চা শ্রমিক ইউনিয়নের ৯ সদস্যের নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠিত: সময়োচিত পদক্ষেপ নাকি বিতর্কের সূচনা?

প্রকাশিত: ৭:০৫ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ১৩, ২০২৫

চা শ্রমিক ইউনিয়নের ৯ সদস্যের নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠিত: সময়োচিত পদক্ষেপ নাকি বিতর্কের সূচনা?

Manual6 Ad Code

বিশেষ প্রতিনিধি | শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার), ১৩ অক্টোবর ২০২৫ : বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন (রেজি: নং বি-৭৭)-এর ত্রি-বার্ষিক নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে ৯ সদস্য বিশিষ্ট একটি নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করেছে সরকার। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বিভাগীয় শ্রম দপ্তরের উপ-পরিচালক মহব্বত হোসাইনকে প্রধান করে পুনর্গঠিত এ কমিশনে সরকারি কর্মকর্তা ছাড়াও বিভিন্ন চা বাগানের প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

নির্বাচন কমিশনের অন্যান্য সদস্যরা হলেন আঞ্চলিক শ্রম দপ্তরের উপ-পরিচালক অবীর চন্দ্র বালা, বিভাগীয় শ্রম দপ্তরের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ আব্দুস সাব্বির ভূঁইয়া, এবং চা বাগান পর্যায়ের প্রতিনিধি হিসেবে মনি শংকর বাউরি (দেওন্দি চা বাগান), দিপেন বুনার্জী (ফুলতলা), মঞ্জুস তাঁতি (রাজঘাট), মো. কাউসার আহমেদ (পাত্রখোলা), সন্তোষ লোহার (ভাড়াউড়া), ও মহেশ রায় (তারাপাসা চা বাগান)।

গঠনতন্ত্রের অনুচ্ছেদ-০৯ (জ), ২০০৬ সালের বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০১৫ সালের শ্রম বিধিমালা, এবং সুপ্রিম কোর্টের রিট পিটিশন নং ৭৩৭২/২০১১ ও ৪৩১৬/২০১৬-এর নির্দেশনা অনুযায়ী এই কমিশন পুনর্গঠন করা হয়েছে বলে শ্রম অধিদপ্তর থেকে জানানো হয়। শ্রম অধিদপ্তরের ট্রেড ইউনিয়ন শাখার মহাপরিচালক এ কে এম তরিকুল আলম স্বাক্ষরিত ও পরিচালক শামীমা সুলতানা বারী অনুস্বাক্ষরিত অফিস আদেশে কমিশন পুনর্গঠনের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়।

অফিস আদেশে বলা হয়, “ত্রিবার্ষিক নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও স্বচ্ছভাবে সম্পন্ন করার জন্য কমিশন গঠিত হয়েছে। প্রয়োজনীয় ব্যয় বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের ফান্ড থেকে কমিশনের মাধ্যমে নির্বাহ করা হবে।”

এ আদেশের অনুলিপি প্রদান করা হয়েছে মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট, চট্টগ্রাম ও রাঙ্গামাটি জেলার জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও পুলিশ সুপার (এসপি), শ্রম মন্ত্রণালয়ের সচিবের একান্ত সচিব, চা শিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশীয় চা সংসদ, এবং সংশ্লিষ্ট শ্রম দপ্তরের কর্মকর্তাদের কাছে।

বিতর্কের সূত্রপাত: গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন

নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনকে ঘিরে ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনা ও বিতর্ক শুরু হয়েছে।

চা শ্রমিক সমাজের তরুণ ও নারী নেতৃত্বের অন্যতম মুখ গীতা রাণী কানু তার ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন—
“লেবার ডিপার্টমেন্ট দ্বারা পুনর্গঠিত চা শ্রমিক ইউনিয়নের নির্বাচন কমিশন কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এটি মহামান্য হাইকোর্টের আদেশ লঙ্ঘন করে প্রহসনের নির্বাচন আয়োজনের উদ্দেশ্যে করা হয়েছে, যাতে দুর্নীতিবাজ নেতৃত্ব পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে আসে এবং মালিক পক্ষ শ্রমিকদের শোষণের প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে পারে।”

