সিলেট ৩১শে অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ই কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৮:১৫ অপরাহ্ণ, মে ২৮, ২০২০
বিভূতি ভূষণ সাহা রায়, কলকাতা (ভারত), ২৯ মে ২০২০ : ১৯১৬ সালে বিস্তর খোঁজাখুঁজির পর, অবশেষে বৃটিশ গোয়েন্দা-পুলিশ তার খোঁজ পেলো পেশোয়ারে। গ্রেপ্তার হবার সময় তিনি কলেরায় আক্রান্ত ছিলেন। অসুস্থ শয্যাশায়ীকে, সেই অবস্থায় স্ট্রেচারে করে নিয়ে আসা হলো কাশীর জেলখানায়। অভিযোগ বেআইনি অস্ত্র রাখা, বিপ্লবীদের আশ্রয় দেওয়া এবং রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে প্রতিদিনই তার উপরে অত্যাচার শুরু হলো – কথা বের করার জন্য। বিপ্লবীদের হদিস জানতে গালিগালাজ থেকে মারধোর, হেন কোনো অত্যাচার নেই যা করা হয় নি তার উপরে। কাশীর জেলে আসার পর থেকে অত্যাচারের মাত্রা আরও বেড়ে গেলো। ডেপুটি পুলিশ সুপারিটেন্ডেন্ট জিতেন ব্যানার্জী প্রতিদিন জেরার নামে শুরু করলো নানা ধরনের হুমকি, অপমান, গায়ে হাত তোলা। তিনি সব সহ্য করে যান দাঁতে দাঁত চেপে। নির্বিকারভাবে অস্বীকার করেন বিপ্লবীদের কথা – তাদের কাউকে চেনেন না তিনি, কারো সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই, তিনি একজন অসহায় বিধবা নারী। দুঁদে পুলিশ অফিসার জিতেন ব্যানার্জী বিশ্বাস করে না তার এইসব কথা। কারন, তার বিষয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য রয়েছে তার কাছে। সে কারণে অত্যাচারের মাত্রা প্রতিদিন বাড়তে থাকে। কিন্তু, আজ যে অত্যাচার তার উপরে করা হলো, সেটার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিলেন না তিনি। এরকম অত্যাচার হতে পারে, সেটা আসলেও স্বপ্নেও ভাবেননি তিনি। দুই জমাদারনি তাকে সেল থেকে বের করে এনে ভিন্ন সেলে নিয়ে আসার সময়ই, তিনি জানতেন অত্যাচার করা হবে তার উপরে – যেটা তার জন্য নিয়মিত ঘটনা। নির্জন সেলে এনে দুই জমাদারনি তাকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিলো। একজন চেপে বসলো তার বুকের উপরে। অন্যজন তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকা নিচের অংশ থেকে শাড়ি তুলে আনলো কোমরের কাছে। তারপর যৌনাঙ্গের মধ্যে পুরে দিলো এক গাদা লঙ্কার গুড়ো। গোপন অঙ্গের ভিতরে লঙ্কার গুঁড়ো পড়তেই অসহ্য যন্ত্রণায় চিৎকার করে ওঠেন তিনি। অসহ্য ব্যথায় অপার্থিব শক্তিতে ক্রমাগত লাথি মারতে থাকলেন তিনি দুই জমাদারনিকে। তার সঙ্গে ধস্তাধস্তাতিতে না পেরে দুজনে তাকে নিয়ে এলো অফিস ঘরে, যেখানে জিতেন ব্যানার্জী অপেক্ষা করছিল।
“কি জানো বলো”, হাতের মধ্যে শক্ত রুলটাকে ঘোরাতে ঘোরাতে জিতেন ব্যানার্জী বললো।
“বলবো না কিছু”, তার দু’চোখ দিয়ে আগুন বের হচ্ছে।
