সংকট মোকাবিলায় গ্রামীন কর্মসংস্থানই হতে হবে অর্থনীতির মূলভিত্তি

প্রকাশিত: ২:২৬ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ৩০, ২০২০

ড. সুশান্ত দাস, ৩০ এপ্রিল ২০২০ : আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আই এল ও) বলছে, করোনা ভাইরাসের কারণে বিশ্বজুড়ে অব্যাহতভাবে কর্মঘন্টা কমে যাওয়ায় প্রায় ১৬০ কোটি মানুষ জীবিকা হারানোর ঝুঁকিতে আছে,

ড. সুশান্ত দাস

যা বিশ্বের মোট কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর প্রায় অর্ধেক। চিত্রটি উদ্বেগজনক। গোটা পৃথিবী ভাবতে বসেছে।

এই হতাশাজনক অবস্থার বিপরীতে আমাদের মত দেশে করোনার দূর্বিসহ অবস্থার মধ্যেও পর্দার আড়ালে একটি অত্যন্ত সম্ভাবনাময় চিত্রের অবতারণা হয়েছে। আমাদের দেশে শহুরে জীবনে যারা বাড়তি বলে অবহেলিত মনে হয় অথবা মনে হতো, সেই জনগোষ্ঠীকে আমাদের দেশের গ্রামীন সমাজ এই দুঃসময়ে বড় দুর্যোগ ছাড়াই অন্ততঃ এই কিছু সময়ের জন্যেও আত্মীকরণ করে নিয়েছে। অর্থাৎ আমাদের দেশের গ্রামীন সমাজের একটি অন্তঃর্নিহিত ক্ষমতা রয়েছে এই জনগোষ্ঠীকে ধারণ করতে পারার। এই সংকটের সময়ে আমাদের গ্রাম হাঁপিয়ে ওঠেনি। এটি একটি অসম্ভব শক্তিশালী সম্ভাবনা। এই চিত্র আমাদের অর্থনীতিকে নতুন করে চাংগা করার একটি দিক নির্দেশনার ঈংগিত দিচ্ছে। কৃষিকে প্রধান ভিত্তি করে গ্রামীন কর্মসংস্থানের মহাপরিকল্পনা, রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক সুযোগের বিকেন্দ্রীকরণ অর্থাৎ জনজীবনের ‘ভরকেন্দ্র’ শহর থেকে গ্রামের দিকে বিন্যস্ত করার অবশ্য করণীয় দিকনির্দেশনা স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রশিক্ষণ, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষির সংগে সম্পর্কিত শিল্পায়ন, তার সংগে কর্মসংস্থান, বাজার ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ, দ্রুত যোগাযোগ বা নির্ভরযোগ্য গণ পরিবহণের বিস্তৃতি, গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুতের সরবরাহ নিশ্চিত করে পরিকল্পিত গৃহায়নসহ , গ্রামের নাগরিক সুবিধার পরিকল্পনার এখনই ভাবার সময় চলে এসেছে। কারণ এই বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে গ্রামীন পরিকাঠামোতেই ধরে রাখা জরুরি। প্রশাসনিক পরিকাঠামোর পূণর্বিন্যাস, অধিকাংশ প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের চুড়ান্তকরণের ক্ষমতা তৃণমূলে নিয়ে আসা অর্থাৎ শহরে অযথা কর্মহীন, অস্বাস্থ্যকর, উদ্দেশ্যহীন জীবনের পরিবর্তে তরুণদের অধিকতর কর্মমুখী, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করে কর্মময় জীবনের পরিকল্পনার ভিত্তিতে ‘নতুন দেশ’ গড়ার নতুন সম্ভাবনা তৈরি করবে গ্রামমুখী এই কর্মোদ্দীপনা। কার্যকর স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সকল পরিকাঠামোকে গ্রামীন জীবনের প্রয়োজন ও উপযোগিতার সংগে মিলিয়ে পূনর্বিন্যাসের ব্যবস্থা করা হবে ঘুরে দাঁড়ানোর কার্যকর পদক্ষেপ।

