কী হতে চাও বড় হয়ে!

প্রকাশিত: ৩:১৩ পূর্বাহ্ণ, অক্টোবর ২৮, ২০২৪

কী হতে চাও বড় হয়ে!

রি নি |

‘কী হতে চাও বড় হয়ে?’ জিজ্ঞেস করলেই মনে মনে সবসময় উত্তর তৈরি: হতে চাই বাবার মতো! এখনও ভেতরে তিরতির করে বয়ে যায় ওই একটিই ইচ্ছে কেবল!

বেড়াতে যাওয়া হবে, ব‌ই দিয়ে বললেন যাওয়ার আগে জেনে নাও সবটা; পড়ে যাও, ফিরে এসে লিখে ফেলবে; এখন এটাই অভ্যেসে দাঁড়িয়েছে! ছেলেকেও তৈরি করে দেওয়া গেছে এক‌ই অভ্যেস;

ছোট থেকে বলেছেন যা মনে আসে, লেখো; ডায়েরি আবার ঠিক হয়তো বা ডায়েরি নয়; লেখা শুরু এইজন্যই, সেই কোন সময় থেকে!

নিজে ঈশ্বরের অস্তিত্ব মানেননি; সন্তানের উপর নিজের বিশ্বাস চাপিয়েও দেননি কোন‌ওদিন!
আর ‘আস্তিক ন‌ই বলে ঠাকুর দেখব না?’ পুজোয় চারদিন ছিল আমাদের দেদার আনন্দ; গাড়ি নিয়ে কলকাতা চষে ফেলা; আজ দক্ষিণ তো কাল উত্তর! সঙ্গে পছন্দের রেস্তোরাঁয় ভুরিভোজ; আমরা আমরা ন‌ই শুধু, সঙ্গে কখনও মামাবাড়ির কেউ, তো কখনও বা এবাড়ির; ওই চারদিনে বাকি থাকতো না প্রায় কলকাতার কোন‌ও পুজোই! এইরকম চলেছে কোভিড আসার আগে পর্যন্ত‌ই! তখন আর মেয়ে নয়, নাতি সঙ্গ দিয়েছে; কিন্তু তারপর তো কেমন যেন সবটাই বদলে গেল!

তবে শুধু পুজো নয়, বড়দিনেও ছিল এক‌ইরকম হ‌ইহ‌ই আনন্দ! সেন্ট পলস্ ক্যাথিড্রাল যাওয়া, ঘোরা, খাওয়া, পিকনিক হতেই হবে; বড়দিন যে!
ঈদেও ছিল জমজমাট খাওয়া দাওয়ার আয়োজন!

চাকরিসূত্রে প্রায় সবসময়ই কলকাতার বাইরে বাইরে কেটেছে তাঁর; সপ্তাহান্তে আর ছুটিছাটায় বাড়ি ফেরা; আর আমাদের হাপিত্যেশ তাকিয়ে থাকা সেই দিনগুলোর দিকে!

তখন আমি বেশ ছোট;
কোন ক্লাস মনে নেই! জ্বর এসেছে; স্কুলে যাইনি; কী কারণে বাবাই কলকাতায়; বাবাই‌ও বাড়িতেই; রিনুর জ্বর যে! কী করছেন? আমি চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে, পাশে বাবাই‌ও তাই;

খুব ছোট থেকেই মাথাব্যথার রোগ আমার; তখন বাবাই কলকাতায় পোস্টেড। কতদিন হয়েছে, বাড়ি ফিরেই মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে বসেছেন; একটু যদি ব্যথার উপশম হয়!

তখন লোডশেডিং হতো খুব! গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা; রাতে ঘুমোনো ছিল অসম্ভব! বাবাই একবারও না থেমে টানা হাওয়া করে যেতেন; কখন যে ঘুমিয়ে পড়তাম, কে জানে!

ছোটবেলা বললেই শুধু ব‌ই আর গান মনে আসে; সারা বাড়ি জুড়ে ব‌ই আর কানে লেগে থাকা (নাকি মনে!) গান; বাবাইয়ের ছিল ফিলিপ্সের রেকর্ড প্লেয়ার; ঘুম চোখে শুনতে পেতাম একের পর এক গান; (না, হিন্দি নয়; হিন্দি গানের ক্ষেত্রে তাঁর কিঞ্চিত বৈমাত্রেয় মনোভাব ছিল, তাই শুধুই বাংলা;) বেশিরভাগ রবীন্দ্র সঙ্গীত; আর বেসিক গান; তাঁর রেকর্ডের কালেকশন ঈর্ষণীয়; রেকর্ড গেল, ক্যাসেট এল; তাও জমে উঠল পাহাড়প্রমাণ!
আর তাঁর মেয়ের মনে ছোট থেকেই এই ধারণা গেঁথে গেল যে বাড়ি মানে সেখানে পড়ালেখা আর সুর থাকতে হবেই!