“আরো কঠোর শাস্তি দেবো”, ইশারায় দুই জমাদারনিকে দেখায় জিতেন ব্যানার্জী।
“যতো খুশি দিন, আমি কিছুই বলবো না।”
“কিছু বলতে হবে না। অমরেন্দ্র চ্যাটার্জী কোথায় আছে সেটা বললেই হবে শুধু।”
“বলবো না।”
“শাস্তি পাবে কিন্তু। কেমন শাস্তি নিশ্চয়ই বুঝেছো এতক্ষণে”, ঠোঁট বাঁকা করে সশব্দে হাসে জিতেন ব্যানার্জী।
“যা খুশি করতে পারেন। আমি কিছুই বলবো না”, কঠোর শোনায় তার কণ্ঠ। এই কণ্ঠ শুনেই জিতেন ব্যানার্জী বুঝে যায়, এই অতি সাধারণ সাধারণ চেহারার বাঙালি বিধবা নারীটি, সাধারণ কেউ না। একে ভাঙতে অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হবে তাকে। পুরনো আমলের কাশীর জেলে, মাটির নীচে একটা ঘর আছে, যার একটাই দরজা, আলো, বাতাস প্রবেশ করার জন্য কোনো জানালা সেখানে নেই। সেখানে তাকে পাঠানোর নির্দেশ দেয় জিতেন ব্যানার্জী। সেই অন্ধকার ঘরে প্রতিদিন আধা ঘণ্টা করে রাখা হবে তাকে, যেখানে দশ মিনিট কাউকে রাখলেই সে ভয়ে আধমরা হয়ে যায়। প্রথম দিনের আধা ঘণ্টা পরে দরজা খুলে দেখা গেলো অর্ধমৃত অবস্থায় পড়ে আছেন তিনি। তারপরেও মুখ খুলবেন না। দ্বিতীয় দিনেও একই দশা। তৃতীয় দিনে আধাঘণ্টার বদলে, বাড়িয়ে পঁয়তাল্লিশ মিনিট করা হলো শাস্তির মেয়াদ। তার স্নায়ুকে একেবারে ভেঙে দেবার চূড়ান্ত প্রচেষ্টা। কবরের মতো হিম অন্ধকার আন্ডারগ্রাউন্ড সেলে একাকী তিনি পড়ে রইলেন পঁয়তাল্লিশ মিনিট। দরজা খুলে দেখা গেলো অজ্ঞান পড়ে আছেন তিনি। জ্ঞান হবার পরেও সেই একই কথা, কিছুই বলবেন না তিনি। কাশীর পুলিশ হাল ছেড়ে দিলো। এরকম ইস্পাত কঠিন একজন নারীর মুখ থেকে কথা বের করার আর কোনো উপায় তাদের জানা নেই। তাকে নিয়ে আসা হলো কোলকাতার আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে…
বছর ত্রিশের এই ইস্পাত কঠিন নারীর নাম ননীবালা দেবী, জন্ম ১৮৮৮ সালে, হাওড়া জেলার বালিতে। পিতার নাম সূর্যকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় ও মাতার নাম গিরিবালা দেবী। মাত্র এগারো বছর বয়সে বিয়ে হয় তার, চলে যান শ্বশুরবাড়িতে। বিয়ের পাঁচ বছরের মাথায় ১৯০৪ সালে স্বামী মারা গেলেন, বয়স তখন মাত্র ষোল। সেকালের হিন্দু বিধবাদের জীবন ছিল বিষন্নতায় মোড়া, সংসারের এক কোনায় জীবস্মৃতের মতো বাঁচাই ছিল তাদের ভবিতব্য। কিন্তু আর পাঁচটা হিন্দু বিধবার মতো বাকি জীবনটা পুজোআচ্চা উপবাসে কাটিয়ে দেবার পাত্রী ছিলেন না তিনি। সামান্য লেখাপড়াও জানতেন, জীবস্মৃতের বাইরেও যে জীবন আছে, সেটা জানতেন। ফলে ঠাঁই হলো না শ্বশুরবাড়িতে, বাপেরবাড়ি ফিরে আসেন তিনি। সেসময় ভারতের স্বাধীনতার জন্য যুবক-বৃদ্ধ সকলেই প্রাণ দিতে প্রস্তুত। যে যেভাবে পারছে সাহায্য করছে বিপ্লবীদের। দেশের ডাকে শহীদ হয়েছেন কিশোর ক্ষুদিরাম। ননীবালা দেবীও