করোনাকালে সংবিধানের পুনঃপাঠ

প্রকাশিত: ২:০০ অপরাহ্ণ, জুন ২২, ২০২০

করোনাকালে সংবিধানের পুনঃপাঠ

Manual6 Ad Code

ফজলে হোসেন বাদশা, ২২ জুন ২০২০ : সংবিধান একটি রাষ্ট্রের নিয়ামক আইনি দলিল। এটি সংসদ কর্তৃক প্রণীত কোনো সাধারণ আইন নয়, বরং সংসদের সব আইন সংবিধানের আলোকে প্রণীত হয়। সংবিধানের সঙ্গে জনগণের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। মূলত সংবিধানের আলোকেই রাষ্ট্র তার কার্যক্রম ও জনগণের সঙ্গে আন্তসম্পর্ক সৃষ্টি করে।

এ কথা নিশ্চিত যে, রাষ্ট্রে রাজনৈতিক প্রতিজ্ঞা ও বিশ্বাসবোধ যত দৃঢ় হবে, সংবিধান ততই কার্যকর বৈশিষ্ট্য অর্জন করবে।
পৃথিবীর বহু রাষ্ট্রে সংবিধান অবশ্যপাঠ্য হিসেবে বিবেচিত। রাষ্ট্রীয় কাজের সঙ্গে সম্পর্কিত হতে কর্তৃপক্ষের কাছে নিজ রাষ্ট্রের সংবিধান জ্ঞান আছে কিনা তা নিশ্চিত করতে হয়। কিন্তু অতীব দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, আমাদের দেশে সেই নজির বিরল। আমাদের শিক্ষিত সমাজেও সংবিধানচর্চা খুব বেশি একটা দৃষ্টিতে আসে না।
অথচ বাংলাদেশ নামক এ রাষ্ট্রটির অনন্য অভ্যুদয়ের সঙ্গে এ সংবিধান অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়লাভের পর ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে আমাদের এ সংবিধান কার্যকর হয়।
যে চেতনা নিয়ে এ রাষ্ট্রের জন্ম, তার পথচলাকে কল্যাণমুখী করে তোলার ক্ষেত্রে এ সংবিধান পাঠ ও পরিচর্যার কোনো বিকল্প নেই। লক্ষণীয় যে, বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নে সময় লেগেছিল নয় মাস। ২১টি অধিবেশনে এটি আলোচিত ও গৃহীত হয়। সংবিধান বিষয়ে সাধারণ আলোচনায় সে সময় বিভিন্ন বিষয়ে সবিস্তার কথা বলেন খোদ বঙ্গবন্ধু। তাঁর এ গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য শেষ হয় একটি অতি তাৎপর্যপূর্ণ ইঙ্গিতের মধ্য দিয়ে। তা ছিল, ‘(আমাদের) ভবিষ্যৎ বংশধররা, যদি সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পারেন, তাহলে আমার জীবন সার্থক হবে, শহীদের রক্তদান সার্থক হবে। ’ সংবিধানের বিলের ওপর সাধারণ আলোচনার সময় সংবিধান প্রসঙ্গের ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, ‘আমাদের মূলনীতি, মৌলিক অধিকার এবং রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি- এভাবে (তিনটি অংশে বিন্যস্ত করে) সংবিধান (প্রণয়ন) করতে হয়েছে। ’দেশের জনগণের মৌলিক অধিকার আইনের দ্বারা সংরক্ষিত বলে তিনি উল্লেখ করেন। কাজেই এ রাষ্ট্রের যে কোনো সংকটকালে সংবিধানের পুনঃপাঠ ও সে আলোকে পুনর্যাত্রার পথ তৈরি করার কোনো বিকল্প নেই।
বাংলাদেশ এখন একটি মহামারীর গভীর সংকটে নিমজ্জিত
আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে, স্বাস্থ্য ও অর্থনীতি দুটোই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হতে পারে। সংক্রমণ বাড়তে থাকলে পরিণতি সেদিকে যাবে। লকডাউন ও কঠোরভাবে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের দোদুল্যমানতা কাজ করছে। পাশাপাশি কাজ করেছে দীর্ঘদিন ধরে স্বাস্থ্য খাতে চরম অবহেলা। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর মস্তিষ্কপ্রসূত একটি অসাধারণ উদ্যোগ কমিউনিটি ক্লিনিক সম্ভাবনার জন্ম দিলেও ভ্রূণেই থেকে গেছে। বিকশিত আর হতে পারেনি। সেটা হলেও হয়তো তৃণমূলে আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থার একটা ভিত্তি গড়ে উঠত। অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে হতাশার চিত্র আরও স্পষ্ট হয়। যেমন শ্রীলঙ্কায় স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ জিডিপির ২ দশমিক ৫ শতাংশ, ভিয়েতনামে ২ দশমিক ৫৫, থাইল্যান্ডে প্রায় ২ দশমিক ৫ শতাংশ। অথচ আমাদের স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বরাদ্দ শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ, যা ভারতের (০.৮%) চেয়ে কম, এমনকি পাকিস্তানকেও (০.৭%) অতিক্রম করতে পারেনি। এটা কি ন্যায্যতা?
