সৈয়দ আমিরুজ্জামান |
মানবদেহের অনাক্রম্যতা বা ইমিউন সিস্টেম হলো এমন এক প্রতিরক্ষা তন্ত্র, যা প্রতিনিয়ত ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ও অন্যান্য অনুপ্রবেশকারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। কিন্তু কখনও কখনও এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাই নিজের শরীরকে শত্রু ভেবে আক্রমণ শুরু করে—যার ফল অটোইমিউন রোগ। টাইপ-১ ডায়াবেটিস, লুপাস, রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস কিংবা ক্রোন’স ডিজিজ—সবই এমন আত্মঘাতী যুদ্ধের ফল।
কিন্তু আমাদের শরীরের প্রতিটি মানুষই তো এই ভয়াবহ বিপর্যয়ে ভোগে না। কেন? কারণ শরীরের ভেতর আছে কিছু “শান্তিদূত”—যারা প্রতিরক্ষা বাহিনীকে সংযত রাখে, সামঞ্জস্য বজায় রাখে। এই শান্তিরক্ষাকারী কোষগুলির নাম Regulatory T Cell (Treg)।
এ বছরের চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার (২০২৫) সেই শান্তিদূতদের রহস্য উন্মোচনকারী তিন বিজ্ঞানীর ঝুলিতে গেছে। এরা হলেন—Mary E. Brunkow ও Fred Ramsdell (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র), এবং Shimon Sakaguchi (জাপান)।
আবিষ্কারের গল্প
১৯৯০-এর দশকে জাপানের ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শিমন সাকাগুচি প্রথম শনাক্ত করেন এক বিশেষ ধরনের টি কোষ—যারা অন্য ইমিউন কোষকে অতিরিক্ত সক্রিয় হয়ে পড়া থেকে বিরত রাখে। তিনি নাম দেন Regulatory T Cell বা সংক্ষেপে Treg।
পরবর্তী সময়ে মার্কিন বিজ্ঞানী মেরি ব্রাঙ্কো শিশুদের এক বিরল ও প্রাণঘাতী রোগ (IPEX syndrome) নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে খুঁজে পান FOXP3 নামের একটি জিন। তাঁর সহকর্মী ফ্রেড র্যামসডেল প্রমাণ করেন—এই জিনে ত্রুটি থাকলেই Treg কোষ গঠন ব্যাহত হয়, এবং শরীর নিজের কোষকেই শত্রু ভেবে আক্রমণ করে।
অর্থাৎ, FOXP3 হলো সেই মূল জিন, যা শরীরে “শান্তিদূত” Treg কোষ তৈরি করে। আর এই কোষগুলোই আমাদের ইমিউন সিস্টেমের “ব্রেক” হিসেবে কাজ করে—অর্থাৎ, কোথায় লড়তে হবে আর কোথায় থামতে হবে, সেই ভারসাম্য রক্ষা করে।
জীবনের ভারসাম্যের চাবিকাঠি
ইমিউন সিস্টেমের এই “ব্রেক মেকানিজম” বা অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার আবিষ্কার চিকিৎসাবিজ্ঞানে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। এটি প্রমাণ করেছে, অনাক্রম্যতা মানে শুধু প্রতিরোধ নয়—বরং সহনশীলতা ও আত্মরক্ষার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা।
এই গবেষণার ফল আজ বহু ক্ষেত্রে প্রয়োগ হচ্ছে:
১. অটোইমিউন রোগের চিকিৎসা: Treg কোষ সক্রিয় করে শরীরের আত্মবিধ্বংসী প্রতিক্রিয়া থামানোর চেষ্টা চলছে।
২. ক্যান্সার থেরাপি: অনেক টিউমার Treg কোষের আশ্রয়ে প্রতিরোধ এড়িয়ে যায়—সেই “ব্রেক” খুলে দিতে নতুন ওষুধ তৈরি হচ্ছে।
৩. অঙ্গ প্রতিস্থাপন: শরীর যাতে প্রতিস্থাপিত অঙ্গকে প্রত্যাখ্যান না করে, সেজন্য Treg-ভিত্তিক থেরাপি নতুন আশার আলো।
৪. অ্যালার্জি ও প্রদাহজনিত রোগে: দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ কমাতে Treg কোষ নিয়ন্ত্রণের ওপর গবেষণা চলছে।
বিজ্ঞান থেকে দর্শনে
তিন বিজ্ঞানীর আবিষ্কার শুধু একটি জিন বা কোষের নয়—এটি মানবদেহের এক গভীর দর্শনকে তুলে ধরেছে।
আমাদের শরীরের প্রতিটি কোষ যেন বলে, “যুদ্ধ নয়, সহনশীলতা।”
জীবন টিকে থাকে শান্তির ওপর—আর সেই শান্তি রক্ষাকারী সৈন্যরা হলো আমাদের Regulatory T Cell।
নোবেলজয়ী এই আবিষ্কার শুধু চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসেই নয়, মানবজীবনের অস্তিত্ব রক্ষার দর্শনেও এক যুগান্তকারী সংযোজন।
#
লেখক:
সৈয়দ আমিরুজ্জামান
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট;
বিশেষ প্রতিনিধি, ইংরেজি দৈনিক দ্য ফিনান্সিয়াল পোস্ট ও সাপ্তাহিক নতুনকথা;
সম্পাদক, আরপি নিউজ
কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, জাতীয় কৃষক সমিতি।
মুঠোফোন: ০১৭১৬৫৯৯৫৮৯