স্বাধীনতার যুদ্ধে যোগ দিতে প্রস্তুত হলেন। বাপেরবাড়িতে ভাইপো অমরেন্দ্র চ্যাটার্জি ছিলেন নামকরা বিপ্লবী, চরমপন্থী যুগান্তর পার্টির নেতা, যিনি তাকে বিপ্লবের মন্ত্রে দীক্ষা দিলেন। শুরু হল ননীবালার জীবনের এক নতুন অধ্যায়। কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি হয়ে উঠলেন বিপ্লবী গুপ্ত সমিতির একজন নির্ভরযোগ্য সক্রিয় সহযোগী। দেশকে ভালোবেসে বিপ্লবীদের হয়ে তিনি নানা ঝুঁকিপূর্ণ কাজের দায়িত্ব নিতেন ও নিপুণ দক্ষতায় সে কাজ সম্পন্ন করতেন। অনেক কাছের মানুষও টের পেত না যে তিনি বিপ্লবী দলের সক্রিয় সদস্য। বিপ্লবীদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করতেন – এক জায়গার নেতাদের নির্দেশ ও নানা দরকারী খবর অন্য জায়গায় বিপ্লবীদের কাছে পৌঁছে দিয়ে। এমনকি সংগৃহীত অস্ত্রশস্ত্র ও গোপনে বিপ্লবীদের কাছে পৌঁছে দিতেন। সেসময় থাকতেন রিষড়ায় এক ভাড়াবাড়িতে, যেখানে অনেকদিন লুকিয়ে রেখেছিলেন ভাইপো অমরেন্দ্র চ্যাটার্জিকে। ফেরারী অন্য বিপ্লবীদেরও আশ্রয় দিতেন সে বাড়িতে। সারাদিন চরকায় সুতো কেটে, পৌঁছে দিতেন যারা পৈতে বানাতো তাদের কাছে। বাল্যবিধবাদের সেটাই ছিল তখন একমাত্র জীবিকা। দেখেশুনে ঘুণাক্ষরেও কেউ তাকে সন্দেহ করেনি, বিপ্লবী বলে।
১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে, ‘যুগান্তর পার্টি’র পক্ষে থেকে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় – জার্মানি থেকে অস্ত্র এনে ভারতব্যাপী অভ্যুত্থান ঘটিয়ে বিপ্লবের পথ প্রশস্ত করে ভারতের স্বাধীনতা অর্জন। জাহাজে করে বার্মা সীমান্তে অস্ত্র আনা হবে। সেখানে বিপ্লবীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে কোলকাতা দখল করা হবে, এরকম পরিকল্পনা নিয়েই বিপ্লবীরা এগোচ্ছিলেন, যার নেতৃত্বে ছিলেন যতীন্দ্রনাথ মুখার্জী (বাঘাযতীন)। কিন্তু বৃটিশ সরকার গুপ্তচর মারফত এই পরিকল্পনার কথা জেনে যাওয়ায়, যে জাহাজে করে অস্ত্র আনার কথা ছিলো, সেটাকে আটক করে। তারপর বৃটিশ সরকার সর্বাত্মক আক্রমণ চালায় বিপ্লবীদের ঘাটিগুলোতে। ১৯১৫ সালের ১০ই সেপ্টেম্বর, বালেশ্বরের যুদ্ধে বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ মুখার্জী নিহত হন। বিপ্লবীদের তখন ছিন্ন ভিন্ন অবস্থা। কাউকে ধরে ফাঁসি দেওয়া হচ্ছে, কাউকেবা দ্বীপান্তর। এর মধ্যেই বৃটিশদের রক্তচক্ষু অগ্রাহ্য করে পূর্ব ভারতের পথ ধরে অস্ত্র আনিয়ে, বিপ্লবীরা আবার চেষ্টা করছিলেন যাদুধন মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে। শুরু হলো চার্লস টেগার্টের নেতৃত্বে বৃটিশ পুলিশের নির্মম ও বর্বর অত্যাচার। সেই সময় গোয়েন্দাদের কাছ থেকে খবর পেয়ে, কোলকাতার ‘শ্রমজীবী সমবায়’ সংস্থায় তল্লাশি