আমি এখানে দুটি কারণে শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, নিউজিল্যান্ড, কিউবা ও ভারতের একটি রাজ্য কেরালার দিকে গভীর মনোযোগের দাবি করব। কারণ দুটির মধ্যে একটি হলো, জনস্বাস্থ্য রক্ষার ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গি এবং দ্বিতীয়টি, আর্থিক বরাদ্দ ও সম্পদের যথাযথ ব্যবহার। আমাদের দেশের সাধারণ প্রচলন হচ্ছে, যাদের চিকিৎসা নেওয়ার সক্ষমতা নেই তারা সরকারি হাসপাতালে যান। যার কিছু সক্ষমতা আছে এবং মধ্যবিত্ত, তারা মূলত ভারতের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা-বাণিজ্যের খোরাক। আর যারা বিত্তবান তাদের জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্স আছে। সিঙ্গাপুর-থাইল্যান্ডসহ পৃথিবীর যে কোনো স্থানেই তারা চিকিৎসা গ্রহণ করতে পারেন। এখন এই যে জনস্বাস্থ্য নিয়ে রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি, তার নাগরিকদের যে অপ্রাপ্তি, তা দূর করতে হলে এ করোনাকালেই আমাদের সংবিধানটির পুনঃপাঠ জরুরি।
আমাদের সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ দুটি অংশের একটি হলো রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি আর অন্যটি হলো মৌলিক অধিকার। সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে রয়েছে মূলনীতি আর তৃতীয় ভাগে মৌলিক অধিকার। আমাদের আলোচ্য পুনঃপাঠে এ দুটি অংশকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা জরুরি। মৌলিক অধিকারে ভুক্ত বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে সংবিধানের ২৬ (২) ধারায় স্পষ্ট করা হয়েছে, এ বিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন কোনো আইন রাষ্ট্র প্রণয়ন করতে পারবে না এবং করলে তা বাতিল হবে।
আমাদের দেশের সংবিধানে স্বাস্থ্য ও শিক্ষাকে মৌলিক অধিকারে যুক্ত না করলেও রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে দুটিই অন্তর্ভুক্ত। সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগ, যেখানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিগুলো উল্লেখ আছে, তার ১৮ (১) অনুচ্ছেদে স্পষ্ট বলা হয়েছে, ‘জনগণের পুষ্টির স্তর-উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতিসাধনকে রাষ্ট্র অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য বলিয়া গণ্য করিবেন। ’ আবার ‘চিকিৎসা’ শব্দটিকে সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগেই রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির ১৫ (ক) অনুচ্ছেদে খাদ্য, পোশাক, আশ্রয় ও শিক্ষার সঙ্গে ‘জীবনধারণের মৌলিক উপকরণ’ হিসেবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। করোনাকালের এ সংকট এবং ভবিষ্যতে এমন অনাগত আরও সংকট মোকাবিলার প্রশ্নে আমাদের রাষ্ট্রটিকে যথাযথভাবে প্রস্তুত করতে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতকে সংবিধানের তৃতীয় ভাগে মৌলিক অধিকারে অন্তর্ভুক্ত করা একটি প্রাসঙ্গিক ও জরুরি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমি বহু ডিগ্রিধারীকেও দেখেছি আমাদের রাষ্ট্রের চার মূলনীতি সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকেই শুধু বলতে শুনেছি, এমনকি সংসদেও তিনি বলেছেন, ‘আমাদের দেশটি হবে জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র। ’ যার ব্যাখ্যাও সংবিধানে আছে। সব নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করার কথা এ সংবিধানেই উল্লেখ আছে। এবং সংবিধানই জনগণের মৌলিক ও নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করবে। শুধু পরিস্থিতির সঙ্গে সংগতি রেখে আমাদের কল্যাণমুখী দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলে তার আলোকে সংবিধানের পুনঃপাঠ ও পুনর্মূল্যায়নকে গুরুত্ব দিতে হবে।

Manual2 Ad Code

#
ফজলে হোসেন বাদশা এমপি
সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি।

Manual6 Ad Code

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

 


Follow for More!

Manual1 Ad Code
Manual7 Ad Code