বিদায় হোসে মুজিকা: বিশ্বের দরিদ্রতম প্রেসিডেন্ট

প্রকাশিত: ৮:১৬ পূর্বাহ্ণ, মে ১৫, ২০২৫

বিদায় হোসে মুজিকা: বিশ্বের দরিদ্রতম প্রেসিডেন্ট

Manual3 Ad Code

ড. মঞ্জুরে খোদা টরিক |

আধুনিক বিশ্বে রাজনীতি হচ্ছে ক্ষমতার দম্ভ, অহঙ্কার, বিলাসিত ও সম্পদের পাহাড় ও সাম্রাজ্য বিস্তার। কিন্তু এই ধারা ভেঙ্গে বিশ্বজুড়ে এক ব্যতিক্রমী নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন, তিনি হচ্ছেন হোসে আলবার্তো মুজিকা কর্দানো, সংক্ষেপে হোসে মুজিকা, উরুগুয়ের ৪০তম রাষ্ট্রপতি যিনি বিশ্বের দরিদ্রতম প্রেসিডেন্ট হিসেবে পরিচিত। তাঁর জীবন, রাজনৈতিক দর্শন ও ব্যক্তিত্ব তাঁকে অনন্য করে তুলেছে আধুনিক বিশ্বের রাজনীতিকদের মধ্যে।

হোসে মুজিকা জন্মগ্রহণ ১৯৩৫ সালের ২০ মে, উরুগুয়ের রাজধানী মন্টেভিডিওতে। তাঁর পরিবার ছিল এক সাধারণ কৃষিজীবী। শৈশব থেকেই তিনি অভাব-অনটন দেখে বড় হয়েছেন। এই জীবন-সংগ্রাম তাঁকে তৈরি করেছিল এক অন্যরকম নেতায়, যাঁর কাছে রাজনীতি ছিল আক্ষরিক অর্থেই সেবা ও আত্মত্যাগের বিষয়।

১৯৬০-এর দশকে হোসে মুজিকা যুক্ত হন “টুপামারোস” (Tupamaros) নামে একটি বামপন্থী গেরিলা সংগঠনের সঙ্গে। যে সংগঠনটি সামাজিক অসাম্য ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াই করছিল। গেরিলা আন্দোলনের কারণে তিনি ৬ বার গুলিবিদ্ধ হন। সরকারবিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে ব্যাংক লুট, অস্ত্র চুরি, ধনী শ্রেণির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। প্রায় ১৪ বছর কারাবন্দি ছিলেন, কারাবাসের এই দীর্ঘ ও কঠিন সময় তাঁর মননে এক গভীর পরিবর্তন আনে। তিনি শ্রেণীসংগ্রামের হটকারি পথ পরিহার করে শান্তি ও সহিষ্ণুতার মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তনে কাজ করেন।

Manual5 Ad Code

দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর ১৯৮৫ সালে তিনি নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে যুক্ত হন। ২০০১ সালে তিনি পার্লামেন্ট সদস্য হন এবং ২০০৫ সালে কৃষি মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৯ সালের নির্বাচনে তিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন এবং ২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত উরুগুয়ের নেতৃত্ব দেন।

Manual5 Ad Code

রাষ্ট্রপতি হওয়া সত্ত্বেও হোসে মুজিকা কখনও প্রেসিডেন্ট ভবনে থাকেননি। বরং তাঁর ছোট খামারবাড়িতে স্ত্রী লুসিয়া টোপোলানস্কির সঙ্গে বসবাস করতেন। তিনি নিজের খাবার নিজে রান্না করতেন, পুরনো একটি ভক্সওয়াগন বিটল গাড়ি চালাতেন এবং রাষ্ট্রপতির বেতনের ৯০% দান করতেন দরিদ্রদের সহায়তা ও সামাজিক উন্নয়নে। এই অনাড়ম্বর জীবনযাপন তাঁকে জনসাধারণের চোখে একজন নেতা নয়, বরং দানশীল এক বন্ধু ও অভিভাবকে পরিণত করে। তাঁর এই সাদামাটা জীবন ও মানবিক চিন্তাধারা বিশ্বজুড়ে প্রশংসা কুড়ায়। অনেকেই তাঁকে “ফিলোসফার প্রেসিডেন্ট” বা দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক বলে অভিহিত করেছেন।

Manual7 Ad Code

হোসে মুজিকার শাসনামলে উরুগুয়ে গরিবদের জন্য বিনামূল্যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণ করেন। তিনি সবসময়ে বলতেন, ”উন্নয়ন মানে শুধু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নয়, বরং মানুষের মৌলিক অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করা।”

হোসে মুজিকার দর্শন ছিল স্পষ্ট— সত্যিকারের স্বাধীনতা আসে আত্মসংযম থেকে। তিনি বিশ্ববাসীর কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা রেখেছেন: “আমি গরিব নই। গরিব সে, যার চাহিদা অনেক এবং তা পূরণ করতে পারে না। আমি অল্পতেই তুষ্ট, এটাই আমার সম্পদ, এটাই আমার স্বাধীনতা।” এই দর্শনের মাধ্যমে তিনি ভোগবাদী সমাজকে আঘাত করেছেন এবং প্রমাণ করেছেন যে একজন নির্লোভ সৎ মানুষও দক্ষভাবে রাষ্ট্র চালাতে পারে। তিনি উন্নয়নের নামে ভোগবাদ, বিলাসিতা ও আতিশার্যের ঘোড় বিরোধী ছিলেন। তাঁর কথা ও কাজে ফুটে ওঠে অভিন্ন বাস্তবতার এক গভীর মানবিক জীবনবোধ। যে কারণে হোসে মুজিকার চিন্তাধারা শুধু উরুগুয়েতে নয়, সারা বিশ্বেই আলোচনার কেন্দ্রতে ছিল।

হোসে মুজিকার জীবন আমাদের শেখায়— নেতৃত্ব মানে রাজকীয়তা নয়, বরং আত্মত্যাগ, সততা ও প্রকৃত জনসেবা। তিনি শুধু একজন রাষ্ট্রপতি ছিলেন না, ছিলেন এক জীবন্ত অনুপ্রেরণা। মুজিকার জীবন কেবল রাজনৈতিক শিক্ষাই নয়, বরং মানবিকতার পাঠশালা। আধুনিক বিশ্বের ক্ষমতালোভী রাজনীতির মাঝে তিনি এক অনন্য আদর্শ।

আজ এই নির্লোভ অনন্য ও মহান মানুষটি হানাহানি ও স্বার্থপরতা উৎকট ক্ষমতাবাজির মাটির পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। যে মে মাসে তিনি এই পৃথিবীতে এসেছিলেন সেই মেতেই তিনি বিদায় নিলেন কমরেড মুজিকা। তাঁর মৃত্যুতে গভীর শোক ও আনত শ্রদ্ধাঞ্জলি।
#
মঞ্জুরে খোদা টরিক
লেখক, গবেষক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক
সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন

Manual8 Ad Code

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

 


Follow for More!

Manual1 Ad Code
Manual4 Ad Code