আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে

প্রকাশিত: ১:৫৫ পূর্বাহ্ণ, জুলাই ২১, ২০২০

আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে

Manual2 Ad Code

|| মুনতাসীর মামুন || ২১ জুলাই ২০২০ : এই মতামত বিভাগে আমার বন্ধু প্রখ্যাত সাংবাদিক-সাহিত্যিক স্বদেশ রায়ের শাহজাহান সিরাজ সম্পর্কিত লেখাটি পড়ে আমার মনে কয়েকটি প্রশ্ন জেগেছে। (https://opinion.bdnews24.com/bangla/archives/62800) যদি বলি, খালি স্বদেশের লেখা পড়েই এ প্রশ্ন জেগেছে, তাহলে ভুল হবে। গত কয়েক মাসে এত সব ঘটনা ঘটছে যে, মনে হচ্ছে, পরাবাস্তবাদ জগতে আছি। এত কিছু ঘটছে কিন্তু প্রবীণ দূরে থাক, নবীন কেউ-ও জিজ্ঞেস করছে না, এগুলি কী ঘটছে? কেন ঘটবে? সবাই মেনে নিয়েছি সবকিছু, প্রশ্ন থাকলে কোনো ঘনিষ্ঠজনের কাছেই যাচ্ছে। এমন কী আমাদের বন্ধু (তিনি এখন অত্যন্ত প্রভাবশালী, আমাদের বন্ধু মনে নাও করতে পারেন) ওবায়দুল কাদেরও যেসব মন্তব্য করেন, সেগুলি শুনে সবাই হাসেন, বলাবলি করেন, সাহেদের বিচার হবে তো? ডা. আবুল কালাম আজাদকে কেন মন্ত্রী করা হচ্ছে না? প্রখ্যাত ব্যবসায়ী মারা গেলে বলে, করোনায় তো তাদেরই মরা উচিত।

এসব দেখে শুনে মনে এই প্রশ্নও জাগে, আসলে আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে? আমরা বলতে বোঝাচ্ছি মধ্য ও উচ্চবিত্ত (নাকি এলিট) যারা দেশ চালাচ্ছি, সমাজে ‘নেতৃত্ব’ দিচ্ছি, ভাল ভাল পরামর্শ দিচ্ছি এবং নিজেদের প্রকৃত দেশসেবক বলে মনে করছি। আমরা কী রং পছন্দ করি? সাদা, কালো না ধূসর? এটা নিশ্চিত যে, সাদা কালো আমরা পছন্দ করি না, পছন্দ করি ধূসর। সাদা বা কালো পছন্দ করলে আমাদের অবস্থান স্পষ্ট হয়ে যায় যা ক্যারিয়ার বা বাস্তব সংসারে ক্ষতি করতে পারে। ধূসরে থাকলে অবস্থান অস্পষ্ট থাকে, বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা যেতে পারে, তাতে ক্যারিয়ারের ক্ষতি হয় না, বরং সমাজে স্থান দৃঢ় হয়, এখন যে ব্যবস্থা বা সিস্টেমে সমাজ রাষ্ট্র চলছে তার অংশ হয়ে যাওয়া যায়। আর প্রশাসনে থাকলে তো সাদা-কালো অবস্থান নিলে লাভের বদলে ক্ষতি হতে পারে।

