চীনা সভ্যতার গোড়াপত্তন

প্রকাশিত: ৮:৪৭ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ১, ২০২১

চীনা সভ্যতার গোড়াপত্তন

আনু মুহাম্মদ

পিপলস রিপাবলিক অব চায়না। জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের বৃহত্তম রাষ্ট্র। ইরান, ভারত ইনকা, মায়ার মতো প্রাচীন চীনের সভ্যতা। ১৯৪৯ সালে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে বিপ্লবের পর এক নতুন চীনের যাত্রা হয়। নানা রকম সংস্কার ও পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বর্তমান বিশ্বে চীন অন্যতম এক পরাশক্তি। জিডিপির হিসাবে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ফসল নয়া চীন এখন পুঁজিবাদী বিশ্ব অর্থনীতির অন্যতম প্রভাবশালী রাষ্ট্র। ঐতিহাসিক ও বৈশ্বিক প্রেক্ষিতে চীনের শক্তি-দুর্বলতা, সাফল্য-ব্যর্থতা ও ধারাবাহিক পরিবর্তনগুলো নিয়ে লিখেছেন আনু মুহাম্মদ

জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের বৃহত্তম রাষ্ট্র চীন, পুরো নাম ইংরেজিতে ‘পিপলস রিপাবলিক অব চায়না’, বাংলায় বলা হয় ‘গণপ্রজাতন্ত্রী চীন’। এখন এ দেশের জনসংখ্যা ১৪০ কোটি। এর আয়তন প্রায় ৯৬ লাখ বর্গকিলোমিটার। ভূমির আয়তনের দিক থেকে এটি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম, সমগ্র অঞ্চল ধরলে তা পরিমাপের পার্থক্য অনুযায়ী তৃতীয় বা চতুর্থ হবে। ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় চীনা কমিউনিস্ট পার্টি, যার নেতৃত্বে ১৯৪৯ সালে বিপ্লবের পর বর্তমান চীনের যাত্রা। ২২টি প্রদেশ, পাঁচটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল, চারটি কেন্দ্র নিয়ন্ত্রিত পৌরসভা (বেইজিং, তিয়ানজিন, সাংহাই, চংকিং) এবং দুটি বিশেষ মর্যাদায় ভিন্নভাবে পরিচালিত অঞ্চল (হংকং, ম্যাকাও) নিয়ে বর্তমান চীন। তাইওয়ান বা এখনো যে রাষ্ট্র চীন হিসেবে নিজেকে পরিচয় দেয়, গণপ্রজাতন্ত্রী চীন তার দাবিদার প্রথম থেকেই। বিপ্লবের পর চীন থেকে পালিয়ে চিয়াং কাই শেক তাইওয়ান নামে পরিচিত এ রাষ্ট্র গঠন করেছিলেন, যার প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, এখনো আছে।

ভূপ্রকৃতির দিক থেকে চীন বৈচিত্র্যপূর্ণ। সমতল, পাহাড়, বনভূমি, মরুভূমি সবই আছে এ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। মোট আয়তনের খুব কম অংশই আবাদযোগ্য। হিমালয়, কারাকোরাম, পামির এবং তিয়ান শান পর্বতমালা চীনকে দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া থেকে ভিন্ন করে রেখেছে। তিব্বত থেকে বিশ্বের তৃতীয় দীর্ঘতম নদী ইয়াংসী এবং ষষ্ঠ দীর্ঘতম নদী হোয়াং হো বা হলুদ নদী চীনের মধ্য দিয়েই প্রবাহিত হয়েছে। প্রশান্ত মহাসাগরে চীনের উপকূলীয় দৈর্ঘ্য ১৪ হাজার ৫০০ কিলোমিটার বা ৯ হাজার মাইল দীর্ঘ। চীনের সঙ্গে অনেকগুলো দেশের সীমান্ত। এ দেশগুলো হলো: ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার, মঙ্গোলিয়া, কাজাখস্তান, কিরঘিস্তান, তাজিকিস্তান, উত্তর কোরিয়া, ভিয়েতনাম, লাওস ও রাশিয়া। ভারতের সঙ্গে চীনের সীমান্ত বিরোধ কয়েক দশকের। এ নিয়ে ১৯৬২ সালে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধও সংঘটিত হয়।