দু’একটি সহজ সাধারণ উদাহরণ চিত্রটিকে স্পষ্ট করতে পারে। প্রথমে শিক্ষা ব্যবস্থার কথা ধরা যাক। আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থার যে পরিকাঠামো রয়েছে, তার শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠানগুলো শহরকেন্দ্রিক, আরও সঠিকভাবে বললে বলা যায় প্রধান শহরগুলি কেন্দ্রিক । তথাকথিত ভাল স্কুল, ভালো শিক্ষক, তথাকথিত নামকরা স্কুলে ছেলেমেয়ে ভর্তি করার প্রতিযোগিতা, তথাকথিত ভালো রেজাল্ট করার প্রতিযোগিতা, ভর্তি বাণিজ্য কত ধরণের চিত্র প্রতিদিন দেখা যাচ্ছে। কার্যতঃ বাস্তবতা সেভাবেই তৈরি বলেই এই বাস্তবতার বাইরে কেউ চিন্তা করছে না। অধিকতর সুবিধাসম্পন্ন মানুষ ও তার ভবিষ্যত প্রজন্মই অধিকতর সুযোগ প্রথম পাবে, এটাই বর্তমান ব্যবস্থার বাস্তবতা। কিন্তু বিষয়টাকে যদি পরিকল্পিতভাবে পালটে ফেলা যায়, তা হলে কেমন হয় এবং কেমন করেই তা সম্ভব?
প্রথমতঃ কমিউনিটিকভিত্তিক ভালো স্কুল। প্রতিটি গ্রাম, ইউনিয়ন, উপজেলায়, জনসংখ্যার ভিত্তিতে উচ্চমানের স্কুল থাকবে, যেখানে সকল ছাত্র পড়ার সুযোগ পাবে এবং তা হবে এলাকাভিত্তিক। প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, ভকেশনাল বা বৃত্তিমূলক সবক্ষেত্রের জন্যই তা প্রযোজ্য হবে। কোন ছেলেমেয়েকেই তার ভালো লেখাপড়া পাবার জন্য অন্য কোথায়ও যেন যেতে না হয়। তার ব্যবস্থা করতে হবে। ছাত্ররা যাতে নিজেদের বাড়ীতে থেকে সবচাইতে ভালো শিক্ষার নিশ্চয়তা পেতে পারে তার দায়িত্ব রাষ্ট্রকে নিতে হবে। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গেলেও যেন অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রীরা নিজেদের বাড়ীতে থেকে পড়ার সুযোগ পায় তার ব্যবস্থা করা সম্ভব। উচ্চ-শিক্ষার স্থাপনাকেও বিকেন্দ্রীকরণ করলে এটা সম্ভব। আমাদের মত ছোট আয়তনের দেশে এটা অসম্ভব নয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বিশ্বমানের করতে গেলে তা শহরভিত্তিক হতে হবে তা নয়। বরং পৃথিবীর বহু বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের চারপাশে বরং সুন্দর জীবন গড়ে উঠেছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভারতী স্থাপনের পিছনেও এই চিন্তা ছিল। আমরা যারা শাহজালাল বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার শুরু থেকে ছিলাম, আমরা দেখেছি। সেখানেও তা গড়ে উঠেছিল এক গ্রামীন অবকাঠামোর মধ্যে। কিন্তু দ্রুতই এই বিশ্ববিদ্যালয় দেশের প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছিল। কোন বিশ্ববিদ্যালয় ভালো হবে, সেটা কোথায় প্রতিষ্ঠিত তার উপরে নির্ভর করে না, আরও অনেক কিছুর উপর নির্ভর করে। সেটা আলাদা আলোচনার বিষয়। এখানে প্রাসংগিকতা হল, গ্রামীন জনগোষ্ঠী যেন তার সর্বাধিক সুযোগ পেতে পারে। প্রসংগক্রমে একটি বিষয় উল্লেখ করা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার সময় ছাত্র-ছাত্রীদের প্রথম ক্লাশেই আমার জিজ্ঞাসার বিষয় থাকতো গ্রাম থেকে আসা ছেলেমেয়েরা কতজন সুযোগ পেয়েছে। দীর্ঘ প্রায় ২৫ বছরে আমার অভিজ্ঞতা হলো, ৫ শতাংশের বেশী গ্রাম থেকে আসা ছাত্র-ছাত্রী পাবলিক বিশ্বাবিদ্যালয়ে সুযোগ পায়নি। এ চিত্র মোটামুটি সকল বিশ্বাবিদ্যালয়ে একই। আমাদের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৭৯ শতাংশ গ্রামে বাস করে অথচ, মাত্র ৫ শতাংশ ছেলেমেয়ে উচ্চশিক্ষা লাভ করছে। এ চিত্র নিশ্চয়ই শুভ নয়। তাহলে কি এটাই বলা হবে গ্রামের ছেলেমেয়েরা মেধাবী নয়? অতএব সময় এসেছে এ বিষয়েও গ্রামের দিকেই মুখ ফেরানোর।

