সিলেট ১৩ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৮শে কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৭:২৩ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ১২, ২০২৫
বিশেষ প্রতিনিধি | বেলেম (ব্রাজিল), ১২ নভেম্বর ২০২৫ : জলবায়ু পরিবর্তনের ধ্বংসাত্মক প্রভাব প্রতিনিয়ত তীব্রতর হয়ে ওঠায়, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি রোধে জরুরি এবং সমন্বিত আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ এখন অনিবার্য। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চরম আবহাওয়া, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, বন্যা, খরা ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়গুলো প্রমাণ করছে যে, পৃথিবীর পরিবেশ ব্যবস্থা দ্রুত সংকটের দিকে এগোচ্ছে। ঠিক এমন পরিস্থিতিতেই কপ৩০-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ জলবায়ু সম্মেলনকে কেন্দ্র করে বিশ্বের দৃষ্টি আজ ব্রাজিলের আমাজন অঞ্চলের বেলেম শহরে উপর। জলবায়ু সংকটের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ক্রমবর্ধমান প্রয়োজনীয়তার পটভূমিতে অনুষ্ঠিত এই কপ৩০-এ বিশ্ব নেতারা ব্রাজিলে জড়ো হয়েছে। সম্মেলনে প্রায় ২০০ দেশের প্রতিনিধি, মন্ত্রী ও বিশেষ দূত উপস্থিত হয়েছেন। বৈশ্বিক উষ্ণতা, গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন, জলবায়ু অর্থায়ন, ক্ষয়ক্ষতি ও ক্ষতিপূরণ এবং নবায়নযোগ্য শক্তিতে রূপান্তরের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নিয়ে বিশ্ব নেতারা এ সম্মেলনে সমাধানমুখী আলোচনা ও বাস্তবায়নভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের লক্ষ্যে মিলিত হন।
বিশ্ব যখন ব্রাজিলে কপ৩০ সম্মেলনে জলবায়ু সংকট নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত, তখন চীন নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে দ্রুত অগ্রগতি ইতিবাচক বার্তা দিচ্ছে।
চীনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আগামী পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় নিম্ন-কার্বন শক্তি ব্যবস্থাকে কেন্দ্রীয় অগ্রাধিকার হিসেবে রাখা হবে। গত ১৮ মাস ধরে চীনের কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন স্থির রাখতে সক্ষম হয়েছে। সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ার (CREA) এর বিশ্লেষণে দেখা গেছে যে, ২০২৫ সালের শেষদিকে চীনের কার্বণ ডাই অক্সাইড নির্গমন পূর্বের বছর তুলনায় অপরিবর্তিত ছিল, যার একটি কারণ যাতায়াত ব্যবস্থা, সিমেন্ট এবং ইস্পাত শিল্পের নির্গমন হ্রাস। পরিস্থিতি অনুকূল থাকলে ২০২৫ সালজুড়েই চীনের মোট নির্গমন হ্রাস পেতে পারে। চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনে যোগ দেননি, তবে চীনা প্রতিনিধিদলের উপস্থিত আলোচনায় রয়েছেন। তবে উদ্বেগের জায়গা হলো ২০২০ থেকে ২০২৫ সময়কালে জিডিপি-প্রতি কার্বণ ডাই অক্সাইড নিঃসরণ কমানোর যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল, তা অর্জনে চীন পিছিয়ে রয়েছে। ফলে ২০০৫ সালের তুলনায় ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন তীব্রতা ৬৫% কমানোর প্রতিশ্রুতি রক্ষায় আরও কঠোর পদক্ষেপ প্রয়োজন হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর গ্যাভিন নিউসম কপ৩০ সম্মেলনে আশ্বাস দিয়ে বলেন যে, তার রাজ্য ক্যালিফোর্নিয়া সবুজ প্রযুক্তি এবং জলবায়ুকে অগ্রাধিকার দেবে। তিনি ট্রাম্পের ক্যালিফোর্নিয়ায় তেল-গ্যাস তুরপুনের পরিকল্পনা ঠেকাতে শপথ নিয়েছেন এবং প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্র প্রত্যাহারকে “জঘন্য” বলে অভিহিত করেছেন, যা চীনকে পরিচ্ছন্ন শক্তিতে আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ দিচ্ছে।
বিপর্যয়কর টিপিং পয়েন্ট এড়াতে বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড অপসারণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে অবিহিত করেছেন পটসডাম ইনস্টিটিউট ফর ক্লাইমেট ইমপ্যাক্ট রিসার্চের শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞানী এবং জাতিসংঘ এবং কপ৩০ প্রেসিডেন্সির একজন প্রধান বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা, জোহান রকস্ট্রোম। তিনি আরও বলেন যে, বিশ্ব উষ্ণতা ১.৭ ডিগ্রি সে. এ সীমাবদ্ধ রাখতে প্রতি বছর বাতাস থেকে ১০ বিলিয়ন টন কার্বন ডাই অক্সাইড সংগ্রহ বা অপসারণ করতে হবে।