গত কয়েকমাসে সমাজে পরিচিত ব্যবসায়ী থেকে অধ্যাপক, সাংবাদিক থেকে প্রশাসক-অনেকে পরলোক গমন করেছেন (তাদের আত্মার মাগফেরাত কামরা করি)। অধিকাংশই অতিমারীতে। প্রায় সবার ক্ষেত্রে মিডিয়া/বুদ্ধিজীবী/বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ যেসব মূল্যায়ণ করছেন তাতে নিজেই বিভ্রান্ত হচ্ছি। মনে হচ্ছে, তাদের সম্পর্কে আগে এমন ভুল ধারণা কেন আমার হয়েছিল? যাকে একসময় বলা হয়েছে ভূমি খেকো, যে ব্যবসায়ীকে বলা হয়েছে মাফিয়া, যে অধ্যাপককে বলা হয়েছে তিনি ভুল শিক্ষা দিয়েছেন, যে সাংবাদিক সবসময় প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে ছিলেন, তাকে বা তাদের এখন বলা হচ্ছে প্রগতিবাদী, যে রাজনীতিবিদ দেশের ক্ষতি করেছেন ভুল রাজনীতি করে, তাকে বলা হচ্ছে ‘তোমাকে অভিবাদন হে নেতা’। বলা হচ্ছে, তারা সর্বজ্ঞ, দেশপ্রেমিক ও মুক্তিযোদ্ধা। ফলে, যাদের অবদান সত্যিকারভাবে সমৃদ্ধ হয়েছে সমাজ-রাষ্ট্র, তারা হারিয়ে যাচ্ছেন বা একটা সর্বগ্রাসী চেষ্টা আছে যে তারা যেন বিস্মৃত হয়ে যান। কিন্তু, তাই কি হয়? না হয়েছে কখনও? ইতিহাস কত নির্মম, পড়ালেখা করেও আমরা তা বুঝি না। সমাজে এমনিতেই বিভ্রান্তির শেষ নেই, ইচ্ছে করেই আমরা অনেক বিভ্রান্তির সৃষ্টি করি। এরপর যদি এসব মূল্যায়ণ হয় তাহলে সমাজে বিভ্রান্তি নয়, সুস্থ চিন্তারও বিকাশ হবে না।

Manual4 Ad Code

স্বদেশের লেখার আমি ভক্ত। এ কারণে নয় যে, তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক তিন দশকের বা আমার অনেক লেখা তিনি যত্ন করে ছেপেছেন দৈনিক জনকণ্ঠ-এ। তার লেখার ভক্ত একারণে, তার লেখায় পড়াশোনা ও চিন্তার ছাপ পাই। সমৃদ্ধ হই। একসময় তিনি অনেক সাহসী লেখা লিখেছেন, এখন অবশ্য খানিকটা স্তিমিত। তাকে দোষ দি-ই কেন? আমরাও যারা লেখার চেষ্টা করি বা করতাম তারাও পারতপক্ষে এখন লিখি না। কারণ, সমস্যা শুধু ডিজিটাল আইন-ই নয়, অনেক। এ সমস্যা শুধু স্বদেশের নয়, আমার, আমাদের, এমনকী কলাম গুরু আবদুল গাফফার চৌধুরীরও। কারণ, আমরা শেখ হাসিনার সমর্থক। কিন্তু, চারপাশে এমন সব ঘটনা ঘটছে যার সমর্থক আমরা নই। কিন্তু, বলার সাহস নেই। সিস্টেমটা এমন হয়েছে বা করা হয়েছে যে, হয় তুমি আমাদের সঙ্গে অর্থাৎ স্টাবলিশমেন্টের সমর্থক, যে স্টাবলিমেন্টের স্পন্সর মাফিয়া ব্যবসায়ী ও আমলারা এবং যার সমর্থক রাজনীতিবিদরা। নয়, তুমি আউটসাইডার বা আগুন্তুক। তুমি সমাজে থাকতে পারো দ্বাদশ ব্যক্তি হিসেবে। ন্যাশনাল টিমে আর কখনও চান্স পাবে না। বড়জোর একটা জ্যাকেট পেতে পারো। যেমন, আপনাদের বোধহয় মনে নেই, স্বদেশ প্রধান বিচারপতি এস. কে. সিনহাকে নিয়ে একটি লেখা লিখেছিলেন, যে কারণে আদালত তাকে প্রায় জেলে পাঠাচ্ছিল। পরে, শুধু জরিমানা করে ছেড়ে দেয়। শেষে প্রমাণিত হয় স্বদেশের অভিযোগ সত্য ছিল। যারা জরিমানার পক্ষে রায় দিয়েছিলেন, তারা কি বলেছেন, দুঃখিত। না, কারণ, সিস্টেমটা এমন করা হয়েছে যে, উচ্চ আদালত বা বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কে কিছু বলা যাবে না।

