পরিণত বয়সেও কেন বন্ধু দরকার

প্রকাশিত: ১:০০ পূর্বাহ্ণ, জানুয়ারি ২০, ২০২৫

পরিণত বয়সেও কেন বন্ধু দরকার

রুমানা রূপা |

🔴পরিণত বয়সেও কেন আমাদের বন্ধু দরকার🔴

স্কুল বা কলেজ জীবনেই আমরা সাধারণত দীর্ঘদিনের বন্ধু খুঁজে পাই। তবে পরিণত বয়সের পর আমাদের মেলামেশা পরিবার, সন্তান ও আত্মীয়স্বজন ও কলিগদের কেন্দ্র করে চলতে থাকে। বন্ধু আর সেই অর্থে তৈরি করা হয়ে ওঠে না। কিন্তু সত্যি কথা বলতে, চাইলে পরিণত বয়সেও নতুন বন্ধু খুঁজে পেতে পারেন আপনি।

নিজস্ব কর্মক্ষেত্র এবং প্রতিবেশী ছাড়াও অন্য নানা ইভেন্ট ও ঘটনার মাধ্যমে নতুন বন্ধুত্ব শুরু হতে পারে।  অনেকে মনে করেন, বড় হওয়ার পর নতুন বন্ধুত্ব তৈরি হয় না। এটা কিন্তু একেবারেই ভুল ধারণা। বরং বড় হওয়ার পর নতুন বন্ধু তৈরি করা আপনাকে অনেক মূল্যবান মানুষের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ করে দেবে। তাই সমমনা মানুষদের মধ্য থেকে নতুন বন্ধু খুঁজে নিন!

প্রাপ্তবয়স্ক হিসাবে কীভাবে নতুন বন্ধু তৈরি করবেন, সে ব্যাপারে দরকারি টিপস পাবেন এই লেখায়।
.

🔴কেন আমাদের বন্ধু দরকার..?? 🔴

দীর্ঘ ও সুখী জীবনযাপনে বন্ধুত্বের ভূমিকা অপরিসীম। যেকোনো বয়সেই আমাদের বন্ধু থাকা দরকার। কারণ:

🔴সামাজিক সম্পর্ক

বর্তমান সময়ে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা একটি বড় সমস্যা। গবেষণায় দেখা গেছে, একাকিত্ব আমাদের আয়ু প্রায় এক যুগের মত কমিয়ে দেয়, যা দিনে ১৫ টি সিগারেট খাওয়া কিংবা মদ্যপানের আসক্তির সমান ক্ষতিকর।

🔴উন্নত মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য

যারা একাকিত্বে ভোগেন বা বিচ্ছিন্ন থাকেন, তাদের মধ্যে বিষণ্ণতা, ডিমেনশিয়া এবং হৃদরোগের ঝুঁকি বেশি। ভাল বন্ধু থাকা এসব রোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।

🔴মানসিক চাপ কমায়

বন্ধুদের সাথে সমস্যা শেয়ার করলে বা শুধু কথা বললেই মানসিক চাপ কমে। এর ফলে সামগ্রিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটে।

🔴ক্যারিয়ার ও সম্পর্কের উন্নতি

বন্ধুদের সাথে আইডিয়া শেয়ার করা এবং বিভিন্ন সমস্যায় পরামর্শ নেওয়া দারুণ একটি বিষয়। একজন ভাল বন্ধু আপনাকে ভাল সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করবে, যা জীবনের সব ক্ষেত্রেই উন্নতি নিয়ে আসতে সাহায্য করে। বন্ধুরা জীবনকে ভিন্ন আঙ্গিকে দেখতে শেখায়, নতুন তথ্য দেয় এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সাথে সংযোগ স্থাপনে সাহায্য করে।

🔴সুখী হতে সাহায্য করে

বন্ধু থাকলে আপনি জীবনে সুখী হবেন, আপনার বন্ধুরাও সুখী হবে। কারণ, সুখ সংক্রামক। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যখন কেউ আনন্দিত হয়, তার এক মাইল ব্যাসার্ধের মধ্যে বাস করা বন্ধুদের সুখী হওয়ার সম্ভাবনাও ২৫% বেড়ে যায়। গবেষকরা জানান, একজন ব্যক্তির আনন্দে তার বন্ধুরা এবং তাদের বন্ধুরাও খুশি হন, এভাবেই খুশি ছড়িয়ে পড়ে।
.

