আন্তর্জাতিক নদীর পানির সমাধান কর এবং নিজের ব্যবস্থা নিজে নাও

প্রকাশিত: ৬:০৯ পূর্বাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২৭, ২০২০

আন্তর্জাতিক নদীর পানির সমাধান কর এবং নিজের ব্যবস্থা নিজে নাও

Manual7 Ad Code

|| রাশেদ খান মেনন || ঢাকা, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ : আজ বিশ্বের দেশগুলো ‘বিশ্ব নদী দিবস’ পালন করছে। প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসের চতুর্থ রোববার দিবসটি পালন করা হয়। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকেও দিবসটি পালন করা হবে বলে ধারণা। কিন্তু বর্তমান সরকারসহ এযাবৎকালের সব সরকারই বাংলাদেশের নদীগুলো সম্পর্কে যে উদাসীন থেকেছে তার প্রমাণ আমরা পাই আন্তর্জাতিক নদীগুলোর পানিপ্রবাহ সম্পর্কে এই ৫০ বছরে কোনো সমাধান না হওয়া, নদীর তলদেশ উঁচু হয়ে যাওয়ার কারণে নদীর নাব্য চরমভাবে হ্রাস, নদীভাঙন রোধে কোনো সামগ্রিক ও সমন্বিত কর্মসূচি গ্রহণ না করা, নদীদূষণ, জলাবদ্ধতা, সর্বোপরি যেটা বর্তমানে বিশেষ উদ্বেগজনক পর্যায়ে উপনীত, তা হলো নদী দখল। বর্তমান সরকার অবশ্য ২১০০ সালের জন্য ডেল্টা প্ল্যান গ্রহণ করেছে। আগে-পরে নদীর ক্যাপিটাল ড্রেজিং করানো হচ্ছে, নদীভাঙন রোধেও বিভিন্ন প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে, নদীদূষণ রোধ ও দখল বন্ধ করার জন্য বিভিন্ন সময় অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। কিন্তু এসবই সমন্বয়হীন, কোনো সামগ্রিক পরিকল্পনার অধীন নয় আর জলবায়ু পরিবর্তনের এই কালে নদী বিষয়ে অমনোযোগিতা বাংলাদেশের জন্য ভয়াবহ পরিণতি নিয়ে আসছে। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি কেবল বাংলাদেশের বিষয় নয়, বৈশ্বিক বিষয়। বাংলাদেশ এ বিষয়ে দৃঢ় ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ জন্য প্রশংসিতও হয়েছেন। তাকে ‘চ্যাম্পিয়ন অব আর্থ’ ভূষণে ভূষিত করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের নদীসংক্রান্ত যে বিষয়গুলো এখানে উল্লেখ করা হয়েছে সে ক্ষেত্রে বিশেষ অগ্রগতি হয়নি।

বাংলাদেশের প্রধান নদীগুলোর উৎস দেশের বাইরে। ভারত এবং চীনে। ভারতের সঙ্গে আমাদের দেশের ৫৪টি অভিন্ন নদীর সংযোগ রয়েছে, যা ওই দেশটিতে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। এর মধ্যে প্রধান হচ্ছে গঙ্গা (বাংলাদেশে পদ্মা), মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র। এখনকার বহুল আলোচিত তিস্তাও ভারত থেকে বাংলাদেশে ঢুকেছে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ভারতের সঙ্গে বৈরী সম্পর্কের পরও তাদের প্রধান নদীগুলোর পানি ভাগাভাগি করে নিয়েছে। সিন্ধু অববাহিকা চুক্তিতে পঞ্চ নদীর পানি ভাগাভাগি যুদ্ধাবস্থাতেও বন্ধ হয়নি। অথচ সে সময়েই আন্তর্জাতিক নদী গঙ্গার ওপর ফারাক্কা বাঁধ তৈরি শুরু হলেও পাকিস্তানের পক্ষ থেকে কোনো উচ্চবাচ্য হয়নি। পাকিস্তান আমলে ওয়াপদা গড়ে উঠলেও নদীর পানির ব্যবস্থাপনার চেয়ে বন্যা নিরোধে উপকূল অঞ্চলে বাঁধ নির্মাণে তারা ব্যস্ত থেকেছে। এখন সে সব বাঁধ অপাঙ্‌ক্তেয় হয়ে পড়েছে কেবল নয়, উপকূল অঞ্চলে জলাবদ্ধতা থেকে শুরু করে নানাবিধ সমস্যার কারণ হয়েছে। অথচ ভারত, এমনকি পাকিস্তানও এসব আন্তর্জাতিক নদীর ব্যবস্থাপনা কী হবে, কীভাবে ভবিষ্যতে নদীর পানি সমস্যার সমাধান হবে, এ নিয়ে ভাবেনি কেবল, দূরবর্তী সময়ের জন্য পরিকল্পনাও করেছে। পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো এ ক্ষেত্রেও উপেক্ষিত থেকেছে। সে কারণেই গঙ্গার ওপর যখন ভারত বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়, তখন পদ্মাসহ তার শাখা-প্রশাখার পানিপ্রবাহের পরিস্থিতি কী হবে সে ব্যাপারে পাকিস্তানিদের মাথাব্যথা ছিল না। পূর্ব পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক আন্দোলন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আন্তর্জাতিক নদীর পানির হিস্যা কোনো ইস্যু ছিল না। আর ভারতের সঙ্গে ভাগ-বণ্টনের ব্যাপারগুলো গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাথায় বিশেষ ছিল না। বরং ভবিষ্যতে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলন, বিশেষ করে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকগোষ্ঠীবিরোধী আন্দোলনে ভারতের সমর্থন, সহায়তার বিষয়টি বিবেচনায় ছিল। এ কারণে ভারতের প্রতি বিরূপ আচরণ প্রকাশ পেতে পারে সেটাকে বরং অনুৎসাহিত করা হতো।