ইরান, ভারত ও ‘আমেরিকা’র ইনকা মায়ার মতো কিংবা তার চেয়েও প্রাচীন চীনের সভ্যতা। অন্যান্য প্রাচীন সভ্যতার অঞ্চলের মতো চীনকে ঘিরে প্রাচীন রাজ্য, শাসন ও ক্ষমতা নিয়ে অনেক মিথ আছে। লিখিত ইতিহাস অবশ্য অনেক পরের। সেই সময় থেকেই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার বিবেচনায় চীন বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি। অষ্টাদশ শতক থেকে ইউরোপে যে শিল্পবিপ্লব শুরু হয়, তার ধারাবাহিকতায় উনিশ শতকে সারা বিশ্বে সাম্রাজ্যিক আধিপত্যে ইউরোপ হয়ে দাঁড়ায় প্রধান ঔপনিবেশিক শক্তি। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায় চীন সে সময় পিছিয়ে যায় এবং ইউরোপের পূর্ণ উপনিবেশে পরিণত না হলেও তার প্রভাববলয়ে পতিত হয়। এ সময়ে জাপানও সাম্রাজ্যিক ক্ষমতায় ইউরোপের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে। চীনের বিরাট অংশ জাপানের ঔপনিবেশিক নিষ্ঠুর শাসনের অধীনস্থ হয়।

ইউরোপ ও জাপানের সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য, বিভিন্ন অঞ্চলে সামন্ত প্রভুদের শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে জনগণের লড়াইকে সংগঠিত ও সমন্বিত করেই চীন কমিউনিস্ট পার্টি দীর্ঘ জনযুদ্ধ পরিচালনা করে। ১৯৪৯ সালের বিপ্লব চীনকে আবারো বিশ্বের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে হাজির করে। এ বিপ্লবের পরও অনেক ওঠানামা গেছে। বর্তমান চীন অনেক রকম সংস্কারের মধ্য দিয়ে পরিবর্তিত হয়েছে।

নানা রকম পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এ চীন বর্তমানে যে চেহারায় আবির্ভূত হয়েছে, তাতে তার পরিচয় নিয়েই সংশয় তৈরি হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, বর্তমান চীন কি সমাজতান্ত্রিক না পুঁজিবাদী না নতুন এক ব্যবস্থার জন্ম দিচ্ছে? এ প্রশ্ন বিশ্বব্যাপী বিদ্যায়তন, রাজনীতি ও অর্থনীতি আলোচনায় এখন এক অব্যাহত বিতর্কের বিষয়। তবে সবাই একমত যে, বর্তমান বিশ্বে চীন এক পরাশক্তি। প্রচলিত জিডিপি বিচারে যুক্তরাষ্ট্রের পরই দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। আর ক্রয়ক্ষমতার সমতার নিরিখে বিচার করে আইএমএফের হিসাব অনুযায়ী চীন এখন বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি। পুঁজিবাদী বিশ্ব অর্থনীতিতে চীনের প্রভাব ক্রমেই বিস্তৃত হচ্ছে। এর পাশাপাশি চীন সাম্রাজ্যবাদী বিশেষণেও অভিহিত হচ্ছে, বিশেষত, আফ্রিকায় তার ভূমিকার কারণে।

চীনের এ দ্রুত বিস্ময়কর অর্থনৈতিক গতির রহস্য কী? দেশের ভেতর বৈষম্য, দুর্নীতি বৃদ্ধি, বিশাল ধনিক গোষ্ঠীর প্রবল আধিপত্য ইত্যাদির সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির একক শাসন কীভাবে সংগতিপূর্ণ? কথিত বাজার সমাজতন্ত্রেরইবা স্বরূপ কী? বিশ্বের বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য এর তাত্পর্য কী?

