গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচন তো নিতান্তই স্বাভাবিক দাবি!

প্রকাশিত: ১:৩০ পূর্বাহ্ণ, মে ২৪, ২০২৫

গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচন তো নিতান্তই স্বাভাবিক দাবি!

Manual6 Ad Code

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী |

গণতন্ত্রের জন্য প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকার তো নিতান্তই স্বাভাবিক দাবি। কিন্তু ১৯৫৪ সালে পূর্ববঙ্গে প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটে যে নির্বাচন হয়, তাতে মুসলিম লীগের যে দুর্দশা ঘটে, তাতেই শাসকরা বুঝে ফেলেন– সর্বজনীন ভোটাধিকার দিলে সারা পাকিস্তানে তাদের একই দশা ঘটবে। তার প্রধান কারণ পূর্ববঙ্গ তো বিপক্ষে যাবেই, পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাববিরোধী প্রদেশগুলোও যে পক্ষে থাকবে– এমন নিশ্চয়তা নেই। তাই প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচন দিতে তারা প্রস্তুত ছিলেন না। কিন্তু ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের পর ওই শাসকদের পক্ষে প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারের দাবি মেনে না নিলে পূর্ববঙ্গে তো বটেই, পশ্চিম পাকিস্তানেও মানুষকে শান্ত রাখার উপায় ছিল না। ইয়াহিয়া খান তাই দাবিটি মেনে নিয়েছিলেন। যত লোক তত ভোট– এই দাবি মেনে নিলে পূর্ব পাকিস্তানের আসন সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে; তার ফলে ৫৬ শতাংশ পাকিস্তানি নাগরিকের বাসভূমি পূর্ববঙ্গ কর্তৃত্ব করবে পশ্চিম পাকিস্তানের ওপর– এই আশঙ্কা তাদের জন্য অবশ্যই আতঙ্কের জ্বলন্ত কারণ ছিল। তবু নিতান্ত নিরুপায় হয়ে এবং এই আশা নিয়ে, পূর্ববঙ্গে ভোট ভাগাভাগি হয়ে যাবে। তারা প্রাপ্তবয়স্কদের মাথাপিছু ভোটের দাবি মেনে নিয়েছিলেন।
কিন্তু ওই মেনে নেওয়াটাই তাদের জন্য শেষ পর্যন্ত কাল হলো। দুরাশা সফল হলো না; আশঙ্কাই সত্য প্রমাণিত হলো। এর পেছনে বাস্তবিক কারণ ছিল। প্রথমত, মওলানা ভাসানী নির্বাচনে প্রার্থী দিলেন না। না দেওয়ার কারণ তিনি চাইছিলেন, ভোট ভাগাভাগি না হয়ে নির্বাচনের ভেতর দিয়ে পূর্ববঙ্গের স্বাধীনতার পক্ষে একটি সর্বজনীন রায় বেরিয়ে আসুক। দ্বিতীয়ত, পূর্ববঙ্গের মানুষ তখন এতই মোহমুক্ত হয়ে পড়েছিল যে তারা আর পাকিস্তানে থাকতেই চায়নি, বরঞ্চ ওই রাষ্ট্রের সামরিক বেষ্টনী থেকে বের হয়ে আসতে চেয়েছে। ছয় দফাকে তারা স্বাধীনতার এক দফায় পরিণত করতে চেয়েছিল, যে জন্য সব ভোট তারা ছয় দফার বাক্সেই ফেলেছে, এদিক-ওদিক না তাকিয়ে। সামরিক বাহিনীর লোকেরা অবশ্য চেষ্টা করছিল ইসলাম পছন্দ মার্কাদের জিতিয়ে আনতে। এ জন্য তারা অর্থ সরবরাহ করা থেকেও বিরত থাকেনি। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। রায় বেরিয়ে এসেছে ছয় দফার পক্ষে। এমনভাবে বেরিয়ে এলো যে, বোঝা গেল– লোকে স্বায়ত্তশাসন নয়, স্বাধীনতাই চায় এবং আওয়ামী লীগের পক্ষে এই গণরায়কে অমান্য করার কোনো উপায়ই ছিল না।
পূর্ববঙ্গবাসীর পক্ষে তাই প্রত্যাশাটা দাঁড়িয়ে গেল স্বাধীনতারই। মুক্তির মাত্রা ও বিস্তৃতি সম্পর্কে কোনো স্পষ্ট ধারণা তখন গড়ে ওঠেনি এটা ঠিক; কিন্তু যুদ্ধটা যে মুক্তিযুদ্ধে পরিণত হয়েছিল এবং এটা যে প্রচলিত সামরিক যুদ্ধ থাকেনি; রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছিল একটি রাজনৈতিক জনযুদ্ধে– এই দুটি বিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকেনি। মুক্তির ওই স্বপ্নের ভেতর কয়েকটি প্রত্যাশা তো অবশ্যই ছিল। সবচেয়ে বড় প্রত্যাশাটিই দাঁড়িয়েছিল একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠার।
