আমরা কোন পথে হাঁটব?

প্রকাশিত: ২:২৫ পূর্বাহ্ণ, জুলাই ১৪, ২০২০

আমরা কোন পথে হাঁটব?

Manual4 Ad Code

|| আহমেদ বোরহান || ১৪ জুলাই ২০২০ : করোনাভাইরাস (COVID 19) গত বছরের শেষ দিকে চীনের উহান থেকে উৎপত্তি হয়ে খুব কম সময়ের মধ্যে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে এবং Worldometer এর তথ্যানুসারে এই ভাইরাস মাত্র সাত মাসের মধ্যে এক কোটির বেশী মানুষকে আক্রান্ত করেছে এবং ইতোমধ্যে ৫ লাখের বেশী আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু হয়েছে যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দশ কোটির বেশী হতে পারে। করোনা অতিমারী একদিকে যেমন বিশ্বব্যাপী জনস্বাস্থ্যের বেহাল দশাকে আমাদের সামনে স্পষ্ট করে তুলেছে তেমনি অন্যদিকে দীর্ঘ সময় ধরে বিরাজমান তথাকথিত নব্য-উদারনীতি দ্বারা সমর্থিত প্রবৃদ্ধি নির্ভর পুঁজিবাদী মডেলের কাঠামোগত অসমতা ও অমানবিকতাকে আরও প্রকট করেছে। ধনী ও দরিদ্র রাষ্ট্র নির্বিশেষে প্রান্তিক, দরিদ্র, অভিবাসী শ্রমিক, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে যুক্ত শ্রমিকদের অনিশ্চয়তা ও ক্ষতগুলিকে এই অতিমারী আরও গভীর ও জটিল করে তুলেছে। করোনার কারণে স্বাস্থ্যব্যবস্থা সহ অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকারহীনতা ও অসমতার যে চিত্র আজ সমগ্র বিশ্ব দেখছে অথবা এর শিকার হচ্ছে তা প্রকৃতপক্ষে দীর্ঘদিনের পুঁজিবাদী নীতি কাঠামো ও ব্যবস্থার পুঞ্জীভূত ফলাফল।

এই বিবেচনায় আয় এবং সম্পদের বৈষম্য ও মৌলিক অধিকারসমূহ বিশেষকরে স্বাস্থ্য সেবার বাণিজ্যিকীকরণ ও বেসরকারিকরণের প্রভাব ও ফলাফল বিপুল জনগোষ্ঠীর উপর কিভাবে পড়ছে তা নিয়ে একটি সংক্ষিপ্ত তাত্ত্বিক এবং তথ্য ভিত্তিক আলোচনা এখানে তুলে ধরা হল। এছাড়াও উদাহরণ হিসাবে এখানে প্রভাবশালী পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিপরীতে ছোট দ্বীপরাষ্ট্র কিউবা এর জনগণের স্বাস্থ্য সেবার অধিকারকে প্রতিষ্ঠা করেছে তা বিবৃত করা হল। প্রায় একই ধরনের আর্থ সামাজিক বাস্তবতার দুই দেশ বাংলাদেশের ও কিউবার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও স্বাস্থ্য সেবার কিছু তুলনামূলক আলোচনা পাঠকের বিবেচনার জন্য পেশ করা হল। এর পাশাপাশি করোনা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে এই দুটি দেশের অভিজ্ঞতা ও কৌশলের তুলনামূলক চিত্রও তুলে ধরা হল।