এসব প্রশ্ন অনুসন্ধান করতেই এ ধারাবাহিক। বিশ্ব পুঁজিবাদের গতিমুখ বুঝতে চীনের গতি-প্রকৃতি বিশ্লেষণ জরুরি। যথাযথভাবে চীনের শক্তি ও দুর্বলতা, সাফল্য ও ব্যর্থতা, পরিবর্তন ও ধারাবাহিকতা বুঝতে গেলে একদিকে ঐতিহাসিক, অন্যদিকে বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিত আনতে হবে। বিপ্লব পূর্ব চীন, বিপ্লবের মধ্য দিয়ে তার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তন এবং ৭০ দশক থেকে তার সংস্কারের ভেতর-বাহির পরীক্ষা করতে হবে।

সাম্রাজ্যের ওঠানামা

মানুষের প্রাচীন সভ্যতা ও আদি অস্তিত্ব সম্পর্কে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান যতই অগ্রসর হচ্ছে, ততই নতুন নতুন তথ্য আমাদের সমৃদ্ধ করছে। কোথাও এসে বলা যায় না, এটাই শেষ। এ জানা এক অব্যাহত প্রক্রিয়া। এযাবতকালে এ অনুসন্ধানে চীনে আদিকালের মানুষের সন্ধান পাওয়া যায়। এ অঞ্চলে প্রাপ্ত চিহ্ন থেকে ধারণা করা হয়, এখানে আড়াই লাখ থেকে ২৫ লাখ বছর আগের মানবপ্রজাতির কোনো না কোনো ধরনের অস্তিত্ব ছিল। ‘পিকিং মানব’ হিসেবে পরিচিত মানুষের ফসিল বেইজিংয়ের কাছাকাছিই পাওয়া গিয়েছিল, যাদের জীবিত অস্তিত্ব সাত থেকে নয় লাখ বছর আগের বলে বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন।

অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, খ্রিস্টপূর্ব তিন হাজার সালেও চীনে কোনো না কোনো ধরনের লিখিত রূপ পাওয়া যায়। তবে অন্য ভাষার মতো চীনা বা ম্যান্ডারিন ভাষায় বর্ণমালা নেই। এখানে ব্যবহূত হয় ছবি ও প্রতীক। এ ধারার আর পরিবর্তন হয়নি। চীনে প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী, খ্রিস্টপূর্ব দুই হাজার বছর আগেই চীনে সাম্রাজ্যিক বংশানুক্রমিক শাসনের উদ্ভব। তবে অনুসন্ধান ও প্রাপ্ত প্রমাণাদি অনুযায়ী, বংশানুক্রমিক শাসন বা কেন্দ্রীভূত শাসন স্থায়িত্ব পেয়েছে বিভিন্ন খণ্ড খণ্ড শাসন ও সমাজের বিবর্তনের মধ্য দিয়ে। হোয়াং হো বা হলুদ নদীর তীরেই প্রথম কৃষি ও জনবসতির লক্ষণ দেখা যায়।

খ্রিস্টপূর্ব দেড় হাজার বছর আগে শাং সাম্রাজ্যের তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়। তাদের সময়ে লিপির সন্ধান পাওয়া যায়, তা বর্তমান ভাষিক গঠনের পূর্বসূরি। শাং সাম্রাজ্যের পর ঝও শাসন। এ সময়কালে কেন্দ্রীয় শাসন কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ে এবং বেশ কয়েকটি স্বাধীন রাজ্যের উদ্ভব হয়। কিন্তু কালক্রমে কিন রাজ্যের কাছে বাকিগুলো পরাজিত হওয়ায় প্রথম কেন্দ্রীভূত চীনা রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। এ সময়ে কিন শি হুয়াং নিজেকে প্রথম সম্রাট হিসেবে ঘোষণা করেন। ভাষা, মুদ্রা, পরিমাপ একক বিষয়ে মান নির্ধারণ হয় এ সময়ে।