তিনি দাবি করেন, “একটি অন্তর্বর্তীকালীন কমিটি গঠন করে গঠনতন্ত্র সংশোধনের মাধ্যমে নির্বাচন আয়োজন করা উচিত। অন্যথায় আইনি পদক্ষেপ ও আন্দোলনের পথে যেতে হবে।”

অন্যপক্ষের প্রতিক্রিয়া: সময়মতো নির্বাচন জরুরি

অন্যদিকে, বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাবেক সাধারণ সম্পাদক রামভজন কৈরি সামাজিক মাধ্যম ফেসবুক পোস্টে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের সিদ্ধান্তকে “বহুল কাঙ্ক্ষিত” বলে স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি লিখেছেন—
“বাচাশ্রই নির্বাচন কমিশনকে স্বাগত ও অভিনন্দন জানাই। আশা করি কমিশন গঠনতন্ত্র অনুযায়ী নির্বাচন সম্পন্ন করবে এবং চা শ্রমিকদের সংগঠনকে শক্তিশালী করবে।”

Manual2 Ad Code

এ সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে এক প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন (রেজি: নং বি-৭৭) এর ত্রি-বার্ষিক নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে বিদ্যমান গঠনতন্ত্রের অনুচ্ছেদ -০৯ (জ) বিধান মোতাবেক ৯ সদস্যের নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনকে স্বাগত জানিয়ে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির মৌলভীবাজার জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, ইংরেজি দৈনিক দ্য ফিনান্সিয়াল পোস্ট ও সাপ্তাহিক নতুন কথা-এর বিশেষ প্রতিনিধি, আরপি নিউজ-এর সম্পাদক ও বিশিষ্ট কলামিস্ট কমরেড সৈয়দ আমিরুজ্জামান বলেছেন—
“চা শ্রমিক ইউনিয়নের নির্বাচন সময়মতো হওয়া অত্যন্ত জরুরি। কারণ এটি কেবল সংগঠনের গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতার বিষয় নয়, বরং চা শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি, সামাজিক সুরক্ষা, ভূমি অধিকার ও মর্যাদাপূর্ণ জীবনের জন্য সংগঠিত দাবি উত্থাপনের মাধ্যম।”

তিনি আরও বলেন, চা শিল্পে বৈষম্য দুর করা, চা শ্রমিকদের জন্য ন্যায্য মজুরি নির্ধারণ করা, চা শ্রমিকদের দাবি তুলে ধরা ও দরকষাকষি করা, ভূমি অধিকার, সামাজিক সুরক্ষা, মর্যাদাপূর্ণ মানবিক জীবন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে শক্তিশালীর নিমিত্তে ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার অবাধে নিশ্চিত করার বিষয়টি সর্বোপরি বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের নির্বাচন সময়মতো হওয়াটা খুবই জরুরি। এ বিষয়টিকে অন্য কোনো যুক্তিতে ignore বা অস্বীকার করার সুযোগ নেই।

তিনি আরও বলেন, “শ্রমিক নেতৃত্বে জবাবদিহিতা আনতে এবং মালিক পক্ষ ও রাষ্ট্রের সঙ্গে দরকষাকষির ক্ষমতা বাড়াতে নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই।”

আইন ও গঠনতন্ত্রের দৃষ্টিকোণ

Manual4 Ad Code

বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০০৬ সালের বাংলাদেশ শ্রম আইন এবং ২০১৫ সালের শ্রম বিধিমালা অনুযায়ী যে কোনো ট্রেড ইউনিয়নের নির্বাচন “গঠনতন্ত্র-নির্ধারিত সময়ের মধ্যে” সম্পন্ন করতে হয়।
চা শ্রমিক ইউনিয়নের ক্ষেত্রে অতীতে বেশ কয়েকবার নির্বাচন বিলম্বিত হয়েছে, যা সংগঠনের বৈধ নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল।