বর্তমান পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক মডেলের প্রধান চালিকা শক্তি হচ্ছে প্রবৃদ্ধি এবং মনে করা হয় যে এটি জনগণের কর্মসংস্থান এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের বিপুল সম্ভাবনা তৈরি করে। তবে এই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সাথে বৈষম্যেরও একটা গভীর সম্পর্ক রয়েছে। খ্যাতিমান ফরাসী অর্থনীতিবিদ থমাস পিকেটি তাঁর ২০১৩ সালে প্রকাশিত Capital in the Twenty-First century বইয়ে দেখিয়েছেন কিভাবে স্বল্প অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও আয় এবং সম্পদের বিশাল বৈষম্য তৈরি করতে পারে। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী পুঁজিবাদী রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ বৈষম্য পরিস্থিতি তুলে ধরতে গিয়ে তিনি দেখিয়েছেন নীচের দিকে অবস্থানকারী ৫০ শতাংশ জনগণ মোট সম্পদের মাত্র ২% এর মালিক এবং ১৯৮০ সাল থেকে ২০১২ পর্যন্ত এ অংশের আয় বেড়েছে মাত্র ০.৫%। পরবর্তী ধাপে অবস্থানকারী ৪০ শতাংশ জনগণ মোট সম্পদের ২০-২৫% এর মালিক। শীর্ষে অবস্থানকারী ১০ শতাংশ মোট সম্পদের ৭৫-৭৮% এর মালিক । এক প্রতিবেদনে দেখা যায় জনসংখ্যার সবচেয়ে ধনী ১ শতাংশের সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৪০ শতাংশ (Federal reserve, 2017)। করোনার এই অতিমারীতেও শীর্ষে অবস্থানকারী ২৫ জন ধনীর আয় ও সম্পদ দুইই বেড়েছে অথচ কোটি কোটি মানুষ কর্মহীন হয়ে কাজ ও খাদ্যের অভাবে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে। যে মাত্রায় আয় ও সম্পদ সমাজের একটা ক্ষুদ্র অংশের কাছে পুঞ্জীভূত হচ্ছে মানব সভ্যতা হয়ত খুব শীঘ্রই প্রথম ব্যক্তি trillion (ডলার) সম্পদের মালিকের দেখা পাবে।

Manual2 Ad Code

অর্থনীতিবিদ গাই স্ট্যান্ডিং এর ২০১১ সালে প্রকাশিত ‘The Precariat: The New Dangerous Class’ বইয়ে আয় এবং সম্পদের বৈষম্যের প্রকাশ ও প্রভাব হিসাবে নতুন একটি অনিশ্চিত শ্রেণীর সৃষ্টিকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁর মতে বাজার অর্থনীতি গত কয়েক দশক ধরে প্রভাব বিস্তার করছে এবং নব্য-উদারনীতি এই বৈশ্বিক বাজার অর্থনীতিকে ব্যবস্থা হিসাবে সমন্বিত ও সংহত করেছে যেখানে বাজারকে উন্মুক্ত করা হয়েছে এবং মেধাস্বত্ত অধিকারের কারণে একদিকে সমাজের অতি ক্ষুদ্র অংশের ক্রমাগত আয় বেড়েছে আর অন্যদিকে বিশ্ব শ্রমের বাজারে অন্তর্ভুক্ত ২০০ কোটি শ্রমশক্তি ক্রমবর্ধমান বৈষম্য এবং নিরাপত্তাহীনতার কারণে নতুন একটি অনিশ্চিত শ্রেণী রূপে (Precariat class) আবির্ভূত হয়েছে। অনিশ্চিত এবং বিপদজনক শ্রেণী যারা ক্রমবর্ধমান অস্থিতিশীলতা এবং আয়ের নিরাপত্তাহীনতার কারণে আর্থিক এবং মানসিক নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি নিয়ে টিকে থাকে। তাঁর বইয়ের কেন্দ্রীয় বিষয় হচ্ছে এই নতুন অনিশ্চিত এবং বিপদজনক শ্রেণীর উত্থান। লক্ষণীয় যে, লাখ লাখ মানুষ এই অনিশ্চিত শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত যারা তাদের প্রদত্ত শ্রমের পর্যাপ্ত পারিশ্রমিক এবং স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত। এই শ্রেণী শুধুমাত্র অর্থ মজুরির উপর নির্ভর করে এবং অন্যান্য অধিকার ও সুবিধা যেমন অবসর ভাতা, চিকিৎসা ভাতা থেকে শুধু বঞ্চিতই নয় বরং সব ধরনের ঝুঁকি বহন করে। বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদের আকাঙ্ক্ষার অংশ হিসাবে পরিকল্পিতভাবে তাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অধিকারগুলি কেড়ে নেয়া হয়েছে। মূলত এটি স্পষ্ট যে বিংশ শতাব্দীর সম্পদ ও আয় বিতরণ ব্যবস্থা ভেঙে যাওয়ার ফলশ্রুতিস্বরূপ এই অনিশ্চিত এবং বিপদজনক শ্রেণীর উদ্ভব হয়েছে।