খ্রিস্টপূর্ব ২০০ সালের দিকে শুরু হয় হান রাজবংশীয় সাম্রাজ্যকাল। হান জাতীয় পরিচয় এ সময়ই সংগঠিত হয়। এ সময়ে চীন সাম্রাজ্যের সীমা আরো সম্প্রসারিত হয় এবং বর্তমান কোরিয়া, ভিয়েতনাম, মঙ্গোলিয়া ও মধ্য এশিয়া এর শাসনের অন্তর্ভুক্ত হয়। সিল্ক রোডের জন্মও এ সময়েই। হান সম্রাট রাষ্ট্রীয় মতাদর্শ হিসেবে কনফুসিয়ান মতবাদ গ্রহণ করে। পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্যের একটি হিসেবে স্বীকৃত গ্রেট ওয়াল তৈরি হয়েছে বিভিন্ন সাম্রাজ্যের সময়ে ধারাবাহিকভাবে। প্রায় দুই হাজার বছরে বর্তমান চেহারা লাভ করেছে এটি। শাখা-প্রশাখাসহ প্রায় আড়াই হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ এ দেয়াল এখনো বিস্ময়। কিন্তু অনেকেরই এর নির্মাণকাজের নিষ্ঠুর দিক জানা নেই। এ দেয়ালের নিচে অসংখ্য দাস শ্রমিকের লাশ আছে বলে অনেক গবেষক মনে করেন, কিন্তু তার হিসাব করা কঠিন।

হান সাম্রাজ্যের পতনের পর কয়েকশ বছর চীনের শাসনব্যবস্থা খুবই অস্থিতিশীল ছিল। এরপর তাং এবং সং সাম্রাজ্যের সময়ে চীনা প্রযুক্তি ও শিল্প-সংস্কৃতির অভূতপূর্ব বিকাশ দেখা যায়। তাং সাম্রাজ্যের কালে বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার ঘটে। সং সাম্রাজ্যের সময়েই বিশ্বের প্রথম কাগজি মুদ্রার প্রচলন হয় এবং এ সময়েই স্থায়ী বিশাল নৌবাহিনী গঠিত হয়। সপ্তম শতকের চীন থেকেই হিউয়েন সাং ভারত সফরে আসেন এখানকার বৌদ্ধ মঠ বা শিক্ষালয়ে শিক্ষা ও গবেষণার সন্ধানে।

দশম ও একাদশ শতকে চীনের জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ১০ কোটি। ত্রয়োদশ শতকে চীন ক্রমে মোঙ্গল সাম্রাজ্যের অধীনস্থ হয়। ১২৭১ সালে মোঙ্গল অধিপতি কুবলাই খান ইউয়ান রাজত্ব পত্তন করেন। সং সাম্রাজ্যের শেষদিকে চীনের জনসংখ্যা ছিল ১২ কোটি। এ রাজত্ব পরাজিত করে মিং রাজত্বের সূচনা হয় ১৩৬৮ সালে। এ রাজত্বেও শিল্প-সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখার চর্চা অনেক সম্প্রসারিত হয়। আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে চীনের যোগাযোগ স্থাপিত হয়। এ সময়ই চীনের রাজধানী হিসেবে পিকিং বা বেইজিংয়ের প্রতিষ্ঠা ঘটে।

সপ্তদশ শতকে অনেকগুলো বিদ্রোহ দেখা যায়। ১৬৪৪ সালে এক বিদ্রোহে রাজধানীর পতন ঘটলে শেষ মিং সম্রাট আত্মহত্যা করেন। বিদ্রোহীদের স্বল্পস্থায়ী শাসন উচ্ছেদ করে পত্তন হয় কিং রাজত্বের। রাজধানী হিসেবে পিকিং বা বেইজিং স্থায়িত্ব লাভ করে। এ রাজত্ব দীর্ঘস্থায়ী হয়, টিকে থাকে ১৯১২ সাল পর্যন্ত। এটাই চীনের শেষ সাম্রাজ্যিক রাজত্ব। উনিশ শতক থেকে এ শাসকদেরও মোকাবেলা করতে হয় পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোকে। ব্রিটেন, ফ্রান্স ছাড়াও জাপান সাম্রাজ্যবাদের একাধিক আগ্রাসন ও তাদের সঙ্গে যুদ্ধ সংঘটিত হয় এ শতকে। এছাড়া এ শতকে অনেকগুলো বিদ্রোহের ঘটনাও ঘটে। এ ঘটনাগুলো চীনের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