Manual2 Ad Code

একবার ভোরের কাগজ-এ এক বিচারক সম্পর্কে প্রমাণসহ লেখা হয়েছিল যে তিনি সার্টিফিকেট জাল করেছেন। মামলা হলো সম্পাদকের বিরুদ্ধে এ কারণে যে, সত্য বলে তিনি বিচারকের মানহানি করেছেন। সেই মামলা এখনও চলছে। কিন্তু, খালেদা জিয়া থেকে বিএনপির নেতারা অকথ্য ভাষায় আদালতের বিরুদ্ধে বলেছেন। কোনো কিছু হয়নি। দায় কেউ নেয় না। এ সমাজে দায় আমাদের কারো নয়, দায় সব শেখ হাসিনার।

একটি প্রসঙ্গ বলি। তত্ত্ববধায়ক আমলে অনেক রাজনীতিবিদকে দুর্নীতিবাজ আখ্যা দিয়ে জেলে দেওয়া হয়েছে। পরে, উচ্চ আদালতে প্রমাণিত হয়েছে তারা দুর্নীতি করেননি। মুক্তি পেয়ে তারা মন্ত্রী হয়েছেন। তাদের অনেককে বলেছি, যারা এ ধরনের মিথ্যা অভিযোগ করেছে তাদের বিচার করবেন না? যে বিচারককে দেখেছি মেজরের নির্দেশে রায় দিয়েছেন তাকে উচ্চ আদালতে বিচার করবেন? যে পুলিশ অফিসার অন্যায় ভাবে রিমান্ডে নিয়ে অত্যাচার করেছে তার বিচার করবেন না? কারো কোনো দায় থাকবে না সমাজে। যারা এরকম কাজ করবে তারা রাষ্ট্রে শুধু সুবিধাই পাবে এ কেমন কথা? তারা খালি বিএনপির বিরুদ্ধে বলতে চেয়েছেন কিন্তু, যারা এত ক্ষতি করেছে প্রশাসনে, বিচার বিভাগে থেকে, তাদের কিছুই করেননি। এমনকী প্রচুর ব্যবসায়ীও নির্যাতিত হয়েছেন। তারা সরকারকে চাপ দিয়ে অন্যায় সুবিধা নিচ্ছেন কিন্তু এদের বিচার চাননি। কারণ ঐ যে সিস্টেম যার স্পন্সর-ব্যবসায়ী আমলারা। দায় শুধু আমাদের যারা বছরের পর বছর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির জন্য রাস্তায় থেকেছি, মার খেয়েছি, জেলে গিয়েছি। যারা পিটিয়েছে গত ৪০ বছর তারা দায় মুক্ত। এ কারণেই এই সিস্টেমটা তারা সজীব রাখছে।

প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে চলে যাচ্ছি। টিপিক্যাল বাঙালি তো। ফিরে আসি স্বদেশের লেখা প্রসঙ্গে।