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নির্ভর এই পুঁজিবাদী মডেলটি নব্য-উদারনীতির সাথে সংযোজিত হয়ে একদিকে যেমন আয় এবং সম্পদের বিশাল বৈষম্যকে তীব্র করেছে তেমনি শিক্ষা, খাদ্য ও স্বাস্থ্য খাতের মত মৌলিক অধিকারগুলিকে পণ্যে রূপান্তরিত করেছে এবং ফলস্বরূপ এই সমস্ত মৌলিক অধিকারগুলিতে জনগণের প্রবেশাধিকারে চরম বৈষম্য ও অসমতা তৈরি করেছে, বিশেষভাবে মৌলিক পরিষেবাগুলি অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল সমাজের প্রান্তিক অংশের নাগালের বাইরে চলে গেছে। জাতিসংঘ ১৯৪৮ সনের মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণায় শিক্ষা, খাদ্য ও স্বাস্থ্যকে অন্যতম অধিকার হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। তবে বর্তমান নব্য-উদারনৈতিক সময়ে মৌলিক পরিষেবাগুলিকে পণ্যে পরিণত করার মধ্য দিয়ে মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাসমূহকে বিশেষ ভাবে শিক্ষা, খাদ্য ও স্বাস্থ্য সেবা সংক্রান্ত অধিকারের ধারণাকে কাগুজে অধিকারে পরিণত করেছে।

বিশ্বের বেশিরভাগ দেশের মতো বাংলাদেশও কয়েক দশক ধরে পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক মডেলকে অনুসরণ করছে যদিও বাংলাদেশের সংবিধানে অন্যতম মৌলিক নীতি হিসাবে সমাজতন্ত্র এখনও লিপিবব্ধ আছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও আয় এবং সম্পদের বিশাল বৈষম্যের চিত্রটি প্রকট হয়ে ফুটে উঠেছে। এখানে সমাজের বৃহত্তর অংশকে বঞ্চিত করে একটি ছোট্ট অংশ দেশের বেশিরভাগ সম্পদ উপভোগ করে। শীর্ষে অবস্থানকারী ১০ শতাংশের আয়ের পরিমাণ ১৯৮৪ সালে যা ছিল ২১ শতাংশ ২০১০ সালে তা বেড়ে ২৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে, একই সময়ে সর্বনিম্নে অবস্থানকারী ১০ শতাংশের আয়ের পরিমাণ ৪.১৩ শতাংশ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ৩.৯৯ শতাংশে (The Financial Express October 19, 2019)।

Manual3 Ad Code

বর্তমানে প্রভাবশালী পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিপরীত ধারা অনুসরণ করে শিক্ষা, ও স্বাস্থ্য সেবার অধিকারকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে এমন অল্প কিছু রাষ্ট্রের মধ্যে দ্বীপরাষ্ট্র কিউবা অন্যতম। কিউবা, ১৯৫৯ সালে বিপ্লবের পরে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবাকে অবৈতনিক করে দেয় এবং শক্তিশালী পুঁজিবাদী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে দীর্ঘমেয়াদী (ছয় দশক) রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার শিকার হওয়ার পরেও জনগণের সর্বজনীন শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য কাজ করতে থাকে। চূড়ান্ত প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও একটি জাতি কীভাবে রাজনৈতিক আদর্শ ও ইচ্ছাশক্তির বলে তার জনগণের শিক্ষা, ও স্বাস্থ্য সেবার মতো মৌলিক অধিকারকে নিশ্চিত করতে পারে কিউবা তার অন্যতম সেরা উদাহরণ। নতুন গাড়ি বা বিলাসবহুল দালান হয়ত সেখানে বেশী নেই, তবে কিউবার জনগণের জন্য উন্নত চিকিৎসা পরিষেবা রয়েছে এবং জনগণের আয়ু এবং মাতৃমৃত্যুর হার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের সমান যদিও কিউবা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় স্বাস্থ্যখাতে অনেক কম ব্যয় করে (বিশ ভাগের এক ভাগ) এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে যেখানে আমেরিকা বিভিন্ন দেশ থেকে চিকিৎসক বা স্বাস্থ্য কর্মী আমদানি করে কিউবা সেখানে ডাক্তার বা স্বাস্থ্য কর্মী রপ্তানি করে।

