বিশ্ব শোভন কর্ম দিবস ও আমাদের করণীয়

প্রকাশিত: ৯:২০ পূর্বাহ্ণ, অক্টোবর ৭, ২০২৪

বিশ্ব শোভন কর্ম দিবস ও আমাদের করণীয়

Manual8 Ad Code

সৈয়দ আমিরুজ্জামান |

সভ্যতার নির্মাতা ও অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি শ্রমিক শ্রেণির শোভন কাজ ও সামাজিক ন্যায় বিচার নিশ্চিত করার নিমিত্তে ৭ অক্টোবর পালিত হচ্ছে বিশ্ব শোভন কর্ম দিবস।
শ্রমজীবী মানুষের উন্নত ও মর্যাদাপূর্ণ জীবন–যাপন এবং ন্যায় ভিত্তিক কর্মসংস্থানের গুরুত্বের ওপর আলোকপাত করে বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর ৭ই অক্টোবর শোভন কর্ম দিবস হিসাবে পালন করা হয়। টেকসই ও ন্যায়সংগত কাজের পরিবেশের প্রয়োজনীয়তার কথা সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে স্মরণ করে দেয়াই দিবসটি পালন করার একমাত্র উদ্দেশ্য। এই দিবসটি সামাজিক ন্যায় বিচার ও ন্যায়সংগত শ্রম চর্চাকে উৎসাহিত করে।

১৯৯৯ সাল হতে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) কর্তৃক শোভন কর্ম দিবস পালন করা হচ্ছে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯১৯ সালে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও সামাজিক সুরক্ষা প্রদানের উদ্দেশ্যেই আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই আইএলও তার উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন শ্রম অধিকার ও শ্রমমানকে অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করছে। শোভন কাজ আইএলও কর্তৃক গৃহীত তেমনই এক অগ্রাধিকারমূলক এজেন্ডা।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা কর্তৃক প্রণীত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ১৭টি গোলের ৮ নম্বর গোল হচ্ছে শোভন কাজ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। অর্থাৎ বিশ্বের উন্নয়ন অগ্রযাত্রাকে স্থায়ী ও টেকসই করতে যে ১৭টি বিষয়কে চিহ্নিত করা হয়েছে তার অন্যতম একটি হচ্ছে শোভন কাজ। এ থেকেই শোভন কাজকে এজেন্ডা হিসাবে গ্রহণ এবং শোভন কর্ম দিবস পালনের তাৎপর্য ও গুরুত্ব উপলদ্ধি করা সম্ভব।

Manual5 Ad Code

শোভন কাজের ১০টি মানদন্ড:

১. কাজের অবাধ সুযোগ, ২. উৎপাদনশীল কাজ, ৩. কাজের স্বাধীনতা, ৪. কাজে সমতা, ৫. কাজে নিরাপত্তা, ৬. কাজে মর্যাদা, ৭. পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান, ৮. সামাজিক সুরক্ষা, ৯. শ্রমিক অধিকারের নিশ্চয়তা ও ১০. সামাজিক সংলাপের সুযোগ।

আইএলও শোভন কাজ বাস্তবায়নে চারটি মূল বিষয়কে চিহ্নিত করেছে। এ চারটি বিষয়কে শোভন কাজের মূল স্তম্ভ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। তাই শোভন কাজ বাস্তাবায়নে চারটি মূল স্তম্ভকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় নিতে হবে। শোভন কাজ বাস্তবায়নে মূল স্তম্ভগুলো হচ্ছে–

১. কর্ম সংস্থান : সবার জন্য সমান সুযোগ এবং ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করে পূর্ণকালীন কর্ম সংস্থানের ব্যবস্থা থাকতে হবে।

২. সামাজিক নিরাপত্তা : শ্রমিক এবং তার পরিবারের সকল সদস্যদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। কোন শ্রমিক কাজ করতে অক্ষম হলে কিংবা অন্য কোন কারণে কাজে নিয়োজিত থাকতে না পারলেও যেন তার এবং তার পরিবারের সদস্যদের জীবন–যাপনের ক্ষেত্রে কোন নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে তা নিশ্চিত করতে হবে।

৩. সামাজিক সংলাপ : সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় মালিক, শ্রমিক ও সরকারের মধ্যে পারস্পরিক আলাপ আলোচনার সুযোগ থাকতে হবে। টেকসই শিল্প সম্পর্ক গড়ে তুলতে হলে শ্রমিকদেরকেও একটি গুরুত্বপূর্ণ পক্ষ হিসাবে স্বীকৃতি দিতে হবে।