সম্প্রতি শাহজাহান সিরাজ পরলোক গমন করেছেন। তার মৃত্যুর খবর না পাওয়া পর্যন্ত ভুলেই গিয়েছিলাম যে, তিনি বেঁচে আছেন। জীবিতকালেই বিস্মৃত হয়েছিলেন। তার মৃত্যুর পর প্রধানমন্ত্রী থেকে অনেকে শোক জানিয়েছেন। দু’একজন লিখেছেনও। তবে, স্বদেশের মতো এত আবেগপূর্ণ লেখা কেউ লেখেননি। এ লেখা পড়ে শাহজাহান সিরাজের কর্মজীবন সম্পর্কে জেনেছি। তবে, বলতে পারি, শাহজাহান সিরাজ যখন চার খলিফার একজন তখন আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ দিকের ছাত্র। তখন এই চার খলিফা সম্পর্কে আমরা যা শুনেছি বা দেখেছি সেগুলি স্বদেশ শোনেননি বা দেখেননি। কারণ, হয়ত তখন তিনি স্কুলের নিচের ক্লাসের ছাত্র। তাদের সঙ্গে আরেকজনের নাম উচ্চারিত হতো, তোফায়েল আহমেদ, যিনি তাদের থেকে বয়সে ও অ্যাকাডেমিক্যালি সিনিয়র। এই পাঁচজনের মধ্যে একমাত্র তোফায়েল আহমদ সম্পর্কে নেতিবাচক কোনো মন্তব্য শোনা যায়নি। পার্টির অর্ন্তদ্বন্ধের কথা এখানে বিবেচ্য নয়। স্বদেশ লিখেছেন, শাহজাহান ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন, স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেছেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় সীমান্ত পেরিয়েছেন, জাসদের নেতৃত্ব দিয়েছেন। তার মতো রাজনীতিক ক’জন হয়! চার খলিফার আরেকজন জনাব মাখনের অকাল মৃত্যুর পর, ভোরের কাগজে ছোট করে খবর ছেপেছিল এবং তাতে ক্ষুদ্ধ হয়ে বাংলার বাণীর সাংবাদিক শফিকুল আজিজ মুকুলকে তিনি বিষয়টি জানিয়েছিলেন। কারণ, মাখনের মতো রাজনীতিবিদের ট্রিটমেন্ট এমন হবে কেন? মুকুল বলেছিলেন, “প্রতি বিপ্লব যে আমাদের মগজ দখল করেছে এবং সেই মগজ দখলের হাত থেকে আমরা কেউ রেহাই পাইনি।” অর্থাৎ যারা রাজনীতিতে উচ্চস্তরের তাদের মূল্যায়নে ঘাটতি হচ্ছে কে কোন শ্রেণির রাজনীতিবিদ সেটা ব্যক্তি নয় অন্তিমে সমাজই ঠিক করে এটিই প্রতিবিপ্লব।

হ্যাঁ, প্রতিবিপ্লব বা প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তা আমাদের সমাজের বৈশিষ্ট্য। আচ্ছা, বর্তমানে, যুক্তরাষ্ট্র ও পাশ্চাত্যে যে ভাস্কর্য সরিয়ে ফেলা হচ্ছে সেটি কোন ধরনের বিপ্লব? ট্রাম্পের মতে, প্রতিবিপ্লব। এতদিন কলম্বাস বা গৃহযুদ্ধের পক্ষের বা দাস ব্যবসায়ীদের নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠানো হয়নি। স্টাবলিশমেন্ট এগুলি মহিমান্বিত করেছে। বিপ্লব-প্রতিবিপ্লব একাকার করে ফেলেছে, জিয়াউর রহমানের সমন্বিত রাজনীতির মতো। কিন্তু, তরুণরা তা মানছে না। কলম্বাস বলা হয়, আমেরিকা আবিষ্কার করেছেন সে জন্য তিনি পূজিত। এর আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে কী অত্যাচার তারা করেছেন ‘নেটিভদের’ ওপর। রোডস স্কলারশিপকে পৃথিবীর সেরা স্কলারশিপ বলা হয়, রোডসের নাম সে কারণে মহিমান্বিত, তার বর্ণবাদী চরিত্র তাতে ঢাকা পড়ে গেছে। এখন রোডসের মূর্তি সরিয়ে ফেললে যে স্টাবলিশমেন্ট এটি করেছে এবং যারা এই স্কলারশিপ পেয়েছেন তাদের অবস্থা কী হয়? কারণ, তারা সমাজে সম্মানিত। ট্রাম্প এদের ধারক বাহক। কিন্তু, এখন বিচার হচ্ছে তাদের সামগ্রিক কার্য মানুষের পক্ষে ছিল কি ছিল না তা নিয়ে। অন্তিমে আসলে বিচারটা সেই মানদণ্ডেই হয়। সেদিক থেকে রাজা হলেও বেলজিয়ামের রাজাকে বরং প্রগতিবাদী বলা যায়। ব্রাসেলসে তার পূর্বপুরুষ রাজা লিওপোল্ডের মূর্তি সরিয়ে ফেলা হয়েছে এবং তিনি তার পূর্বপুরুষের জন্য ক্ষমা চেয়েছেন কারণ তিনি কঙ্গোর অধিবাসীদের ওপর জুলুম চালিয়েছিলেন। এটি হচ্ছে সংস্কৃতিবান মন।