দ্বিতীয় বিষয় হিসেবে স্বাস্থ্যব্যবস্থার কথা আনা যেতে পারে। করোনা মহামারি চোখে আংগুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে কি শহর, কি গ্রাম কোথায়ও আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা বলে কোন কাঠামো কার্যকর নয়। ( এবার অবশ্য পৃথিবীর শ্রেষ্ট স্বাস্থ্যপরিকাঠামোর দেশগুলোও চরম পরীক্ষার মুখোমুখি হয়েছে।) আপদ কালীন তো দূরের কথা, স্বাভাবিক সময়ের জন্যেও নয়। আমাদের দেশের গ্রামীণ বিশাল জনগোষ্ঠী প্রকৃত অর্থে স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর বাইরে অবস্থান করে। উপজেলাভিত্তিক তো দূরের কথা, জেলায় স্থাপিত হাসপাতাল বা চিকিৎসাকেন্দ্রের অবস্থা কোনমতেই বিজ্ঞানভিত্তিক বলা চলে না। পরিকাঠামো, চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীদের সংখ্যা, গুণগত মান কোন পর্যায়ের তা সবারই জানা। যাদের টাকা আছে, তারা হাঁচি কাশির চিকিৎসার জন্যও ঢাকামুখি হন। বিদেশের যাবার ব্যাপার ছেড়েই দিলাম। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি হাজার মানুষের জন্য ডাক্তারের সংখ্যা ২.২৬ জন, চীনে ১.৬২ জন, কিউবায় ৬.২৭ জন, বাংলাদেশে ০.৩৮ জন। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ট স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর সঙ্গে আমাদের তুলনার প্রশ্নই নেই। কিন্তু চিত্রটি কি? উপজেলাভিত্তিক যে স্বাস্থ্য পরিকাঠামো রয়েছে তাকে কি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বলা যায়? ডাক্তাররা গ্রামে থাকতে চান না। তাতে আমরা কখনো তাদেরকে চাকরীর ভয় দেখাই, কখনো উপদেশ দেই অথবা নীতিকথা শুনাই জনগণের সেবা করার জন্য, কিন্তু তাঁরা সেখানে কেন থাকতে চাইছেন না বা থাকছেন না তার প্রকৃত কারণ গভীরভাবে আত্মস্থ করতে চাইছি না। অন্য অনেক কারণ আছে, অন্যতম প্রধান কারণ আমাদের দেশের গ্রামীন জীবন ব্যবস্থা, তার ভবিষ্যত সব কিছুই অপরিকল্পিত ও অনিশ্চিত। তাই শুধু ডাক্তার কেন, যে কোন মানুষই সুযোগ পেলে শহরমুখী হন। সময় এসেছে সেটা পালটে ফেলার। তা না হলে, আমাদের অর্থনীতি বা রাজনৈতিক-সামাজিক ভবিষ্যত অনিশ্চিত।
তৃতীয় বিষয় দেশের শ্রমশক্তির ব্যবহার। গ্রামীন শ্রমশক্তির কর্মহীনতা ও অনিশ্চয়তার বিষয়টি প্রধান। তার অনিশ্চয়তা দেশের শ্রমশক্তিকে কোথায় ঠেলে দিচ্ছে, তা আজ স্পষ্ট। শ্রমশক্তির ৮৭.৩ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক। তার কিছু অংশ গ্রামীণ কৃষিতে অনিয়মিতভাবে যুক্ত। বাকীটা বিভিন্ন শহরে ভাসমান অনিশ্চিত জীবনের অংশ। সকল শিল্পের কথা ছেড়েই দিলাম। একটি ক্ষেত্র গার্মেন্টেস শিল্পের কথা ধরা যাক। আমাদের দেশের গার্মেন্টস শিল্পে প্রায় ৪০ থেকে ৪৫ লক্ষ শ্রমজীবি মানুষ কাজ করেন। তাদের মধ্যে প্রায় ৮৫ শতাংশ নারী শ্রমিক। তাদের উৎস স্থল কোথায়? এক কথায় সিংহ ভাগ গ্রামে। কিন্তু, গ্রামীন এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে নিয়ে আসা হলো তথাকথিত শিল্পায়নের নামে শহুরে বস্তিতে। যেখানে স্বাস্থ্য নাই, শিক্ষার ব্যবস্থা নাই, বাসস্থান নাই, জীবনের নিরাপত্তা নাই, আছে প্রতিদিন মালিকের মুনাফা তৈরি করার জন্য অস্বাস্থ্যকর, মানবেতর বস্তিজীবন। সব গার্মেন্টস যেখানে গড়ে উঠেছে, সেখানে সস্তাশ্রমের বাজার হিসেবে গড়ে উঠেছে ঘিঞ্জি বস্তি। আজ থেকে প্রায় দেড় শ বছর আগে মহামতি এংগেলস তার ‘ The condition of the working class in England’ বইতে যে চিত্র তুলে ধরেছিলেন, তার থেকে আলাদা কিছু নয়। যাদের শ্রমে আয় হয় দেশের সিংহ ভাগ বৈদেশিক মুদ্রা, তাদের কথায় বা প্রয়োজনে দেশ চলে না, চলে তাদের শ্রমে যাদের মুনাফা বাড়ে, সেই মালিকদের স্বার্থে, তাদের কথায়। এই করোনা দুর্যোগের সময়ও একই চিত্র দেশবাসী, এখনও দেখছে। এই চিত্রের কথা কার্ল মার্ক্স তার ‘পুঁজি’ গ্রন্থে অনেক আগেই লিখেছেন। আমাদের পড়ার সময় হয় না, কিন্তু, করোনা দু’দিনেই বুঝিয়ে দিল কে কার। করোনা শিখিয়ে দিল, কৃষি বলি, শিল্প বলি আর সভ্যতা বলি, তার ভিত্তি হলো শ্রমজীবি মানুষ, সে শ্রম শারীরিক হোক আর মানসিক হোক। এই শ্রমশক্তিকে ভাল্ভাবে কাজে লাগানোটাই হলো কার্যকর সমাজব্যবস্থা।
এই বিষয়গুলোর চিত্রই এই বাস্তবতায় আমাদের করণীয় স্পষ্ট করে দেয়। সংকট মোকাবিলায় গ্রামীন জীবনব্যবস্থা ও কর্মসংস্থানই হতে হবে অর্থনীতির মূল ভিত্তি।