আফিম যুদ্ধ

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে ১৭৭৬ সালে লন্ডনে প্রকাশিত হয় অ্যাডাম স্মিথের বিশ্বখ্যাত গ্রন্থ ‘অ্যান ইনকোয়ারি ইন টু দ্য নেচার অ্যান্ড কজেস অব দ্য ওয়েলথ অব নেশনস’। এ সময় ইংল্যান্ডসহ ইউরোপে শুরু হয়েছে শিল্পবিপ্লব, ক্রমেই তা শক্ত ভিত্তি তৈরি করে বিস্তৃত হচ্ছে। এ শিল্পবিপ্লব ছিল বিশ্বজুড়ে উপনিবেশগুলোতে ইউরোপীয় দেশগুলোর দখল, শাসন ও সম্পদ সঞ্চয়নের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। স্মিথের এ গ্রন্থটি বস্তুত পুঁজিবাদের সূচনাকালের ঘোষণা ও তার জটিল জগৎ অনুসন্ধান। সে কারণে এ গ্রন্থে ইউরোপের ভেতর ও বাইরের অনেক বিষয় দেখার চেষ্টা আছে, আবার অনেক কিছু নেইও। ১৮৬৭ সালে ও পরে প্রকাশিত মার্কসের কয়েক খণ্ড গ্রন্থ পুঁজিতে স্মিথের এ গ্রন্থসহ সে সময়ের বুুদ্ধিবৃত্তিক জগতের গভীর পর্যালোচনা আছে।

যখন ইউরোপে শিল্পবিপ্লবের যাত্রা জোরদার হচ্ছে, তখনো চীন প্রবল অর্থনৈতিক শক্তি। সমাজবিজ্ঞানী, জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্বের অধ্যাপক, জিওভানি আরিঘি তার অ্যাডাম স্মিথ ইন বেইজিং গ্রন্থে চীনের এ সময় পর্যালোচনা করে বলছেন, প্রকৃতপক্ষে স্মিথ যখন তার বিখ্যাত গ্রন্থ লিখছেন, তখনো পূর্ব এশিয়ার পতন শুরু হয়নি। বরং অষ্টাদশ শতকে চীনে যে শান্তি-স্থিতিশীলতা, সমৃদ্ধি ও জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধি শক্তি তৈরি হয়েছিল, তা ইউরোপের আলোকময়তা বা এনলাইটেনমেন্টের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ যেমন লেইবনিজ, ভলতেয়ার এবং কুইসনি বা কেনেসহ অনেকের অনুপ্রেরণার উৎস ছিল। চীনের প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন, নৈতিক নির্দেশনা, মেধা ও শক্তির সমন্বয়, কৃষিপ্রধান জাতীয় অর্থনীতি ইত্যাদি বিষয়ে তারা অধ্যয়ন করে বস্তুত ইউরোপের জন্য পথ অনুসন্ধান করেছেন। তাদের অনুসন্ধানী চোখে চীন সাম্রাজ্যের আকার, জনসংখ্যা এবং ঐক্য ছিল বিশেষ আগ্রহের বিষয়। চীনের অভ্যন্তরীণ বাজারের আকারকে স্মিথ বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন, যা তার ভাষায়, ‘ইউরোপের সবগুলো দেশ একত্র করলেও তার তুলনায় খারাপ হবে না।’

উনিশ শতকেই এ প্রবল শক্তির মধ্যে ভাঙন ধরে। ভেতরের দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও বাইরের আগ্রাসন চীনকে দীর্ঘ স্থিতিশীল সমৃদ্ধির অবস্থান থেকে সরিয়ে দেয়। এ শতকে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন, আফিম যুদ্ধ, দেশের ভেতরে বিদ্রোহ, দুর্ভিক্ষ, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশে বড় আকারে অভিবাসনসহ অনেকগুলো ভবিষ্যৎ নির্ধারক ঘটনাবলি অতিক্রম করে চীন।