৪. শ্রম অধিকার : মৌলিক শ্রম অধিকার সমূহের যথাযথ স্বীকৃতি থাকতে হবে। যেমন নিয়োগপত্র, পরিচয়পত্র, সবেতন ছুটি, শ্রমিকদের সংগঠন করার স্বাধীনতা তথা অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার এবং দরকষাকষির অধিকারকে অগ্রাধিকার হিসাবে স্বীকৃতি দিতে হবে এবং শিশু শ্রম ও বাধ্যশ্রমকে সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করতে হবে।

শোভন কর্ম বলতে কেবল একটা কর্মক্ষেত্র কিংবা নির্দিষ্ট কোন চাকরির কথা বুঝায় না বরং এটি আরো অনেক উপাদানকেও যুক্ত করে যা একজন ব্যাক্তির মঙ্গল এবং মর্যাদা রক্ষায় অবদান রাখে।

শোভন কাজ কেন গুরুত্বপূর্ণ তার কিছু কারণ নিম্নে ব্যাখ্যা করা গেল :

অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা : শোভন কাজ ব্যক্তির আয়ের একটি স্থিতিশীল উৎস প্রদান করে, দারিদ্র ও অসমতা হ্রাস করে। ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করে, যাতে শ্রমিকেরা তার মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পারে এবং ভবিষ্যতের জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারে।

স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা : শোভন কাজে শ্রমিকদের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা সুরক্ষা করতে পারে এমন পরিবেশকে অগ্রাধিকার দেয়ার কথা বলা হয়েছে –যাতে শ্রমিকের পেশাগত বিপদ ও ঝুঁকি হ্রাস পায় এবং ফলস্বরূপ শ্রমিকের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটে।

Manual7 Ad Code

লিঙ্গ সমতা : শোভন কাজে নিয়োগ, বেতন এবং অগ্রগতির সুযোগে বৈষম্য দূর করে লিঙ্গ সমতাকে নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করার মাধ্যমে কর্মশক্তি এবং নেতৃত্বের ভূমিকায় মহিলাদের অংশগ্রহণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।

সামাজিক অন্তর্ভুক্তি : শোভন কাজে প্রতিবন্ধী, সংখ্যালঘু এবং দুর্বল জনগোষ্ঠীসমূহকে অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে যাতে কর্মক্ষেত্রগুলি থেকে সবাই উপকৃত হয় এবং সমান সুযোগ পায় তা নিশ্চিতের কথা বলা হয়েছে।

শ্রম অধিকার : শোভন কাজে শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়ার অধিকার এবং দর কষাকষির অধিকার প্রদানের মাধ্যমে শ্রম অধিকারকে সমুন্নত রাখার কথা বলা হয়েছে।

Manual4 Ad Code

টেকসই উন্নয়ন : শোভন কাজ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য অত্যন্ত অপরিহার্য উপাদান। এটি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ায়, বৈষম্য কমায় এবং দায়িত্বশীল ব্যবসায়িক অনুশীলনকে উৎসাহিত করে।

Manual8 Ad Code

চ্যালেঞ্জ এবং অগ্রগতি : যদিও শোভন কাজ মর্যাদাপূর্ণ কর্মসংস্থানের গুরুত্ব তুলে ধরে, এটি আবার শ্রম বাজারে টিকে থাকতে চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলায় একটি দিক নির্দেশনা হিসাবেও কাজ করে। কম মজুরি, অনিরাপদ কাজের পরিস্থিতি, অনানুষ্ঠানিক কর্মসংস্থান এবং ডিজিটাল বিভাজনের মতো সমস্যাগুলো অনেক জায়গায় শ্রমিকদের সমস্যাগুলোকে আরো কঠিন করে তুলেছে।

তবে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, আইএলও কর্তৃক শোভন কাজ এজেন্ডা হিসাবে গৃহীত হওয়ার পর থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বেশ কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে। ফলশ্রুতিতে শ্রমমান তথা সংগঠন করার অধিকার, দর কষাকষির অধিকার, সামাজিক সুরক্ষা এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতিগুলো উন্নত হচ্ছে।

শোভন কাজ এবং প্রযুক্তির ভূমিকা : এখন প্রযুক্তির যুগ। প্রযুক্তির হাত ধরে বিশ্ব এখন দারুণভাবে এগিয়ে গেলেও কর্মজগতে প্রযুক্তি দ্বৈত ভূমিকা পালন করছে। বিশ্ব এগিয়ে যাওয়ার পেছনে বিজ্ঞান বা প্রযুক্তির ভূমিকা থাকলেও তা মানব সভ্যতা বিকাশে সহায়ক নাকি অন্তরায় সে বিতর্ক পূর্বেও ছিল এবং মাত্রা কিছুটা ভিন্নতর হলেও সেই বিতর্ক এখনও বিদ্যমান।