🔴বড় হওয়ার পর যেভাবে বন্ধুত্ব করবেন..? 🔴

জীবনে বন্ধুত্ব কতটা দরকারি, তা আমরা জানলাম। যদিও বন্ধু খুঁজে পাওয়ার ব্যাপারটি মাঝে মাঝে অসম্ভব মনে হয়, কিন্তু এটি আপনারই উপকারে আসবে। তাছাড়া বন্ধুত্ব করা আসলে এতটা কঠিনও না। সহজে বন্ধুত্ব করতে চাইলে এই টিপসগুলি দেখে নিন।

🔴  ১. সক্রিয় হন

বন্ধুত্ব আপনাআপনি হয়ে যায় না। যদি হয়ও, তা নিজে নিজেই টিকে থাকে না। আপনাকে এর পেছনে সময় দিতে হবে। যারা বিশ্বাস করেন বন্ধুত্ব ভাগ্য বা নিয়ন্ত্রণহীন বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল, তারা ভবিষ্যতে আরও একাকী হয়ে পড়েন। তাই সক্রিয়ভাবে চেষ্টা করুন এবং এর পেছনে শ্রম দিন।

🔴২.. আশাবাদী  হোন

আশাবাদী ব্যক্তিরা সহজে বন্ধুত্ব করতে পারেন, আর তাদের বন্ধনগুলি হয় খুব দৃঢ়। তারা অন্যদের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়াতে সংকোচ বোধ করেন না এবং কে কী ভাবল তা নিয়ে খুব একটা দুশ্চিন্তা করেন না।

বেশিরভাগ মানুষের ক্ষেত্রেই বন্ধুত্ব করতে গেলে এই বিষয়গুলি বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আশাবাদী ব্যক্তিরা এসব বিষয়কে গুরুত্ব না দেওয়ায় তাদের জন্য বন্ধুত্ব করাটা সহজ হয়। তাছাড়া আমরা সবাই ইতিবাচক মানুষদের আশেপাশে থাকতে পছন্দ করি, যাদের আচরণ উষ্ণ ও বন্ধুসুলভ।

🔴৩.লিস্ট বা তালিকা তৈরি করুন

অনেক সময় বহির্মুখী (Extrovert) ব্যক্তিরাও নতুন কারো সাথে বন্ধুত্ব করতে হিমশিম খেয়ে যান। যারা একটু চুপচাপ, লজ্জা পান বেশি তাদের জন্য এই সমস্যা আরও প্রকট। তাহলে বড় হওয়ার পর অন্তর্মুখী (Introvert) কীভাবে বন্ধুত্ব করেন?

বন্ধুত্ব করতে চান এমন ৩ থেকে ৫জনের নাম লিখুন। তারপর তাদের সাথে যোগাযোগ করুন। টেক্সট করুন, কফি খাওয়ার আমন্ত্রণ জানান, তাদের সাথে ছবি বা কোনো স্মৃতি শেয়ার করুন। কোনো লেখা পড়ে তাদের কথা মনে পড়লে সেটাও তাদের জানাতে পারেন। ছোটখাটো বিষয় থেকেই অনেক দৃঢ় বন্ধুত্ব হতে পারে।

🔴৪.একাধিক বন্ধু বানানোর চেষ্টা করুন

অনেকে মনে করেন কেবলমাত্র একজন ভাল বন্ধু থাকাই যথেষ্ট। তবে একজন বন্ধু সবসময় যথেষ্ট নাও হতে পারে, কারণ আপনার যা কিছু দরকার, তা একজন ব্যক্তির মধ্যে পাওয়া কঠিন। কয়েকজন ভাল বন্ধু আপনার জীবন বদলে দিতে পারে। দেখা গেছে, যাদের ৩ থেকে ৫ জন ঘনিষ্ঠ বন্ধু আছে, তারা তুলনামূলক বেশি সুখী।

🔴৫.জড়তা থাকবেই

নানারকম জড়তা কাজ করবেই, সেটা আপনার মধ্যে হোক বা অপর ব্যক্তির মধ্যেই হোক। তাই বলে নতুন বন্ধুত্ব বা সম্পর্কে জড়ানো যাবে না এমনটা ভাবা ঠিক না। অস্বস্তিকর নীরবতা এড়াতে শিখুন ও স্বাভাবিকভাবে আলাপচারিতা করুন। অস্বস্তিকর পরিস্থিতি আপনাকে যেন দমিয়ে না দেয় এবং মনোযোগ নষ্ট করতে না পারে, সেভাবেই নিজেকে তৈরি করুন। এই অভ্যাসটি আপনাকে ক্যারিয়ারেও অনেক উপকার করবে।

🔴৬.সময় দিন

ঘনিষ্ঠ বন্ধু বানাতে সময় লাগে। গবেষণায় দেখা গেছে, ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব তৈরিতে প্রায় ২০০ ঘণ্টারও বেশি সময় লাগে। এ কারণে বিভিন্ন কোর্স ও ইভেন্টে স্বেচ্ছাসেবী হিসাবে অংশ নেওয়া কাজে দেয়। কারণ তখন অন্যদের সাথে সময় কাটানোর সুযোগ তৈরি হয়। যেমন স্কুল বা কলেজে ক্লাস করতে করতেই কারো কারো সাথে আমাদের গভীর বন্ধুত্ব হয়ে যেত। একই ধরনের কাজ করতে গিয়ে, অন্যদের সাথে আপনার বন্ধুত্ব হয়ে যাবে।