অন্যদিকে, হাইকোর্টের রায় (রিট ৭৩৭২/২০১১ ও ৪৩১৬/২০১৬) অনুযায়ী শ্রমিক ইউনিয়নের নির্বাচন কমিশন গঠনের ক্ষেত্রে প্রশাসনিক তত্ত্বাবধান বৈধ হলেও “শ্রমিক প্রতিনিধিত্বের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে হবে।”
সেই অর্থে, নতুন কমিশনের কাঠামোয় সরকারি কর্মকর্তাদের সংখ্যাধিক্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

চা শিল্পে প্রেক্ষাপট

Manual8 Ad Code

বাংলাদেশে প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার নিবন্ধিত চা শ্রমিক এবং আরও কয়েক লাখ অস্থায়ী শ্রমিক দেশের অন্যতম প্রাচীন এই শিল্পে কাজ করেন। তাদের অধিকাংশই সিলেট, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার ১৬০টিরও বেশি চা বাগানে নিয়োজিত।
এই শ্রমজীবী জনগোষ্ঠী দেশের রপ্তানি আয়ে ভূমিকা রাখলেও, তাদের ন্যূনতম মজুরি, সামাজিক নিরাপত্তা ও আবাসনের মান নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই অসন্তোষ রয়েছে।

ইউনিয়নের নেতৃত্ব এই দাবিগুলো রাষ্ট্র ও মালিক পক্ষের কাছে উপস্থাপন করে থাকে। ফলে ইউনিয়নের নির্বাচন কেবল নেতৃত্বের পরিবর্তন নয়, বরং শ্রমিক রাজনীতির গতিপথ নির্ধারণেও বড় ভূমিকা রাখে।

তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ: শ্রম রাজনীতির দ্বন্দ্ব ও গণতান্ত্রিক পুনর্গঠন

শ্রম আন্দোলনের তত্ত্ব অনুযায়ী, ট্রেড ইউনিয়ন গণতন্ত্র কেবল ভোটের মাধ্যমে নেতৃত্ব নির্ধারণ নয়; বরং এটি সংগঠনের নীতি, আদর্শ ও শ্রমিকদের ক্ষমতায়নের প্রক্রিয়া।
একটি ইউনিয়নের নির্বাচন বিলম্বিত হলে সেখানে “প্রতিনিধিত্বের সংকট” সৃষ্টি হয়, যা শ্রমিক আন্দোলনের দুর্বলতার কারণ হয়।

তবে শ্রম মন্ত্রণালয়-নির্ভর নির্বাচন কমিশন গঠন করলে তার স্বচ্ছতা ও স্বাধীনতা প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে—এটি শ্রম রাজনীতির দীর্ঘদিনের একটি বিতর্ক।
শ্রমিকদের দাবি, কমিশন যেন শ্রমিক-নেতৃত্বাধীন, স্বতন্ত্র ও অংশগ্রহণমূলক হয়; আর সরকারের অবস্থান, নির্বাচন যেন আইনি কাঠামোর মধ্যে ও প্রশাসনিক তত্ত্বাবধানে হয়।

Manual3 Ad Code

এই দুই দৃষ্টিভঙ্গির সংঘাতই চা শ্রমিক ইউনিয়নের নির্বাচনকে একটি “শ্রম রাজনীতির পরীক্ষাক্ষেত্র” হিসেবে দাঁড় করিয়েছে।

উপসংহার

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন নিঃসন্দেহে একটি সময়োপযোগী পদক্ষেপ। তবে এর গ্রহণযোগ্যতা নির্ভর করবে কমিশনের নিরপেক্ষতা, স্বচ্ছতা এবং শ্রমিক সমাজের আস্থার উপর।

চা শ্রমিকদের সংগঠন কেবল শিল্প নয়, এটি একটি ঐতিহাসিক শ্রম আন্দোলনের প্রতীক। তাই এই নির্বাচনকে ঘিরে যে বিতর্ক ও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে, তা বাংলাদেশের শ্রম রাজনীতির ভবিষ্যৎ গণতান্ত্রিক চর্চার দিকও নির্দেশ করছে।

#

 

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

 


Follow for More!

Manual1 Ad Code
Manual8 Ad Code