আগামী ৫ থেকে ১০ বছরে বিশ্ব প্যারিস চুক্তির ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করবে বলে জাতিসংঘের বিজ্ঞানীরা জানান।
স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিস ফিল্ড বলেন যে, “বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস লক্ষ্যমাত্রা ধরে রাখা উচিত কারণ পৃথিবী যত বেশি সময় ধরে এর বাইরে থাকবে, অ্যান্টার্কটিকা, গ্রিনল্যান্ড এবং আমাজন রেইনফরেস্ট সহ আরও বেশ কিছু অঞ্চলের টিপিং পয়েন্ট অতিক্রমের ঝুঁকি তত বেশি হবে।
বিজ্ঞানীদের ধারণা অনেক প্রবাল প্রাচীর ব্যবস্থা ইতিমধ্যেই ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার সেই সর্বোচ্চ বিন্দু অতিক্রম করে ফেলেছে। বিজ্ঞানীরা চাচ্ছেন কপ৩০ এর মাধ্যমে এই টিপিং পয়েন্ট বা বিপজ্জনক মাত্রা প্রতিরোধ করার জন্য বিশ্ববাসীকে একত্রিত করতে।
কপ-এর দ্বিতীয় দিনের সন্ধ্যায় কপ৩০ সম্মেলনের প্রতিনিধিরা যখন বের হচ্ছিলেন, ঠিক তখনই আদিবাসী ও পরিবেশ আন্দোলনকারী একটি দল নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেঙে ঢুকে পড়েন। মুহূর্তেই বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ে পুরো সম্মেলন এলাকায়। “আমাদের বন বিক্রয়ের জন্য নয়” এবং “আমাদের ছাড়া আমাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না” স্লোগান দিয়ে প্রতিবাদকারীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে। তারা বলেন যে, সম্মেলন আয়োজনের জন্য বেলেমে বিশাল অবকাঠামো নির্মাণে অর্থ ব্যয় হয়েছে, কিন্তু আদিবাসী সম্প্রদায়ের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বন সংরক্ষণে তহবিল নেই। কায়াপো প্রধান রাওনি আমাজন অবকাঠামো প্রকল্পের সমালোচনা করেছেন ব্রাজিলের অন্যতম বিশিষ্ট আদিবাসী নেতা কায়াপো প্রধান রাওনি, দেশটির সরকারকে আমাজন রেইনফরেস্ট সংরক্ষণের জন্য আদিবাসীদের ক্ষমতায়নের আহ্বান জানিয়েছেন। অপরদিকে, ছোট দ্বীপ রাষ্ট্রগুলি বৈশ্বিক উষ্ণতার জন্য ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস সীমাকে “একটি জীবনরেখা” হিসেবে বর্ণনা করেছে এবং দাবি করেছে যে বিশ্ব এটিকে সম্মান করবে।
কপ৩০-এ মূলত জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় বাস্তবায়নভিত্তিক কার্যক্রমকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। এ সম্মেলনের তৃতীয় দিনে প্যারিস চুক্তির অধীনে গ্লোবাল স্টকটেকের অগ্রগতি পর্যালোচনা, নির্গমন হ্রাসের নতুন লক্ষ্য নির্ধারণ ও দেশগুলোর বাস্তবায়ন পরিকল্পনাকে মূল্যায়ন করা হবে। জলবায়ু অর্থায়নে ১০০ বিলিয়ন ডলার প্রতিশ্রুতির অগ্রগতি, লস এন্ড ড্যামেজ তহবিলের কাঠামো চূড়ান্ত করা, নবায়নযোগ্য জ্বালানির রোডম্যাপ, কয়লা ও জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে ধীরে ধীরে সরে আসা, অভিযোজন সহায়তা বৃদ্ধি এবং ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জন্য প্রযুক্তি স্থানান্তর ও সক্ষমতা উন্নয়ন ইত্যাদি বিষয়গুলো আলোচনার কেন্দ্রে থাকবে। পাশাপাশি বন সংরক্ষণ, সমুদ্র ও জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা, খাদ্য নিরাপত্তা, জলবায়ু ন্যায়বিচার, কার্বন বাজার ও আর্টিকেল ৬ বাস্তবায়ন সংক্রান্ত আলোচনাও পর্যায়ক্রমে অনুষ্ঠিত হবে। তবে বাংলাদেশের প্যাভিলিয়নটি এখনও উদ্বোধনের অপেক্ষায় প্রহর গুনছে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (জলবায়ু পরিবর্তন শাখা) মোহাম্মদ নাভিদ সাইফুল্লাহ অতি শীঘ্রই প্যাভিলিয়নটি উদ্বোধন করবেন। এই প্যাভিলিয়নেই বাংলাদেশের বিভিন্ন স্তরের প্রতিনিধিগণ দেশের বর্তমান চিত্র, ভবিষ্যতের ঝুঁকি, সরকারের পরিকল্পনা ও বিশ্ব মঞ্চে এদেশের মানুষের দাবী তুলে ধরবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
কপ৩০ হবে প্রতিশ্রুতির চেয়ে বাস্তব ফলাফল নিশ্চিত করার সম্মেলন, যেখানে দেশগুলোকে স্পষ্ট সময়সীমা, নীতি ও অর্থায়ন পরিকল্পনা উপস্থাপন করতে হবে। উল্লেখ্য, রয়টার্সের তথ্য অনুযায়ী, কপ৩২ সম্মেলনটি ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবায় আয়োজন করা হবে।

সম্পাদক : সৈয়দ আমিরুজ্জামান
ইমেইল : rpnewsbd@gmail.com
মোবাইল +8801716599589
৩১/এফ, তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০।
© RP News 24.com 2013-2020
Design and developed by ওয়েব নেষ্ট বিডি