🔴৭. দুর্বলতা মেনে নিন

যেকোনো স্বাস্থ্যকর সম্পর্কের মধ্যে কিছু না কিছু দুর্বলতা থাকবেই। সবকিছু পারফেক্ট হবে না। তা মেনে নিতে পারলেই আমরা ভাল বোধ করব। প্রতিদিন বা সপ্তাহে “হাইলাইট-লোলাইট” প্রশ্ন করতে পারেন। যেমন, “এই সপ্তাহের সবচেয়ে ভাল সময় কোনটি ছিল?” ও তারপর “সবচেয়ে বেশি মানসিক চাপ অনুভব হয়েছে কোন কারণে?”–এই প্রশ্নগুলি করুন। সে অনুসারে নিজের সাথে বোঝাপড়া করুন।

🔴৮.চর্চা

আমরা অনেকেই বড় হওয়ার পর সামাজিকতার ব্যাপারটা ভুলে যাই। সামাজিকতার দক্ষতা মাংসপেশির মতই, চর্চার মাধ্যমে গড়ে তোলা যায়। প্রতিদিন অন্তত একজন অচেনা মানুষের সাথে কথা বলার চেষ্টা করুন। সপ্তাহ শেষে দেখবেন আপনার আত্মবিশ্বাস অনেক গুণ বেড়ে গিয়েছে। এটা আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতা হতে পারে আপনার জন্য বন্ধু তৈরির ক্ষেত্রে।
.

🔴বন্ধুত্ব ধরে রাখবেন কীভাবে?🔴

বন্ধুত্ব তৈরি করা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি এটি ধরে রাখাও অত্যন্ত জরুরি। সম্পর্ককে স্থায়ী এবং দৃঢ় করার জন্য কিছু কার্যকরী টিপস:

🔴১.নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করুন: বন্ধুত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য নিয়মিত যোগাযোগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ফোনে কথা বলা, মেসেজ করা, বা সামাজিক মাধ্যমে একে অপরের সাথে সংযুক্ত থাকা সম্পর্ককে শক্তিশালী করে।

🔴২.সহানুভূতিশীল হন: আপনার বন্ধুদের সমস্যায় সহানুভূতি দেখান। তাদের কথাগুলি মনোযোগ দিয়ে শুনুন এবং তাদের অনুভূতিগুলি বুঝতে চেষ্টা করুন। এতে বন্ধুত্বের বন্ধন আরও দৃঢ় হবে।

🔴৩.পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকুন: সম্পর্কে সম্মান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বন্ধুদের মতামত, ব্যক্তিগত সময় এবং সীমারেখাকে সম্মান করুন। এটি বন্ধুত্বকে টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করে।

🔴৪.সময় দিন: বন্ধুত্ব টিকিয়ে রাখতে সময় দেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সময় ব্যয় করা মানে শুধু একসাথে থাকা নয়, বরং মানসিকভাবে সংযুক্ত থাকা। নিয়মিত একসাথে সময় কাটান, একসাথে কিছু করুন যা দুই পক্ষেরই ভাল লাগে।

🔴৫. ক্ষমাশীল হন: বন্ধুত্বে ভুলবোঝাবুঝি বা ছোটখাটো সমস্যার আশঙ্কা থাকে। এমন পরিস্থিতিতে ক্ষমা করতে শিখুন এবং সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করুন। ক্ষমাশীলতা বন্ধুত্বকে স্থায়ী করে তোলে।

🔴৬.বিশ্বাস বজায় রাখুন: বিশ্বাস একটি দৃঢ় বন্ধুত্বের ভিত্তি। বন্ধুর প্রতি বিশ্বাস রাখুন এবং তার বিশ্বাস অর্জনের চেষ্টা করুন। গোপনীয়তা রক্ষা করুন এবং কথা দিয়ে কথা রাখুন।

🔴৭.মজার মুহূর্ত ভাগাভাগি করুন: একসাথে মজা করা, হাসি-মজার মুহূর্ত ভাগাভাগি করা বন্ধুত্বের আনন্দ আরও বাড়িয়ে দেয়। স্মৃতি তৈরি করুন যা ভবিষ্যতে আপনাদের বন্ধুত্বের মজবুত ভিত্তি হিসাবে কাজ করবে।

🔴৮.সমর্থন দিন: বন্ধুদের সুখে-দুঃখে সমর্থন দিন। তাদের সুখে আনন্দিত হন এবং দুঃখে পাশে থাকুন। তাদের সাফল্যে উৎসাহ দিন এবং সমস্যায় সহায়তা করুন।

এই টিপসগুলি মেনে চললে বন্ধুত্ব দীর্ঘস্থায়ী ও মজবুত হবে। বন্ধুত্বের মূল্যায়ন করুন এবং আপনার বন্ধুকে সবসময়ই বিশেষ অনুভব করান।
.

বোঝাই যাচ্ছে, বন্ধুত্ব ভাগ্যের ওপর নির্ভর করে না। বরং এটি সঠিক পরিস্থিতিতে সঠিক মানুষদের একত্রিত হওয়ার ফল। তাই নিজে থেকেই উদ্যোগ নিন এবং নতুন বন্ধু তৈরি করে আপনার জীবনকে আরও সুন্দর ও সমৃদ্ধ করে তুলুন।

#বন্ধু #বন্ধুত্ব #বয়স