প্রযুক্তি একদিকে নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে অন্যদিকে প্রথাগত বা ঐতিহ্যগত কাজের মডেলগুলোকে মারাত্মকভাবে চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলছে। এর পরিণাম হিসাবে কর্মজগতে একটা ব্যাপক শূন্যতা তৈরি করছে।

শোভন কর্ম দিবস সরকার, নিয়োগকর্তা, শ্রমিক এবং সুশীল সমাজের জন্য শোভন কাজের নীতির প্রতি তাদের প্রতিশ্রুতি পুনঃর্নিশ্চিত করার জন্য একটি আহ্বান হিসাবে কাজ করে। এ দিবস মূলত কর্ম জগতের অগ্রগতির প্রতিফলন, কর্মীদের প্রতি মনোযোগ বৃদ্ধি এবং কর্মীদের কল্যাণে বিনিয়োগের প্রয়োজন এমন ক্ষেত্রগুলোকে চিহ্নিত করার দিন।

জ্ঞান–বিজ্ঞনের অগ্রগতি, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ইত্যাদি নানবিধ কারণে পৃথিবী যখন এগিয়ে যাচ্ছে তখন মৌলিক মানবাধিকার হিসাবে শোভন কাজকে অগ্রাধিকার দেয়া অপরিহার্য। এর অর্থ হল এমন একটি কর্ম পরিবেশ তৈরি করা, যেখানে শ্রমিকের সম্মান সুরক্ষিত রাখা এবং তাদের পূর্ণ সম্ভাবনায় পৌছানোর মত কর্ম পরিবেশ সৃষ্টি করা অর্থাৎ আধুনিক শ্রম বাজারের চ্যালেঞ্জসমূহের উদ্ভাবনী সমাধান খুঁজে পেতে, সংশ্লিষ্ট পক্ষসমূহের সামাজিক সংলাপ এবং পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করা। একটি মর্যাদাপূর্ণ কর্মসংস্থানের ভিত্তি গড়ে তোলার লক্ষ্যেই শোভন কর্ম দিবস পালন করা হয়। আমাদের মনে রাখতে হবে একজন মানুষ কেবল তার জীবন–জীবীকার জন্য কাজ করে না বরং একজন মানুষ তার অর্জিত আয়ের মাধ্যমে পরিবার এবং সমাজের কল্যাণের জন্য যাতে ভূমিকা রাখার সুযোগ অর্জন করতে পারে সেই বিষয়টিও খুব গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় নিতে হবে। পরিশেষে বলতে চাই, আসুন শোভন কাজের তাৎপর্য ও গুরুত্বকে যথাযথভাবে অনুধাবন করে এর মূল ভিত্তি ও চেতনা বাস্তবায়ন করতে হলে বিদ্যমান শোষণমূলক আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তন দরকার। দরকার জনগণের মৌলিক মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় সুশাসন নিশ্চিত করা। আর সেটি করতে হলে আমাদের বৈষম্যহীন ব্যবস্থা চালু করতে হবে। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্ম নিরপেক্ষতা এবং জাতীয়তাবাদ এই চার নীতিতে দেশকে এগিয়ে নিতে হবে। আগামী প্রজন্মের জন্য একটি ন্যায্য ও ন্যায়ভিত্তিক কর্ম জগৎ গড়ে তোলার সংগ্রামে আমরা সকলে অঙ্গীকারাবদ্ধ ও ঐক্যবদ্ধ হই।

#
সৈয়দ আমিরুজ্জামান
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট;
বিশেষ প্রতিনিধি, সাপ্তাহিক নতুনকথা;
সম্পাদক, আরপি নিউজ;
কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, জাতীয় কৃষক সমিতি;
সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, মৌলভীবাজার জেলা;
‘৯০-এর মহান গণঅভ্যুত্থানের সংগঠক ও সাবেক কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, বাংলাদেশ ছাত্রমৈত্রী।
সাবেক কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, বাংলাদেশ খেতমজুর ইউনিয়ন।
সাধারণ সম্পাদক, মাগুরছড়ার গ্যাস সম্পদ ও পরিবেশ ধ্বংসের ক্ষতিপূরণ আদায় জাতীয় কমিটি।
প্রাক্তন সভাপতি, বাংলাদেশ আইন ছাত্র ফেডারেশন।
E-mail : syedzaman.62@gmail.com
WhatsApp : 01716599589
মুঠোফোন: ০১৭১৬৫৯৯৫৮৯
Bikash number : +8801716599589 (personal)

 

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

 


Follow for More!

Manual1 Ad Code
Manual4 Ad Code