কিউবার হাভানায় অবস্থিত ল্যাটিন আমেরিকান স্কুল অব মেডিসিন (LASM) এরকমই একটি আন্তর্জাতিক চিকিৎসক তৈরির মেডিকেল স্কুল যেটি কিউবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় প্রাক্তন নৌ একাডেমির হাভানা ক্যাম্পাসকে রূপান্তর করে প্রতিষ্ঠা করে। সম্ভবত বিশ্বের বৃহত্তম এই মেডিকেল স্কুলটি সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবাকে বিশ্বের দরিদ্রতম অংশে পৌঁছে দেয়া ও স্বাস্থ্যসেবার বৈষম্যকে দূর করার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এই স্কুল থেকে আমেরিকা (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ), আফ্রিকা, এশিয়া মহাদেশের ১২২টি দেশের ২৩,০০০ শিক্ষার্থী তাদের স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করে। ছয় বছর দীর্ঘ এই মেডিকেল কোর্সে অধিকাংশ শিক্ষার্থীকে বৃত্তি প্রধান করা হয়। শিক্ষার্থীদের নির্বাচন করা হয় বিশ্বের দরিদ্রতম অংশ থেকে যাদের একটা বড় অংশ বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা যেখানে চিকিৎসা পরিষেবা প্রায় অনুপস্থিত ও যারা কখনও চিকিৎসক দেখেন না। শিক্ষার্থীদের অর্ধেকেরও বেশি নারী শিক্ষার্থী। বিভিন্ন ধাপে ২০১৯ সাল পর্যন্ত একইভাবে ৮৩টি দেশ থেকে আসা ১০০০০ শিক্ষার্থী তাদের স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করে নিজেদের ও অন্যান্য বঞ্চিত সম্প্রদায়কে চিকিৎসা পরিষেবা দিচ্ছে (গেইল রিড ২০১৪ ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, কিউবা,২০১৯)।

কিউবার স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মৌলিক দিক হচ্ছে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা, একশ শতাংশকে অন্তর্ভুক্তকরন – কেউ বাদ পড়বেনা, নিরাময় ব্যবস্থাকে অগ্রাধিকার দেয়া-যা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার খরচকে অনেকাংশে কমিয়ে দেয়, পাড়া ভিত্তিক ক্লিনিক ক্লাসরুম, সম্প্রদায়ভিত্তিক স্বাস্থ্য শিক্ষা, চিকিৎসকের রোগীর বাড়ি পরিদর্শন, যা রোগীর জীবনযাপনের অবস্থা, মানসিক দিক, পরিবারের সদস্যদের সাথে তার সম্পর্ক, খাবার ও পানির মান সম্পর্কে চিকিৎসককে গভীর ধারণা দেয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে বিশ্বের বেশিরভাগ জায়গায় স্বাস্থ্য কর্মীদের সংকট রয়েছে; বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ৪০-৭০ লাখ স্বাস্থ্য কর্মশক্তির ঘাটতি রয়েছে। বাংলাদেশে এই সংকট আরও তীব্র এবং দক্ষিণ-এশিয়াতে আমাদের অবস্থান দ্বিতীয়-নিম্নতম। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী দেশে প্রতি ১০,০০০ জনের জন্য ৫.২৬ জন চিকিৎসক আর সেবিকা রয়েছে আরও কম প্রতি ১০,০০০ জনের জন্য ৩.০৬ জন। আর এটি পরিলক্ষিত হয় যে এই চিকিৎসক এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের বেশিরভাগই শহরে অবস্থান করে, তার অর্থ গ্রামে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর একটি বিশাল অংশ স্বাস্থ্য সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে । আর কিউবাতে প্রতি ১০,০০০ জনের জন্য ৭৫.৭ জন চিকিৎসক, যা আন্তর্জাতিক পরিসরে ও অন্যতম উল্লেখযোগ্য (স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, কিউবা)। আমরা মধ্যম আয়ের দেশ হতে যাচ্ছি অথচ আমদের মাথাপিছু মোট স্বাস্থ্য ব্যয় মাত্র ৮৮ মার্কিন ডলার আর সেখানে কিউবার মাথাপিছু মোট স্বাস্থ্য ব্যয় আমাদের চেয়ে অনেক গুন বেশী ২৪৭৫ মার্কিন ডলার; বাংলাদেশ ও কিউবার স্বাস্থ্য খাতে মোট ব্যয় জিডিপির হিসাবে যথাক্রমে ২.৮%, ও ১১.১% (Global Health Observatory, WHO 2020)। হাসপাতালের বেডের ক্ষেত্রেও WHO এর যে সর্বনিম্ন সীমা আছে তার চেয়ে আমরা পিছিয়ে আছি, আমদের দেশে প্রতি ১০০০০ লোকের জন্য ৮টি হাসপাতালের বেড রয়েছে আবার এই বেডগুলির একটা বড় অংশই বেসরকারি মালিকানাধীন হাসপাতালের কাছে এবং নগরকেন্দ্রিক যার ব্যয় বহন করার ক্ষমতা জনসাধারণের একটা ক্ষুদ্র অংশের রয়েছে, বেশীরভাগেরই নাগালের বাইরে। সামগ্রিকভাবে, স্বাধীনতার প্রায় ৫০ বছর কেটে যাওয়ার পরও আমাদের দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে বিকেন্দ্রীকরণ করা যায়নি এবং অপ্রতুল আর্থিক বরাদ্দ, স্বাস্থ্য সেবা ও চিকিৎসা বিদ্যার বেসরকারিকরণ (উপরন্তু বেসরকারি এই স্বাস্থ্য শিক্ষার বা চিকিৎসা বিদ্যার মান নিয়ে রয়েছে অনেক অভিযোগ), চিকিৎসক ও সেবিকা/সেবকসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের অপ্রতুলতা, জনবান্ধব স্বাস্থ্য নীতি ও কাঠামোর অনুপস্থিতি এবং সর্বোপরি এই খাতে দুর্নীতি স্বাস্থ্য খাতকে আরও নাজুক করে তুলেছে।