আজ পর্যন্ত যারাই ওঁর ব‌ইয়ের ঘরে গেছে, অবাক হয়েছে কেবল! ‘এত ব‌ই?’ হ্যাঁ আক্ষরিক অর্থেই এত্ত এত্ত ব‌ই; কী বিষয়ের ব‌ই নেই সেখানে? স-ব আছে; মেয়েকে অর্থনীতি নিয়ে পড়ার সময়‌ও কোন‌ও ব‌ই লাইব্রেরি থেকে আনতে হয়নি! অথচ তিনি নিজে সাহিত্যের ছাত্র! ব‌ইয়ের তুলনায় জায়গা অপ্রতুল, তাই গুছিয়ে রাখা সম্ভব নয়; বড্ড অগোছালো হয়ে আছে সেসব, চাইলে কখনও কোনও ব‌ই খুঁজে পাওয়া যায় না; কিন্তু একটাও ব‌ই কিনলেই বলেন, ‘এটা কেন কিনলি? বাড়িতে আছে তো!’ কে বোঝাবে যে থাকলেও সেটা পাচ্ছি ক‌ই?!
ও, হ্যাঁ এই বিষয়ে যেটা না বললেই নয় তা হল ব‌ই নিয়ে ব‌উয়ের সঙ্গে তাঁর নিত্য খিটিমিটি চলছে, চলবে!

কোন‌ও কাজ (সাংসারিক) তিনি পারেন না! প্রথম জল গরম করতে শিখলেন নাতি হবার পর; তার জন্য অবশ্য অনেক কিছু করতে পারেন বা বলা ভালো প্রয়োজনে “সবকিছুই” করতে পারেন তিনি;
অন্য কেউ এমন হলে খুব রাগ হতো, এই ভদ্রলোকের উপর রাগ করা একটু মুশকিল! ইদানিং কোন‌ও কাজের কথা উঠলেই বলে ওঠেন, ‘আমি করে দেব!’ তেমনই এক কথাপ্রসঙ্গে মেয়ে বলেই ফেলেছে, তুমি তো কাজ করতেই পারো না!! তাঁর সটান উত্তর, ‘আমাকে অকর্মণ্য করে তোলার জন্য তিনজন মহিলা দায়ী; আমার মা, তোর মা আর তুই!’ বোঝো এবার!

অসম্ভব তাঁর জেদ!
কোন‌ও কথা আজকাল শুনতে চান না! ভুলেই যান বয়স হয়েছে; না না, একটু ভুল বলা হল, নিজের বয়স বাড়িয়ে বলার ক্ষেত্রে তাঁর জবাব নেই, কিন্তু কিছুক্ষেত্রে (স্বাস্থ্য – ডাক্তার ইত্যাদি) যে বয়স বাড়ার জন্য নিয়ম‌ও মেনে চলতে হয়, মেয়ে কিছু বললে তা শুনতেও হয়, তা তিনি মানেন না! বরং পছন্দ না হলেই সেই কথা ঘুরিয়ে দিতে তিনি খুব পারেন, ‘রিনু নাও লিভ ইট’!
মানেটা কী?!
মেয়ে অক্ষম রাগ দেখায়, দু’দিন ফোন নিজে না ক’রে ছেলেকে দিয়ে করায়; তারপর ভদ্রলোক অদ্ভুত কোন‌ও তুচ্ছ কারণে ফোন করেন এমনভাবে যেন কিছুই তো হয়নি! কিন্তু ভুলেও সেই প্রসঙ্গ আর তোলেন না! মোদ্দা কথা নিজের জেদে অনড় থাকেন! (দুর্জনে বলে থাকে এই জেদ কন্যাও পেয়েছে!)

হ্যাঁ, এই মানুষটিই আমার বাবা; যাঁকে দেখে আমার বড় হয়ে ওঠা; বড় হতে চাওয়া; যাঁর জন্য ভালো হবার চেষ্টা করা প্রত্যেকটা মুহূর্তে; এখনও পর্যন্ত আর এমন একজন মানুষ‌ও চোখে পড়েনি যিনি এই মানুষটির পাশে দাঁড়াতে পারেন!

ইনি এমন একজন মানুষ যিনি দেশভাগ পেরিয়ে এসেও মনে একফোঁটা দ্বেষ জমিয়ে রাখেননি; “কেন হারালাম সব?!” বলে আঙুল তোলেননি কারুর দিকে; শূন্য থেকে শুরু করেও ‘দেশ’ বলতে মানুষ শিখিয়েছেন সবদিন; যিনি মানুষ বলতেও ‘মানুষ’ই শিখিয়েছেন সবসময়, কখনও আলাদা করে পদবী, রঙ, ভাষা, শিক্ষা, অর্থ দেখতে শেখাননি; যিনি নিজেকে তৈরি করার জন্য সময় দিতে বলেছেন অনর্গল; বলেই চলেন অনবরত! কারুর সম্পর্কে কোনও বিরূপ মন্তব্য করলেই নিরস্ত করেন; মানুষের কালো নয়, সাদা দিক খুঁজে বের করতে বলেছেন, বুঝিয়েছেন সকলের আছে সাদাকালো দুইই;

তিনিই আমার জীবনের প্রথম পাঠ, একমাত্র পাঠ, যা আজও পড়ার চেষ্টা করে চলেছি! বাবার মতো মানুষ হতে চেয়েছি, চাই – তবে এও জানি তা অসম্ভব! অমন মানুষ কেন, তাঁর নখের যোগ্য হবার যোগ্যতাও নেই আমার! আমি শুধু তাঁকে ছুঁয়ে থাকি আর মনে মনে বলি, ভাগ্যিস তুমি ছিলে, ভাগ্যিস তুমি আছো..

বাবাই, শুভ জন্মদিন।

পুনঃ সঙ্গের ছবিটি গতবছর বাংলাদেশে তুলে দিয়েছিলেন পাঠানভাই। তাঁর প্রতি আমাদের অসীম কৃতজ্ঞতা জানাই।