Manual7 Ad Code

এদিকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণকাজ শেষ হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর সরকারকে ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নির্ধারণের ক্ষেত্রে যে সমস্যাগুলো সামনে এসে দাঁড়ায় তা হলো স্থল সীমানা নির্ধারণ, ছিটমহল সমস্যার সমাধান, সমুদ্র সীমানা নির্ধারণ- এতসব বিষয়। এর সঙ্গে বিশেষভাবে যুক্ত হয় ফারাক্কা দিয়ে প্রবাহিত আন্তর্জাতিক নদীর পানিবণ্টনের বিষয়। বঙ্গবন্ধু তার বিশাল ব্যক্তিত্ব দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের তিন মাসের মধ্যে যেমন ভারতের সেনাবাহিনীর ফিরে যাওয়াকে নিশ্চিত করেছিলেন, তেমনি স্থল সীমানা, ছিটমহল ও সমুদ্রসীমানা নির্ণয়ের প্রাসঙ্গিক কাজগুলো সম্পন্ন করে গিয়েছিলেন, যা সম্প্রতি শেখ হাসিনা সম্পন্ন করেন। কিন্তু গঙ্গার পানিবণ্টনের প্রশ্নটি সমাধান করে যেতে পারেননি। ফারাক্কা বাঁধ চালু করার জন্য ভারত সরকার টেস্ট কমিশনিং করার জন্য বিশেষ জোর দিচ্ছিল। বঙ্গবন্ধু পানিবণ্টনের বিষয়টি সমাধান না করে তাতে রাজি হতে চাচ্ছিলেন না। এক পর্যায়ে এ প্রশ্নে উভয় দেশের আলোচনায় অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়। শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু হস্তক্ষেপ করে একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে ফারাক্কা চালু করতে দিতে সম্মত হন। সে সময় কখন কত পানি পাওয়া যাবে তাও নির্দিষ্ট করা হয়।

Manual1 Ad Code

ফারাক্কা নিয়ে বাংলাদেশ-ভারতের দড়ি টানাটানির সময়কালে এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে প্রচুর লেখালেখি হয়েছে। তার পুনরাবৃত্তির প্রয়োজন নেই। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ড ও রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ফারাক্কা ও গঙ্গার পানিবণ্টনের প্রশ্নটি ‘রাজনৈতিক প্রশ্ন’ হয়ে ওঠে। আওয়ামী লীগ ও মস্কোপন্থি রাজনীতির বুদ্ধিজীবীদের কাছে ফারাক্কা প্রশ্ন উত্থাপন ভারতবিরোধিতার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। অন্যদিকে সামরিক শাসকরা তাদের গদি ও তথাকথিত বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী রাজনীতি পোক্ত করতে এই ইস্যুকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করতে বেশি উৎসাহী থেকেছে। একমাত্র মওলানা ভাসানী ফারাক্কায় বাংলাদেশের পানি প্রাপ্তির ব্যাপারটাকে জাতীয় ইস্যু হিসেবে দেখেন এবং ঐতিহাসিক ফারাক্কা মার্চের আয়োজন করেন। দেশের প্রগতিবাদীরা অবশ্য মওলানার পদক্ষেপকে ‘সামরিক শাসকের সমর্থনপুষ্ট ভারতবিরোধী ও সাম্প্রদায়িক’ রাজনীতি বলে তখনও যেমন বিবেচনা করেছেন এবং এখনও করেন। কিন্তু মওলানা ভাসানী ওই পদক্ষেপ নিয়েছিলেন বলেই ফারাক্কা ইস্যু পুনরুজ্জীবিত হয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী মওলানার এই পদক্ষেপকে কত গুরুত্ব দিয়ে দেখেছিলেন তার প্রমাণ সে সময় মওলানা ভাসানীর কাছে তার প্রেরিত চিঠি। আর মওলানা ভাসানীও তার উচ্চকণ্ঠ ওই লং মার্চ ভারত সীমান্তের বেশ আগেই শেষ করেন।