Manual8 Ad Code

করোনা নিয়ন্ত্রণ করা ক্ষেত্রেও আমাদের স্বাস্থ্য খাতের অভিজ্ঞতা সন্তোষজনক নয়। প্রায় একই সময়ে আক্রান্ত হওয়া এবং একই ধরনের আর্থ সামাজিক বাস্তবতার পরও Worldometer এর দেয়া তথ্যে দেখা যায় কিউবা যেখানে করোনা আক্রান্ত রোগী ২৩৫৩ এবং মৃত্যু ৮৬ জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে পেরেছে এবং ইতিমধ্যে আক্রান্ত রোগীদের বেশিরভাগ সুস্থ হয়ে গেছে সেখানে বাংলাদেশে আক্রান্ত রোগী ১৫৩,২৭৭ ও সংক্রামিত ১৯২৬ রোগীর মৃত্যু হয়েছে এবং আশঙ্কাজনক হারে প্রতিদিন আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে (জুলাই ৩,২০২০)। কিউবার একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল ছিল স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে ২৪,০০০ মেডিকেল ছাত্রকে অন্তর্ভুক্ত করা যারা প্রতিটি পরিবার পরিদর্শন করছে ও পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। আমাদের সরকারি ও বেসরকারি মালিকানাধীন মেডিকেল কলেজেও কয়েক হাজার শিক্ষার্থী রয়েছে তার পাশাপাশি রয়েছে ইউনিয়ন ভিত্তিক ২৫০০০ হাজারের বেশী স্বাস্থ্য কর্মী তবে আমরা তাদেরকে অন্তর্ভুক্ত করার কথা ভাবিনি এবং এই অতিমারী থেকে জাতিকে সুরক্ষিত করার জন্য আমাদের কোনও সঠিক পরিকল্পনা ছিলনা, দুর্ভাগ্যবশত এখনও নাই।

Manual4 Ad Code

করোনা আমাদের স্বাস্থ্য নীতি এবং জনস্বাস্থ্যের ক্ষত ও বাধাগুলি গভীরভাবে বিশ্লেষণের সুযোগ করে দিয়েছে। করোনা সংকটে স্বাস্থ্য পরিষেবার প্রচলিত বাণিজ্যিক মডেল ও বেসরকারীকরণ স্বাস্থ্য খাতকে আরও অসম এবং অন্যায্য করে তুলেছে। আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে স্বাস্থ্য পরিষেবাকে কীভাবে আমরা উপলব্ধি করব- মৌলিক অধিকারগুলির একটি নাকি পণ্য বা বাণিজ্যের উপাদান হিসাবে? বৈষম্যহীন ও জনবান্ধব স্বাস্থ্য নীতি ও কাঠামোর জন্য নেতৃত্বের রাজনৈতিক ইচ্ছা এবং আদর্শিক অবস্থান একটি মৌলিক দিক। জনস্বাস্থ্যের অবয়ব কোন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মডেল অনুসরণ করে হবে তাও সুস্পষ্ট হয় রাজনৈতিক এবং নাগরিক সমাজের সিদ্ধান্তের আলোকে। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও নাগরিক সমাজকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমরা কোন পথে হাঁটব।

#
আহমেদ বোরহান
নৃবিজ্ঞান নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেছেন, এখন মুক্ত গবেষক হিসাবে ঢাকায় কাজ করছেন।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

 


Follow for More!

Manual1 Ad Code
Manual6 Ad Code