চালায় পুলিশ। তল্লাশির সময় অমরেন্দ্র চ্যাটার্জি পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও, রামচন্দ্র মজুমদার গ্রেপ্তার হয়ে তিন নম্বর রেগুলেশনে রাজবন্দি হন। রামচন্দ্র’র কাছে একটি মাউজার পিস্তল ছিল, কিন্তু তিনি সেটি কোথায় লুকিয়ে ছিলেন কেউ তা জানতো না। অথচ বিপ্লবীদের সেটির দরকার ছিল, কিন্তু কিভাবে তার সন্ধান জানা যাবে? এই তথ্য জানার জন্য ননীবালা দেবী অভিনব এক উপায় বের করলেন। রামচন্দ্রের স্ত্রী-রূপে জেলে ঢুকে রামচন্দ্রের সঙ্গে দেখা করে পিস্তলের খোঁজ আনতে চললেন দুঃসাহসী ননীবালা দেবী। বিধবা ননীবালা, একগলা ঘোমটা দিয়ে রামচন্দ্রের স্ত্রী সেজে স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে গেলেন জেলে, সেদিনকার সমাজে যা কেউ কল্পনাও করতে পারতো না। পুলিশের চোখে ধূলো দিয়ে, পিস্তলের সন্ধান জেনে বেরিয়ে এলেন প্রেসিডেন্সি জেল থেকে। কিন্তু পুলিশ প্রথমে তাকে রামচন্দ্রের স্ত্রী হিসেবে মনে করলেও, পরবর্তীকালে বুঝতে পেরেছিল নিজেদের নির্বুদ্ধিতা। এরপরেই পুলিশের গোয়েন্দা লাগলো তার পিছনে, কিন্তু তারা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারে নি, ননীবালা দেবীই বিপ্লবীদের আশ্রয়দাত্রি।
বৃটিশ পুলিশের চর, তার অনুসন্ধান শুরু করার ফলে, বাসা বদল করতে হলো তাকে। রিষড়া থেকে তিনি চলে এলেন চন্দননগরে। বিপ্লবী ভোলানাথ চ্যাটার্জী সেখানে বেনামে বাড়ি ভাড়া করে রাখলেন ননীবালাকে আর নিজের পিসীমাকে। এই বাড়িগুলোতে অনেক দিন নিরাপদে থেকেছেন বিপ্লবী ভোলানাথ চ্যাটার্জী, যাদুগোপাল মুখোপাধ্যায়, বিনয় ভূষণ দত্ত, নলিনীকান্ত কর, অতুল ঘোষের মতো বিপ্লবীরা। যাদের নামে অনেক টাকার হুলিয়া জারি করেছিল পুলিশ। এদের কাছ থেকে খবর বা অস্ত্র সংগ্রহ করে বাইরের বিপ্লবীদের কাছে পৌঁছে দিতেন বিপ্লবী ননীবালা, আর বাইরে থেকে কিছু জোগাড় করতে হলে সেগুলি এনে এঁদেরকে পৌঁছে দিতেন। বিপ্লবীরা রাতের অন্ধকারে নিশাচরের মতো হাজির হতেন এবং পুলিশের গন্ধ পেলেই অদৃশ্য হয়ে যেতেন। এমন সময় ১৯১৬ সালে পুলিশের নজর পড়লো বাড়ির কর্ত্রী, বিশেষতঃ ননীবালার ওপর। নানা জায়গায় খানা তল্লাশি করা শুরু করলো পুলিশ। ননীবালার বাবা সূর্যকান্ত ব্যানার্জীকে পুলিশ থানায় ডেকে নিয়ে, সারাদিন বসিয়ে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করতো। জানতে চাওয়া হতো তার মেয়ের সন্ধান। এ’রকম পরিস্থিতিতে বাংলায় থাকার জন্য আর ভরসা পেলেন না তিনি। তার এক বাল্যকালের বান্ধবীর বড় ভাই পেশোয়ার যাচ্ছিলেন কোনো এক কাজে। অনেক অনুনয় বিনয় করে তিনি, তার সঙ্গ নিলেন। পেশোয়ারে পলাতক হয়ে খুব একটা লাভ হলো না তার অবশ্য। পনেরো ষোলো দিনের মধ্যেই পুলিশ তার সন্ধান পেয়ে গেলো। পুলিশ যখন তাকে গ্রেফতার করতে এলো, কিন্তু তখন তার নড়ার অবস্থাও নেই…