বিপ্লব না প্রতিবিপ্লবের বিচারটি হবে সামগ্রিক কর্মকাণ্ডের আলোকে। স্বদেশ জানিয়েছেন, শাহজাহান সিরাজ কলেজ থেকে ছাত্রলীগ করেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ নেতা ছিলেন। “এবং এই উচ্চতায় তারা কেউই কোন আকস্মিক ঘটনাক্রমে পৌঁছাননি (চার খলিফা)। স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তারা প্রতি মুহূর্তে পাকিস্তানি সামরিক শাসনের প্রতিটি অপশাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। …সত্যি সত্যি এদের জীবন কাহিনী লেখা হলে এদের অনেকেই আমাদের আগামী শিশুদের রূপকথার রাজপুত্র হতে পারেন। কিন্তু, ইতিহাসের টানা পোড়েনে প্রতি বিপ্লবীরা রাষ্ট্র ও মগজ দখল করে নেয়ার ফলে সবকিছুই এলোমেলো হয়ে গেছে।” এরপর শাহজাহান সিরাজের খানিকটা সমালোচনা করেছেন তিনি জাসদ ও বিএনপি করায়। এবং বাংলাদেশে রাজনৈতিক ধারাবাহিকতা নষ্টে শাহজাহান সিরাজও কাজ করেছেন সেটিও উল্লেখ করেছেন। সবশেষে আবার অতি প্রশংসা করেছেন। স্বদেশের কোনো লেখা এত পরস্পরবিরোধী বলে আমার মনে হয়নি। এর সঙ্গে আরেকটি প্রশ্ন মনে জেগেছে আমরা মধ্যবিত্তরা এ ধরনের বিভ্রান্তিকর চিন্তা কেন কেন করছি?

Manual7 Ad Code

যেমন, এখনকার ঘটনা জালিয়াত সাহেদ। মিডিয়া যে ভাবে লেগেছিল, সে কারণেই তাকে ধরতে হলো। না হলে তাকে ধরা হতো না, হয়নি। সিস্টেমটা ঐ ভাবেই গড়ে তোলা হয়েছে। কিন্তু, এই মিডিয়াই তো এসএসসি পাশ সাহেদকে বিদ্ধান সমাজের এলিট বানিয়েছে। মিডিয়া থেকে কখনও প্রশ্ন ওঠানো হয়নি কোন কোন মিডিয়া তাকে নিয়ে মাতামাতি করেছে, প্রযোজক কারা? দায় তারাও নেবে নাকি? এই মিডিয়া, আগে উল্লেখ করেছি, কীভাবে মৃত্যুর পর কাদের মহিমান্বিত করেছে, আমাদের ভাষায় ‘প্রতি বিপ্লবীদের।’ কারণ, মিডিয়া এখন জনমত নিয়ন্ত্রণ করে। এবং এই মিডিয়ার মালিক কারা? তাদের পূর্ব ইতিহাসটা সবাই ভুলে যান কেন? প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান যৌবনে একটি বই লিখেছিলেন বড়লোকদের উত্থান নিয়ে। সেখানে দেখিয়েছিলেন, যাদের আমরা বড়লোক বলে শ্রদ্ধা করি বা সমাজ শ্রদ্ধা করতে শেখাচ্ছে, তারা সবাই চোর বাটপাড়। এখন মতিউর রহমান সেরকম লিখবেন না। বা আমিও লিখব না। কারণ, আমরা সবাই এই সিস্টেমের অংশীদার হয়ে গেছি। দেশটি এখন ব্যবসায়ী (অধিকাংশই সৎ নন) ও আমলাদের নিয়ন্ত্রণে। সেখানে এই সিস্টেমই হবে। স্বদেশের ভাষায় যারা ‘বিপ্লবী’ শাহজাহান সিরাজ বা অন্যান্য তাদের তুলে ধরতে হবে আর তাদের ভাষায় যারা ‘প্রতি বিপ্লবী’ তাদের পিষ্ট করতে হবে।