ব্রিটিশের তৈরি আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের কাঠামো পাকিস্তানিরা ভাঙেনি। কেননা, ভাঙার প্রয়োজন দেখা দেয়নি। রাষ্ট্রের ওই সংগঠন এবং চরিত্র তাদের নিপীড়নমূলক ও জনবিচ্ছিন্ন কার্যকলাপকে পরিপূর্ণরূপে সহায়তা দান করেছে। কথা ছিল, স্বাধীন হলে ওই রাষ্ট্রব্যবস্থাকে আমরা ভেঙে ফেলব। মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে রাষ্ট্রের আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদী চরিত্রে পরিবর্তন আনার সম্ভাবনা জেগে উঠেছিল। কিন্তু সে সম্ভাবনা তো বাস্তবায়ন হয়নি। বরঞ্চ রাষ্ট্রের নাম, আয়তন, সংবিধান, জাতীয় পতাকা অনেক কিছু বদলালেও তার অন্তর্গত আমলাতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী মর্মবস্তু অক্ষুণ্নই রয়ে গেছে। সেখানে আছে আমলাতন্ত্রের শাসন এবং পুঁজিবাদী ব্যবস্থার কাছে পরিপূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ।
বাংলাদেশে দুর্নীতি কী পরিমাণে আছে, সেটা মেপে দেখার জন্য বিদেশি সংস্থার সাহায্যপ্রার্থী হওয়ার প্রয়োজন নেই। দুর্নীতি তো এ দেশের সব নাগরিকেরই মর্মান্তিক দুর্ভোগ এবং যে রাষ্ট্রে সব ক্ষমতা এখন তাদেরই হাতে, যাদের নেই কোনো সাংবিধানিক বৈধতা। জবাবদিহির দায়, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব পর্যন্ত হুমকির কবলে। সাম্রাজ্যবাদের ক্রীড়নক হয়ে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। এদের সঙ্গে যোগ হয়েছে একাত্তরের যুদ্ধবিরোধী চক্র। অর্থাৎ তথাকথিত উগ্র ধর্মবাদীরা।
সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা থাকছে না; সমাজতন্ত্রের স্বপ্নকে বিতাড়িত করা হয়েছে। শিক্ষার ধারা একটি নয়, তিনটি এবং কারও সাধ্য নেই যে তিন ধারাকে এক করবে। কেননা, ধারা তিনটি দাঁড়িয়ে আছে শ্রেণিবিভাজনের ওপর ভর করে এবং শ্রেণিদূরত্ব মোটেই কমছে না, বরঞ্চ বাড়ছে এবং তিন ধারার শিক্ষা ওই দূরত্বকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। শিক্ষা সামাজিক ঐক্য আনবে কী, বরঞ্চ উল্টো কাজ করে চলেছে। মাতৃভাষার চর্চা যেমন হওয়া উচিত ছিল সেভাবে হয়নি। উচ্চশিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা প্রচলনের যে চ্যালেঞ্জ ছিল, সেটাকে ঠিকমতো গ্রহণই করা হয়নি, বাকিটা তো পরের কথা। আদালতের কার্যক্রম নিয়ে ইতোমধ্যে নানা প্রশ্ন উঠেছে। পুঁজিবাদী মূল্যবোধ মানুষকে পরস্পরবিচ্ছিন্ন, সমাজবিমুখ ও ভোগবাদী করে তুলেছে। প্রত্যাশা থেকে এই প্রাপ্তিটা যে কত দূরে, তা বুঝিয়ে বলাটা প্রায় অসম্ভব বৈকি।
একটি নতুন এবং বড়মাপের বিপদ তো ইতোমধ্যে এসে জুটেছে। এই পরিবর্তন দেশকেই আঘাত করবে। ইতোমধ্যে আঘাত শুরু হয়েও গেছে বৈকি; কিন্তু বাংলাদেশের দুর্ভোগটাই হচ্ছে সবচেয়ে কঠিন বলে ধারণা। কেননা, আমাদের দেশ অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ ও দরিদ্র। তদুপরি এটি একটি বদ্বীপ। ফলে আমাদের সামনে বিপদের মাত্রাটা ভয়াবহ। যারা দেশবিরোধী কর্মে লিপ্ত তারা পরিস্থিতি বেগতিক দেখলে বিদেশে চলে যাবে। আর আমাদের বিপদ গ্রাস করবে।
বাংলাদেশের নিজস্ব কণ্ঠ আছে। সেই কণ্ঠে এই বিপদের কথাটা অত্যন্ত প্রবলভাবে ধ্বনিত হওয়া আবশ্যক। দোষটা আমাদের নয়; দোষ করেছে পুঁজিবাদী বিশ্বের তাঁবেদার সরকার অথচ ভুক্তভোগী হচ্ছি আমরা। পুঁজিবাদী বিশ্বকে তাই অভিযুক্ত করা চাই। ক্ষমতায় থাকার অভিপ্রায়ে সরকার দেশ, জাতি, জনগণকে এখন চরম শঙ্কা-আতঙ্কে ফেলেছে। পুঁজিবাদকে প্রতিহত করা দরকার, যাতে তারা মানুষের ভবিষ্যৎকে এভাবে বিপন্ন করে তুলতে না পারে। কাজটা চলছে। আন্তর্জাতিক প্রতিরোধ গড়ে উঠেছে, তাতে আমরা যোগ দেব– প্রত্যাশা এটাও। কিন্তু প্রত্যাশাগুলো পূরণ হবে না, যদি না দেশপ্রেমিক ও গণতান্ত্রিক মানুষ এগিয়ে আসেন এবং জনগণের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আন্দোলন গড়ে না তোলেন, যেমনটা তারা অতীতে করেছিলেন এবং করেছিলেন বলেই মুক্তিযুদ্ধের মতো ঘটনা ঘটেছিল। আমরা বিজয় অর্জন করতে পেরেছিলাম।
#
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
লেখক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক
ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

 


Follow for More!

Manual1 Ad Code
Manual4 Ad Code