পেশোয়ার থেকে অসুস্থ ননীবালা দেবীকে গ্রেপ্তার করে, বীরপুঙ্গব বৃটিশ পুলিশ কাশীর জেলে নিয়ে গেলো তাকে। সেখানে অকথ্য অত্যাচার ও নির্যাতনে অসুস্থ হয়ে পড়লে, আবার তাকে পাঠানো হলো কোলকাতার আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে। সেখানে বিপ্লবীদের খবরের জন্য, আবার শুরু হলো বৃটিশ পুলিশের নির্যাতন। অতঃপর অনশন ধর্মঘট শুরু করলেন তিনি। তাকে জেল থেকে মুক্ত করে না দেওয়া পর্যন্ত তিনি খাবেন না, এই ঘোষণা করলেন তিনি। জেল কর্তৃপক্ষ, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কারো অনুরোধেই তিনি অনশন ভাঙতে রাজি হলেন না। তাকে, আইবি পুলিশের স্পেশাল সুপারিন্টেনডেন্ট গোল্ডি সাহেবের কাছে নিয়ে যাওয়ার পরে, গোল্ডি বললো, “যতোই অনশন করুন না কেনো, জেল থেকে আপনি মুক্তি পাবেন না। অন্য কী করলে আপনি খাবেন?”
প্রত্যুত্তরে ননীবালা বললেন, “যা চাইবো তাই করবেন?”
“হ্যাঁ, করবো।”
“আমাকে বাগবাজারে রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের স্ত্রীর কাছে রেখে দিন, তাহলে অনশন ভাঙবো।”
“আপনি দরখাস্ত লিখে দিন, দেখছি।”
ননীবালা দেবী সাথে সাথেই দরখাস্ত লিখে দিলে, তাকে বিস্মিত করে গোল্ডি সেই দরখাস্তকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে দি্লো ওয়েস্টপেপার বাস্কেটে। বারুদে যেন আগুনের ফুলকি পড়লো। ক্ষিপ্ত ননীবালা আহত বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়লেন গোল্ডি সাহেবের উপর। সজোরে চড় বসালেন গোল্ডির গালে। দ্বিতীয় চড় মারার আগেই পুলিশের অন্যান্য কর্মচারীরা সরিয়ে নিলো ননীবালাকে। তিনি তখনও ফুঁসছেন – “ছিঁড়ে ফেলবেতো আমায় দিয়ে দরখাস্ত লেখালো কেনো? আমাদের দেশের মানুষের কোনো মান-সম্মান থাকতে নেই?”
জেলে ফেরত এনে, স্টেট প্রিজনার হিসাবে রাখা হলো ননীবালা দেবীকে। নারীদের মধ্যে তিনিই প্রথম স্টেট প্রিজনার, যার অনশন তখনও চলছে। এর মধ্যেই তার কানে এলো জেলে আরেক নারী কয়েদী এসেছেন – যার নাম দুকড়িবালা, যিনি তার মতোই বিপ্লবী দলের সদস্যা। তার বাড়িতে সাতটা মসার পিস্তল পাওয়ার অপরাধে তাকে দুই বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। কিন্তু রাজবন্দীর মর্যাদা দুকড়িবালা পাননি, জেলে তাকে রাখা হয়েছে তৃতীয় শ্রেণির কয়েদী হিসাবে। সাধারণ কয়েদিদের মতো, দুকড়িবালাকে প্রতিদিন আধমণ ডাল ভাঙতে হতো সশ্রম কারাদণ্ডের শর্ত হিসাবে। সেখান থেকে তাকে উদ্ধারের পরিকল্পনা করেন ননীবালা দেবী। অনশনের উনিশ-বিশ দিন চলছে তখন, ম্যাজিস্ট্রেট আবার এসেছে অনশন ভাঙার অনুরোধ নিয়ে – “জেল থেকে তো আপনি মুক্তি পাবেন না। খামোখাই কষ্ট করছেন আপনি। কি করলে খাবেন বলুন?”