আবদুল গাফফার চৌধুরীও এই প্রশ্নটি তুলেছেন। তিনি লিখেছেন, শামীম ওসমান স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ চেয়েছেন কারণ তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সিন্ডিকেট ভাঙতে পারেননি। তিনি লিখছেন, “গোটা সরকারি স্টাবলিশমেন্টই এখন দুর্নীতিময়। তাদের স্বার্থে আঘাত দিতে গেলে শামীম ওসমানও এমপি থাকবেন কিনা সন্দেহ।” (সমকাল ১৮.৭.২০২০) গাফফার চৌধুরী লিখেছেন, “কোন বাপের ব্যাটা এই দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটের স্বার্থে বাধা দেবে? শুধু তাই নয়, শামীম কি একবার নিজের রাজনৈতিক জীবনের রেকর্ডপত্রের দিকে চোখ বুলিয়ে দেখেছেন? একবার নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার এক বন্ধুপ্রতিম ওসি তার গোপন ডায়েরিটা আমাকে দেখিয়েছেন। তাতে ছিল আওয়ামী লীগেরও যত মন্ত্রী ও এমপি গ্রেপ্তার হওয়া দুর্বৃত্তদের ছেড়ে দেওয়ার জন্য ওই ওসিকে টেলিফোনে নির্দেশ দিয়েছেন, তাদের নাম। এই নামগুলো দেখে আমি চমকে উঠেছি। শামীম ওসমান এসব নাম জানেন না তা’ নয়। কিন্তু, তিনি কি এদের বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিতে রাজী আছেন কিংবা সাহসী হবেন? হবেন না কারণ তাতে মি. হাইডের মুখোশটা খুলে দিয়ে ডা. জেকিল ধরা পড়তে পারেন?” (ঐ) বিচারকদের নিয়েও কথা বলেছেন। তার বন্ধু দু’জনই প্রধান বিচারপতি ছিলেন, একজন মোস্তফা কামাল আরেকজন হাবিবুর রহমান শেলী। দু’জনই ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। দু’জনই বিদ্ধান এবং সজ্জন। কিন্তু, তাদের মূল্যায়ণ হয় কীভাবে? তারা দু’জনই গোলাম আজমকে নাগরিকত্ব দিয়েছিলেন। আমি একবার বিচারপতি শেলীকে বলেছিলাম, আপনার মতো গুণী বিদ্যোৎসাহীর পরিচয় হবে শেষ পর্যন্ত আপনি গোলাম আজমকে নাগরিকত্ব দিয়েছিলেন। কেন এমন হলো? তিনি বললেন, আইন দেখে। আমি বললাম, আইনের কি কোনো দর্শন নেই? আইন তো মানুষের সৃষ্টি, তাহলে যে আইন মানুষের সৃষ্টি সেই আইন প্রয়োগ করে ন্যায়নীতি বিসর্জন দেবেন বা সমাজে বিশৃঙ্খলা আনবেন সেটি কেমন কথা? আপনি যে আইনের ভিত্তিতে গোলাম আজমকে নাগরিকত্ব দিলেন, সেই আইনের ভিত্তিতে তো যারা ১৯৪৭ সালের আগে দেশত্যাগ করেছেন, তাদের বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ও সম্পত্তির অধিকার ফিরিয়ে দেবেন? তিনি বললেন, তা কি করে হয়? আমি বললাম, গোলাম আজমের হলে তাদের হবে না কেন? তিনি দুঃখ পেয়েছেন জবাব দেননি। তার প্রধান বিচারপতি হওয়ার পথে হয়ত তিনি কোনো প্রতিবন্ধকতা চাননি।

ঐ যে সিস্টেম, স্টাবলিশমেন্ট যার স্পন্সর ব্যবসায়ী ও আমলাতন্ত্র। জনপ্রতিনিধিরা যে কেউ নন তা সবাই বোঝে। কেন এত অব্যবস্থা সত্ত্বেও ডা. আবুল কালাম আজাদকে সরানো যায় না বা যাদের দায় নেওয়ার কথা তাদের কেন শুধু বদলি করে প্রমোশন দেওয়া হয়? বিএনপি জামায়াত সমর্থক হওয়া তো প্রগতিশীলতা নয়, এক ধরনের রাষ্ট্রের বিরোধিতাও। অধ্যাপক এমাজউদ্দিন নাকি বলেছিলেন, একজন তারেক জিয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। তিনি পূজনীয় হলেন? অন্তিম অনেক কলামিস্ট সে কথা প্রমাণের চেষ্টা করছেন। এমনকী হাসান আজিজুল হকও তার প্রশংসা করে লিখেছেন। তা, অধ্যাপক এমাজউদ্দিন খুবই বিনয়ী এবং মিষ্টভাষী ছিলেন কিন্তু তিনি তার জ্ঞান দিয়ে তো বিএনপি-জামায়াতকে স্পন্সর করেছেন। আর বিএনপি-জামায়াত তো রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তত্ত্বেও দেশের সেবক নয়। কিন্তু বামধারার হাসান আজিজুল হক যখন ডানধারার অধ্যাপক এমাজউদ্দিনকে আদর্শবাদী বলেন তখন তিনি তো সমন্বয়ের রাজনীতিরই বার্তা দেন। ব্যক্তি পর্যায়ে অধ্যাপক এমাজউদ্দিন আমাদের ‘স্যার’, সেই শ্রদ্ধা আমরা তাকে করি কিন্তু যখন আদর্শ বা রাজনীতির প্রশ্ন আসে তখন তো সমর্থন করতে পারি না।

Manual7 Ad Code

না, স্বদেশ আমি আপনাকে দোষ দিই না। আমি, গাফফার চৌধুরীও এই সিস্টেম বা মাফিয়া চক্রের অংশ হয়ে গেছি না চাইলেও। আমরা যেসব পত্রিকায় লিখেছি বা টিভিতে যাচ্ছি তাদের অধিকাংশ কি সৎ? আপনি তো কাগজ বের করবেন এবং সেখানে হয়ত গাফফার চৌধুরী বা আমাকে লিখতে বলবেন। সেই মিডিয়ার মালিকদের সবকিছু জেনেও তো আপনার অনুরোধ আমরা রাখব। কারণ, বহুদিনের ব্যক্তিগত সম্পর্ক, লেনদেন, ছোট দেশ, ছোট এলিট সমাজ যার স্পন্সর মাফিয়ারা, যাই কই? গাফফার চৌধুরী বিদেশে থাকেন, সবকিছু মিলিয়ে তিনি সাহসী হিসেবে পরিচিত। তাকে কেউ ভুলেও স্পর্শ করবে না। তিনি শামীম ওসমানের নাম ধরে লিখতে পারেন। আমি কি পারব? পারব না। আপনি পারবেন? পারবেন না। সে কারণে, এখন আর লিখতে চাই না, বলতেও চাই না কারণ, আমি মনে করি সমালোচনা করার অধিকার হারাচ্ছি। তবুও মাঝে মাঝে লিখে ফেলি, ভুল করে মনে করি, আমি প্রৌঢ় নই, যুবক। নিজগুণে ক্ষমা করবেন। বঙ্গবন্ধু একজনই হন। এই সিস্টেমটা তিনি উপড়ে ফেলতে চেয়েছিলেন, এ কারণে তাকে হত্যা করা হলো সপরিবারে। শেখ হাসিনা সেটা বোঝেন, তাই হয়ত মেনে নিয়েছেন। কিন্তু, তাকে এত ভালোবাসি যে, মনে হয় কেন তিনি এসব অনাচার সহ্য করবেন যা ঘটছে চারদিকে?