পরবর্তীকালে জিয়া-এরশাদ ফারাক্কাকে জাতিসংঘে উত্থাপন, নেপালে জলাধার নির্মাণ করে পানিপ্রবাহ বৃদ্ধি ইত্যাদি নানা প্রকার সমাধান দিয়েছেন। কিন্তু কোনোটাই ফলবতী হয়নি। আর খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এসে তার ভারত সফরে ফারাক্কা ইস্যু তুলতেই ভুলে গিয়েছিলেন। শেখ হাসিনা প্রথমবার ক্ষমতায় এসেই ফারাক্কা সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নেন। আর এ ক্ষেত্রে পশ্চিম বাংলার বামফ্রন্ট সরকার বিশেষ করে কমরেড জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বিশেষ ভূমিকা রাখেন- যার পরিণতিতে গঙ্গার পানি চুক্তি সম্পাদন হয়। কিন্তু ইতোমধ্যে প্রায় আড়াই দশক পেরিয়ে গেছে।

Manual1 Ad Code

ভারতে অন্যান্য স্থানে গঙ্গার পানিপ্রবাহ ঘুরিয়ে দিতে যে সব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তাতে পদ্মায় আর প্রার্থিত পানি পাওয়া যায়নি। উত্তর বাংলায় মরুকরণ প্রক্রিয়া, দক্ষিণ বাংলায় লবণাক্ততা দেশের উপরিভাগে উঠে আসা, ভূমি নিম্নস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়াসহ আরও অন্যবিধ প্রতিক্রিয়ায় পরিবেশ-প্রতিবেশের ক্ষেত্রেই চরম বিরূপ প্রভাব পড়েছে। অন্যদিকে ভারত কর্তৃক টিপাইমুখে সুরমা-কুশিয়ারার উৎসে বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ মেঘনা-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় যেমন, তেমনি তিস্তায় গজলডোবাসহ কয়েকটি বাঁধ নির্মাণ তিস্তা অববাহিকায় বড় ধরনের বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে এবং করবে। এছাড়াও দেশের দক্ষিণাঞ্চলের যেসব নদী পশ্চিমবঙ্গ দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে, সেখানে মুখে নদী বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতা। এছাড়া ফেনী, মুহুরীসহ আরও কয়েকটি নদীর প্রশ্ন অমীমাংসিত। ভারত বৃহৎ দেশ হিসেবে তাদের নদী পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করছে- যার মধ্যে প্রধান আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প। চীনও এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। ব্রহ্মপুত্রের উৎসে নদীতে চীনও বাঁধ নির্মাণ করছে। অবশ্য তারা সেটা অস্বীকার করছে। আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে ভাটির দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে না জানিয়ে অথবা বাংলাদেশের আপত্তি অগ্রাহ্য করে উজানের দেশগুলো আন্তর্জাতিক নদীর প্রশ্নে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারে না। কিন্তু বাংলাদেশের যথাযথ কূটনৈতিক উদ্যোগের অভাব, ভারত-বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশনের অকার্যকারিতা এবং সবচেয়ে বড় কথা, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও কারিগরি অপ্রস্তুতির জন্য অভিন্ন আন্তর্জাতিক নদীগুলোর ক্ষেত্রে বিপর্যয় অব্যাহতই আছে।

আমরা বছরের পর বছর ধরে আন্তর্জাতিক অভিন্ন নদীর বিষয়ে উভয় দেশ তথ্য-উপাত্ত বিনিময় করছি। কিন্তু প্রতিবারই খালি হাতে ফিরে আসছি। এদেশের নদীর নাব্য হ্রাস, নদীভাঙন, নদীদূষণের বিষয়ে যেমন অভ্যন্তরীণ কারণ রয়েছে, আর সেটা হচ্ছে নদী ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কোনো সামগ্রিক ও জাতীয় স্বার্থাভিমুখ দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ না করা, তেমনি রয়েছে ৫৪টি আন্তর্জাতিক নদী সম্পর্কে এত বছরেও কোনো সিদ্ধান্তে না আসা।

বাংলাদেশ নদীর সৃষ্টি। নদী বাংলাদেশের জীবন। তার চেয়ে বড় কথা, এ পর্যন্ত নদীর যে অফুরান পানি আমাদের ফসলে-মৎস্যে সমৃদ্ধ করেছে, যোগাযোগ সহজলভ্য করেছে, পরিবেশ-প্রতিবেশকে রক্ষা করেছে, সৃষ্টি করেছে অমর সব সাহিত্য, ঈর্ষণীয় সংস্কৃতি, সেই নদী মরে গেলে এ দেশের মানুষ বাঁচবে না। বলা হয় তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হবে পানির ওপর অধিকার নিয়ে, সে অধিকার আমরা আগেই যদি ত্যাগ করে বসে থাকি, তাহলে ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত হবো। জলবায়ু পরিবর্তনের বিপর্যয় থেকে আমরা রক্ষা পাব না। বিশ্ব নদী দিবসে তাই আন্তর্জাতিক অভিন্ন নদীর পানি সমস্যার সমাধান এবং অন্যদিকে তার অপেক্ষায় না থেকে অভ্যন্তরীণ নদীর ব্যবস্থাপনায় নিজের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হোক দেশের মানুষের দাবি।
#
রাশেদ খান মেনন এমপি;
সভাপতি, বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টি

Manual1 Ad Code

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

 


Follow for More!

Manual1 Ad Code
Manual6 Ad Code