“আমার ইচ্ছামতো হবে?”, তিনি জিজ্ঞেস করলেন।
“হ্যাঁ, হবে।”
“তাহলে আমার রান্না করবার জন্য একজন ব্রাহ্মণ-কন্যা চাই।”
“ব্রাহ্মণ কন্যা কি কেউ আছেন এখানে?”, ভ্রু কুঁচকে ম্যাজিস্ট্রেট বলেন।
“হ্যাঁ, আছেন, দুকড়িবালা দেবী।”
“আচ্ছা, তাই হবে।”, অনশন ভাঙছেন ননীবালা দেবী, এই স্বস্তিতে সহজেই অনুমতি প্রদান করেন ম্যাজিস্ট্রেট। এরপরে এলো সমস্ত নতুন বাসন-কোসন, হাঁড়িকুড়ি। ২১ দিনের পরে ভাত খেলেন সেই অসামান্য দৃঢ়চেতা বন্দিনী। সেইসাথে দুকড়িবালা দেবী’কেও বাঁচালেন পরিশ্রম থেকে…
চার বছর বন্দিজীবন কাটানোর পরে ১৯১৯ সালে মুক্তি পান ননীবালা দেবী। বাইরে এসে আরো কঠিন বিপদের মধ্যে পড়লেন তিনি। পুলিশের ভয়ে কেউ তাকে আশ্রয় দিতে চায় না। এছাড়া বিধবা হয়েও পরস্ত্রী সাজা, পরপুরুষের সাথে একঘরে থাকা বা পেশোয়ার যাওয়া – এইসব কারনে, তখনকার হিন্দু সমাজের এক পক্ষ তাকে মেনে নেয়নি। অন্যদিকে তার নিজস্ব বিপ্লবী সংগঠন বা চেনাশোনা সবটাই ব্রিটিশ পুলিশের অত্যাচারে শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু জীবনের মায়া যিনি করেন না, দেশ যার কাছে সবার উপরে, এই সামান্য সমস্যায় কাতর হওয়া তারতো সাজে না! সাজেও নি। একটা আধাঘুপচি ঘর ভাড়া নিয়ে জীবন সংগ্রাম শুরু করেন তিনি। সুতো কেটে, রান্নার কাজ করে, কোনমতে আধপেটা খেয়ে তার দিন কাটতে থাকে। সে সময় কেউ তার খবর নেয়ার প্রয়োজনটুকুও মনে করেনি। আত্মীয়স্বজনের অনাদর আর অবহেলা, কঠোর দারিদ্র, সবকিছুকে এক পাশে ফেলে রেখে মেরুদণ্ড সোজা করে মাথা উঁচু করে চলেছেন তিনি বাকিটা জীবন। পরাধীন এই দেশ একদিন স্বাধীন হবে, মানুষের মুক্তি আসবে – এই স্বপ্নের বাইরে আর কোনো নিজস্ব স্বপ্ন ছিলো না তার জীবনে। দেশ স্বাধীন হওয়ার প্রায় কুড়ি বছর পরে ১৯৬৭ সালের মে মাসে, তিনি মারা যান। ইতিহাস তার জন্মদিন বা মৃত্যুদিনের তারিখ মনে রাখার প্রয়োজনবোধ করেনি। কথিত আছে যে, জেল থেকে বেড়িয়ে বেঁচে থাকা অবস্থায় পঞ্চাশের দশকে ৫০ টাকা পেনশন পেয়েছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে (যদিও তার কোনো নির্দিষ্ট প্রমাণ নেই)। কেউ মনে রাখেনি বাংলার প্রথম মহিলা রাজবন্দী ননীবালা দেবীকে…
তথ্যসুত্র:
(১) স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলার নারী: কমলা দাশগুপ্ত
(২) বাংলার প্রথম মহিলা রাজবন্দী: উমা ভট্টাচার্য
(৩) সংসদ বাঙালি চরিত্রাভিধান; কোলকাতা সাহিত্য সংসদ
সম্পাদক : সৈয়দ আমিরুজ্জামান
ইমেইল : rpnewsbd@gmail.com
মোবাইল +8801716599589
৩১/এফ, তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০।
© RP News 24.com 2013-2020
Design and developed by M-W-D