সবশেষে একটি প্রশ্ন করে আমি আমার এলোমেলো বক্তব্য শেষ করব। স্বদেশ লিখেছেন, শাহজাহান সিরাজ সম্পর্কে, “মৃত্যুর পরে তিনি তার যোগ্য সম্মান জাতির কাছ থেকে পাবেন, কোনো বিভেদ বা হিংসা দ্বেষ এখানে বাধা হবে না বা পথ আটকে থাকবে না।…জাতি তাকে শ্রদ্ধা জানাবেই… স্যালুট জানাবে।”

গত তিন দশক স্বদেশ লিখেছেন, বিএনপি-জামায়াত করা রাজনীতি নয়। অপরাজনীতি। আমি নিজে মনে করি, এ অপরাজনীতি করা অপরাধ। কেননা, এরা মনে করে অপরাধী ও যারা অপরাধী নন তাদের মধ্যে পার্থক্য নেই। এটিই সমন্বয়ের রাজনীতি। যে কারণে, ১৯৭১ সালের গণহত্যা নিয়ে এই অপরাধ রাজনীতির নেতারা প্রশ্ন তুলেছেন। জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া, নিজামীর রাজনীতির অনেক ব্যাখ্যা/তথ্য আপনি দিয়েছেন যাতে আমরা উজ্জীবিত হয়েছি। এখন আপনি বার্তা দিচ্ছেন– এ অপরাধ রাজনীতি করেও একজন শ্রদ্ধেয় হতে পারেন, জাতির তাকে মনে রাখা উচিত, অভিবাদন জানানো উচিত। লক্ষ পাঠককে এই বার্তা দিলেন যা জিয়াউর রহমান দিতেন। আমার মনে হয়, সিরাজ ছাত্রলীগ করতেন দেখে স্বদেশ আবেগী হয়ে উঠছেন। ছাত্রলীগ করলে সবাই ধোয়া তুলসিপাতা হয় তা নয়। কিন্তু নতুন প্রজন্মকে এ বার্তা তো স্বদেশ রায়ের মতো দায়িত্বশীল কলামিস্ট দিতে পারেন না। আর একারণেই এ ভাষ্য লিখলাম।

শাহজাহান সিরাজ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় ধরলে ৬/৭ বছর লড়াকু সৈনিকের ভূমিকা পালন করেছেন, আর ৪৯ বছর প্রতি বিপ্লবের। তারপরও স্যালুট তার প্রাপ্র্য? মওদুদ আহমদ বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সচিব ছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় পোস্টমাস্টার জেনারেল ছিলেন, ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত ধরলে ‘লড়াকু’ হিসেবে শাহজাহান সিরাজ থেকে বেশি দিন ছিলেন (এবং যার বই পড়লে মনে হবে না তিনি প্রতি বিপ্লবী) তাকেও কি একসময় স্যালুট জানাতে হবে? বা জিয়াউর রহমানকে যিনি স্বাধীনতার একটি ঘোষণা পাঠ করেছিলেন? স্বদেশ কী বলেন? মনটা খুব খারাপ থাকে তো তাই প্রশ্নগুলি করলাম। আপনাকে নয় নিজেকেও। ধরে নিতে পারেন আমাকে বাহাত্তুরে ধরেছে।

#

মুনতাসীর মামুন

লেখক ও গবেষক

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

 


Follow for More!

Manual1 Ad Code
Manual6 Ad Code