তাই, আমাদের আজ ভাবতে হবে, দেশ বাঁচানোর চাবিকাঠিটা কোথায়? ভাবতে হবে, শ্রমজীবী কর্মজীবী মানুষকে কিভাবে সর্বোতকৃষ্ট উপায়ে কাজে লাগানো যায়। আমাদের দেশে অন্ততঃ করোনা সংকট দেখিয়ে দিচ্ছে, গ্রামের দিকে মুখ ফেরাতে হবে। আমাদের গ্রাম বাঁচলে শহর বাঁচবে, দেশ বাঁচবে। চাই দীর্ঘমেয়াদি কার্যকর পরিকল্পনা ও রাষ্ট্রীয় নীতি। মুনাফা নয়, মানুষ আর প্রকৃতির কল্যানই হতে হবে সামনের সভ্যতার ‘ভরকেন্দ্র’। সকল চিন্তা, বুদ্ধি, জ্ঞান প্রযুক্তিকে সেদিকেই ধাবিত করতে হবে। এ এক অমোঘ শিক্ষার মুখোমুখি সভ্যতা। আর আমাদের সামনে আশু পথটা একটাই গ্রামীন শ্রমশক্তি ও তার জীবনকে কার্যকর, লক্ষ্যমুখী ও অর্থবহ পরিকল্পনার অধীন করতে হবে। আমাদের দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি এই আলোকেই বিন্যাস করতে হবে।

ড. সুশান্ত দাস: অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), শা বি প্র বি

পলিটব্যুরো সদস্য, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি।