শিক্ষা দিবসের তাৎপর্য আজও অব্যাহত

প্রকাশিত: ২:১৩ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২০

শিক্ষা দিবসের তাৎপর্য আজও অব্যাহত

Manual4 Ad Code

|| রাশেদ খান মেনন || ঢাকা, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ : সতেরো সেপ্টেম্বর দিনটিকে এদেশের ছাত্র সংগঠনগুলো শিক্ষা দিবস হিসেবে পালন করে। তবে এ দিবসটি কী, এ দিবসের তাৎপর্যই বা কী তা বর্তমান প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের কাছে খুব পরিস্কার কিনা আমার জানা নেই। তাদেরই বা দোষ কী। আমরা যারা সেই প্রজন্মের, যারা ওই শিক্ষা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলাম তারাই-বা এ সম্পর্কে বর্তমান প্রজন্মকে কতটুকু জানিয়েছি। যে শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে ওই শিক্ষা আন্দোলন হয়েছিল, সে সম্পর্কেই এখনও বিভ্রান্তি রয়েছে। শুদ্ধ করে দেওয়ার পরও সংবাদপত্রে তো বটেই, বহু বিদগ্ধজনের লেখায়ও ওই আন্দোলনকে হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশনবিরোধী আন্দোলন বলা হয়। প্রকৃত তথ্য হচ্ছে বাষট্টির ওই শিক্ষা আন্দোলন ছিল শরীফ শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে। আইয়ুব খান সরকার শরীফ শিক্ষা কমিশনের সুপারিশের বাস্তবায়ন স্থগিত করে এবং কী কারণে ছাত্ররা ওই শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টের বিরোধিতা করছে তা পর্যালোচনা করে নতুন করে সুপারিশ দিতে বিচারপতি হামুদুর রহমানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশন বলে কোনো শিক্ষা কমিশন হয়নি। সুতরাং ওই নামে কোনো শিক্ষা কমিশন ছিল না। তবে হামুদুর রহমান শরীফ কমিশনের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনের কার্যকারণ পর্যালোচনা করে যে রিপোর্ট দেন ও সুপারিশ করেন তা ছিল আরও প্রতিক্রিয়াশীল এবং ছাত্রদের গণতান্ত্রিক অধিকার ও শিক্ষার অধিকারের বিরুদ্ধে। সে সময়ের সব ছাত্র সংগঠনই ওই পর্যালোচনা রিপোর্ট ও এর সুপারিশ প্রত্যাখ্যান করে। তবে এ নিয়ে কিছু সভা-সমাবেশ আর বিবৃতি প্রদান ছাড়া বিশেষ কিছু হয়নি। এর কারণ শরীফ কমিশন রিপোর্ট বাস্তবায়ন স্থগিত হলে তার সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে যেসব বিধান শিক্ষা ক্ষেত্রে চালু হয়েছিল তাও প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছিল। ছাত্ররা এটা তাদের বিজয় হিসেবে দেখেছিল। তাই হামুদুর রহমান তার পর্যালোচনায় কী বলেছিলেন তা নিয়ে তারা বিশেষ মাথা ঘামায়নি। আইয়ুববিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন ততদিনে নতুন পর্যায়ে উপনীত ও বেগবান হয়েছে। ফলে হামুদুর রহমান রিপোর্ট তাদের বিশেষ মনোযোগ কাড়েনি। অন্যদিকে আইয়ুব সরকারও যেসব উদ্যোগ নিয়েছিল তা নিয়ে আর বিশেষ এগোয়নি। তবে আইয়ুব শাসনামলে বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে শরীফ কমিশন বা হামুদুর রহমান যেসব সুপারিশ দিয়েছিলেন, খণ্ডিতভাবে তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। উদাহরণস্বরূপ বাংলা ও উর্দু বর্ণমালার উন্নয়নের নামে রোমান হরফে তা পরিবর্তন করা, প্রাথমিক পর্যায় থেকেই আরবি শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা, শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ ইত্যাদি। ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় এসে আইয়ুবের অনুরূপ এয়ার মার্শাল নুর খানকে দিয়ে আরেকটি শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। সেই শিক্ষা কমিশনের সুপারিশও একইভাবে বৈষম্যমূলক ও প্রতিক্রিয়াশীল ছিল। তবে তা বাস্তবায়নের কোনো সুযোগ ইয়াহিয়া খান পাননি।

পাকিস্তান আমলের এসব শিক্ষা সম্পর্কিত সুপারিশের অভিজ্ঞতার আলোকে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর বঙ্গবন্ধুর সরকার কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন গঠন করে এবং কমিশন যতদূর মনে আছে, চুয়াত্তরে তার রিপোর্ট প্রদান করে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে প্রণীত এই শিক্ষানীতি কেবল প্রগতিশীলই ছিল না, ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলের ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তে নতুন রাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের সুপারিশ করেছিল। তবে সেই সময়কার ক্ষমতাসীন দলের দৃষ্টিভঙ্গির পরিপ্রেক্ষিতে ওই শিক্ষানীতি কতখানি বাস্তবায়িত হতো জানা নেই। ইতোমধ্যে পঁচাত্তরের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্টটি অন্ধকারের অতলান্ত গহ্বরে চলে যায়।

পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এলে তার শিক্ষামন্ত্রী কাজী জাফর একটি শিক্ষানীতি দেন। কাজী জাফরের মন্ত্রিত্ব থেকে বিদায় আর জিয়াউর রহমানের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ শাসনামলে ওই শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। পরবর্তী সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদ এসে একই কায়দায় শিক্ষা সংস্কারের উদ্যোগ নেন এবং মজিদ খানের শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। এই কমিশন প্রণীত শিক্ষানীতিও এদেশের ছাত্ররা রক্ত দিয়ে প্রত্যাখ্যান করে। তিরাশির চৌদ্দ ফেব্রুয়ারি জাফর-জয়নালের রক্তে স্নাত হয় মজিদ খানের শিক্ষানীতি। এরশাদও জিয়ার মতোই আর শিক্ষা সংস্কার নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে প্রথমে ‘নতুন বাংলা ছাত্রসমাজ’ ও পরে ‘জাতীয় ছাত্রসমাজ’ নামে শিক্ষাঙ্গনে ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী গড়ে তুলতে বেশি উৎসাহী ছিলেন। নব্বইয়ের ছাত্ররা সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের নেতৃত্বে সেই ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হটিয়ে দিয়ে গণঅভ্যুত্থানের সূচনা করেছিল। তবে এদেশের শিক্ষা ও শিক্ষার্থীদের দুর্ভাগ্য এমনই যে, নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান-উত্তর বিএনপির খালেদা জিয়ার সরকার সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের দশ দফার সামান্যতমও পূরণ করেনি। ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর শেখ হাসিনার সরকার ২০০৯ সালে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়নে শিক্ষা কমিশন গঠন করে এবং ২০১০ সালে তাদের দেওয়া শিক্ষানীতি জাতীয় সংসদ সর্বসম্মতভাবে অনুমোদন করে।

শিক্ষা কমিশন ও শিক্ষানীতি এই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটেই বাষট্টির শরীফ শিক্ষা কমিশনবিরোধী আন্দোলনের তাৎপর্যটি বিচার করা প্রয়োজন।

Manual3 Ad Code

প্রথমত, এটা ছিল প্রথম ও একমাত্র ছাত্র আন্দোলন, যা জাতীয়ভাবে সমগ্র ছাত্রসমাজকে আলোড়িত করেছিল এবং দেশের সুদূর প্রাসঙ্গিক পর্যন্ত সর্বস্তরের ছাত্রছাত্রীরা ওই আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল।

Manual5 Ad Code

দ্বিতীয়ত, এটা ছিল শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে ছাত্রদের নিজেদের আন্দোলন। এর সঙ্গে ও পরে শিক্ষার দাবি নিয়ে ছাত্ররা খণ্ড খণ্ডভাবে আন্দোলন করেছে। কিন্তু বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন ছিল সামগ্রিক।

Manual7 Ad Code

তৃতীয়ত, এর লক্ষ্য বৈষম্যমূলক ও সাম্প্রদায়িক শিক্ষাব্যবস্থার বিপরীতে একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন, যার মূল বিষয় ছিল শিক্ষাব্যবস্থায় যে বিভক্তি রয়েছে তা দূর করে একমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন, শিক্ষাকে ব্যবসায়িক বিনিয়োগের বদলে সামাজিক বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচনা করা, দেশের সম্পদের একটা বড় অংশ শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ, শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ পরিহার করা এবং শিক্ষাকে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব হিসেবে গ্রহণ করা, শিক্ষাক্ষেত্রে নৈরাজ্য, দুর্নীতি বন্ধ, বৈষম্য দূর করা প্রভৃতি।

২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতিতে এদেশের ছাত্রসহ শিক্ষাবিদদের বাষট্টি থেকে লালিত ভাবনার প্রতিফলন ঘটেছিল। আর এ কারণেই একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক সমতাভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলার স্লোগানে ক্ষমতাসীন সরকার এর বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।

সম্প্রতি ওই শিক্ষানীতির পুনর্মূল্যায়ন ও এর সংস্কারের কথা এসেছে। কিন্তু যে শিক্ষানীতির মূল বিষয়গুলোই বাস্তবায়িত হয়নি তার মূল্যায়ন বা পুনর্মূলায়ন কীভাবে হবে। বরং ইতোমধ্যে বাংলাদেশের শিক্ষা আরও পিছিয়েছে। একমুখী শিক্ষার জায়গায় শিক্ষাব্যবস্থা আরও বিভক্ত হয়েছে। শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ চূড়ান্ত। বাজেটে শিক্ষার বরাদ্দ এগিয়ে দেখানো হলেও জিডিপির অংশ হিসেবে পৃথিবীতে তো বটেই, দক্ষিণ এশিয়ায় আফগানিস্তান বাদে অন্যদের পেছনে। করোনার কারণে ডিজিটাল সুবিধা ব্যবহার করে শিক্ষাক্রম অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রেও সৃষ্টি হয়েছে চরম বৈষম্য। অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হতে পারেনি।

মোদ্দা বিষয় হলো বাষট্টি থেকে দু’হাজার দশ পর্যন্ত সংগ্রাম ও অপেক্ষা করে যে শিক্ষানীতি পাওয়া গিয়েছিল তাও যখন লোপাট হতে বসে তখন বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন ও সতেরো সেপ্টেম্বরের শিক্ষা দিবসের তাৎপর্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দেয়। এবারও করোনায় নিউ নরমাল বা নতুন স্বাভাবিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সতেরো সেপ্টেম্বর তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

Manual5 Ad Code

#
রাশেদ খান মেনন এমপি
সভাপতি, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

 


Follow for More!

Manual1 Ad Code
Manual3 Ad Code