব পালনের সময় (১৯৯৬-২০০১) জননেত্রী শেখ হাসিনা একুশে ফেব্রুয়ারি এবং বাংলা ভাষা আন্দোলনকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।

২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করার জন্য উদ্যোগ নিয়েছিলেন কানাডার দুজন বাঙালি প্রবাসী রফিকুল ইসলাম এবং আবদুস সালাম। তবে জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট সংস্থা বেসরকারি ব্যক্তিদের কাছ থেকে এ প্রস্তাব গ্রহণ করতে পারেনি। অনুরোধ/প্রস্তাব একটি সদস্য রাষ্ট্র থেকে জমা দিতে হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন এই বিষয়টি জানতে পেরেছিলেন, তখন খুব বেশি সময় বাকি নেই। হাতে ছিল মাত্র ২৪ ঘণ্টা। আওয়ামী লীগ সরকার তখন প্রবাসীদের নেতৃত্বাধীন ‘মাতৃভাষা সংরক্ষণ কমিটি’র সঙ্গে যোগাযোগ এবং প্রস্তাবনাটি ১৯৯৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ইউনেস্কোর কাছে প্রেরণ করে। জরুরি ভিত্তিতে আমাদের মিশনগুলোকে অন্য সদস্য দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগের জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল, পাশাপাশি এই প্রস্তাবটির জন্য তাদের সমর্থন চাওয়া হয়েছিল। ফলস্বরূপ ’৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কোর সাধারণ সম্মেলনে প্রস্তাবটি পাস হয়। পরের বছর অর্থাৎ, ২০০০ সাল থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে।

১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘের শিক্ষা-বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা, ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ২০০০ সাল থেকে বিশ্বের ১৮৮টি দেশে দিনটি পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবেই। কারণ, এ তো শুধু বাংলা ভাষার আন্দোলন নয়, মায়ের ভাষা, গানের ভাষা, আবেগের ভাষা, সাহিত্যের ভাষা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা। ভাষার ঐক্য, সম্প্রীতি, ভাষার মৌলিক অধিকার শিক্ষা, মানসিক ও নৈতিক বিকাশ এবং সর্বোপরি মাতৃভাষার প্রতি ভালবাসা- এই দিকগুলোর প্রতি নজর রাখার সময় এসেছে। বাংলাদেশ ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গ, কমবেশি অসাম, ত্রিপুরা, মণিপুর, বিহার, ঝাড়খন্ড ও ওড়িশা রাজ্য, মিয়ানমারের আরাকান অঞ্চলের রোহিঙ্গারাও বাংলা ভাষায় কথা বলেন। আফ্রিকার সিয়েরা লিয়েনে বাংলা হলো দ্বিতীয় সরকারি ভাষা। তথ্য প্রদানের উদ্দেশ্য এই নয় যে, অন্যভাষীদের কাছে বাংলাভাষার গুরুত্ব বা প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা। পরিবর্তে শুধু এই বিষয়টার প্রতি নজর দেওয়া যে, বিভিন্নভাষীর যত মাতৃভাষা রয়েছে সেগুলোর গুণমান ও উৎকর্ষের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ।

Manual3 Ad Code

নিজের ভাষা নিয়ে বাঙালির গর্ব যতই থাক, পরিস্থিতির চাপে সেই ভাষার সর্বাত্মক চর্চায় বাঙালি প্রায় ব্যর্থ। বাংলার প্রতি অবহেলা কেন? উপলব্ধির অন্তর্লোকে উঁকি দিলে দেখা যাবে এই অবহেলার মূল কারণ প্রতিযোগিতা আর পেশার তাড়না। যার সামর্থ্য বা সুযোগ আছে নিজের সন্তানকে বাংলা মাধ্যমের বদলে ইংরেজি মাধ্যমে লেখাপড়া শেখানোর প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এই অবস্থাটা যেমন সত্যি, তেমনি এটাও সত্যি যে, দেশের বেশির ভাগ মানুষ প্রায় সব ক্ষেত্রেই বাংলানির্ভর। সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চার মাধ্যমও বাংলাই।

Manual6 Ad Code

বাংলাকে শিক্ষা ও পেশার প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যবহার্য করে তোলার প্রয়াস আমরা প্রায় হারিয়ে ফেলেছি। ফলে, কেউ চাইলেই বিজ্ঞান, চিকিৎসাবিদ্যা, কারিগরি বা প্রযুক্তিবিদ্যা, আইন বা অন্য কোনো বৃত্তিমূলক শিক্ষা বাংলায় শেখানো সম্ভব নয়। ইংরেজির বাইরে রুশ, জার্মান, জাপানি, স্প্যানিশ, ফরাসি ইত্যাদি ভাষায় প্রায় সব ধরনের উচ্চশিক্ষার সুযোগ রয়েছে। নিজেদের মাতৃভাষাকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রের ব্যবহার্য ভাষা করে তুলতে পেরেছেন তারা। নিজ ভাষায় বিজ্ঞানের গবেষণাপত্র প্রকাশ করতে পারছেন। মাতৃভাষায় স্বচ্ছন্দে প্রকৌশলবিদ্যা পড়তে পারছেন। কারণ, ভাষাগুলো সেসবের উপযুক্ত হয়ে উঠেছে দিনে দিনে। আমরা মাতৃভাষা বাংলাকে নিয়ে সেভাবে এগিয়ে যেতে পারিনি।

Manual3 Ad Code

আমাদের স্বকীয় চেতনা নিয়ে এগিয়ে যেতে হলে বাংলাকে স্বয়ংসম্পূর্ণতার পথে নিয়ে যেতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে উচ্চশিক্ষা বা পেশার ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা ব্যবহার করতে চাইলে তার উপযুক্ত পরিভাষাকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। সেই শপথ নিয়ে যদি এগোনো যায়, তাহলেই বাংলা সর্বস্তরে ব্যবহারযোগ্য ভাষা হয়ে উঠতে পারবে। সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন বাস্তবায়ন করা গেলেই ভাষা শহীদদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা জানানো সার্থক এবং বাংলা ভাষার মর্যাদা সমুন্নত হবে।

Manual6 Ad Code

লেখক : অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ
ভাইস চ্যান্সেলর, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

 


Manual1 Ad Code
Manual4 Ad Code