চীনে কিং সাম্রাজ্য শুরু হয়েছিল ১৬৪৪ সালে, এটি চীনের শেষ সাম্রাজ্যিক শাসন। এর সমাপ্তি ঘটে ১৯১২ সালে। উনিশ শতকে এ সাম্রাজ্যের চীনকেই পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের চাপানো দুই দফা আফিম যুদ্ধের শিকার হতে হয়। ব্রিটিশসহ পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী ব্যবসায়ীদের কাছে চীনকে উন্মুক্ত করা নিয়ে বিরোধ থেকেই আফিম যুদ্ধের উত্পত্তি। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের দাবি ছিল চীনে ব্যাপকভাবে আফিম বাজার তৈরির পথে সব বাধা নিষেধাজ্ঞা দূর করতে হবে। চীন এতে সম্মত ছিল না। এ ব্যাপারে চাপ প্রয়োগ করতেই ব্রিটিশরা চীনের বিরুদ্ধে সামরিক হামলা শুরু করে। ফ্রান্সেরও ভূমিকা ছিল এতে। ব্রিটেনের সঙ্গে চীনের প্রথম আফিম যুদ্ধ চলে ১৮৩৯ থেকে ১৮৪২ সাল পর্যন্ত, এর পরের যুদ্ধ ১৮৫৬ সালে শুরু হয়ে শেষ হয় ১৮৬০ সালে। প্রথম যুদ্ধে পরাজয়ের পরই চীনকে অপমানজনক শর্তে চুক্তি করতে হয়। ১৮৪২ সালে স্বাক্ষরিত নানকিং চুক্তি অনুযায়ী ব্রিটিশদের হাতে ছেড়ে দিতে হয় হংকং। পরাজয়ের এখানেই শেষ নয়। ১৮৯৪-৯৫ সালে প্রথম চীন-জাপান যুদ্ধেও চীনের পরাজয় হয়। এর ফলে তাইওয়ান চলে যায় জাপানের হাতে, কোরিয়ার ওপরও চীন তার নিয়ন্ত্রণ হারায়।

এ সময়ে ব্রিটিশদের আফিমসহ নৌবাণিজ্য কেন্দ্র করে অমিতাভ ঘোষ ত্রয়ী উপন্যাস লিখেছেন। এগুলো বিস্তর গবেষণা ও পর্যালোচনার ওপর ভিত্তি করে লেখা। এ সিরিজের প্রথম উপন্যাস ‘সি অব পপিজ’। এতে আছে কীভাবে ব্রিটিশ বণিকরা চীনের বাজার লক্ষ্য করে ভারতে আফিম উৎপাদন সম্প্রসারণ করছে। এর ফলে ভারতের বহু অঞ্চল বদলে যাচ্ছে। খাদ্য উৎপাদনের জমি চলে যাচ্ছে এসব অর্থকরী ফসল উৎপাদনে। আফিম গ্রহণে চীন কর্তৃপক্ষের প্রবল আপত্তির কারণে পশ্চিমা বণিকদের অসন্তোষ তাদের বিভিন্ন আলোচনা বিতর্কে উঠে এসেছে। ব্রিটিশ কর্তাব্যক্তিদের সারকথা হলো, চীনারা আফিম বাজারের ওপর নিয়ন্ত্রণ ও নিষেধাজ্ঞা বজায় রেখে মুক্তবাজার অর্থনীতি, ব্যক্তি স্বাধীনতার পথে বাধা সৃষ্টি করছে। এ বাধা দূর করতে হলে প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগ করতেই হবে।

প্রকৃতপক্ষে ব্রিটিশরা চীনে আফিম বিক্রি শুরু করে এর আগেই, ১৭৮১ সালে। এক্ষেত্রে একক আধিপত্য ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির। ১৮২১ থেকে ১৮৩৭ সালের মধ্যে আফিম বিক্রি চারগুণ বাড়ে। এ ব্যবসা সরল বা আইনসম্মত ছিল না। কোম্পানি আফিম ভরা জাহাজ নিয়ে হাজির হতো মূল ভূখণ্ডের কাছাকাছি কোনো দ্বীপে। সেখান থেকে চীনা বণিকরা রুপার বিনিময়ে নিষিদ্ধ এ নেশাদ্রব্য সংগ্রহ করে তা মূল ভূখণ্ডে সরবরাহ করত। এ ব্যবসায় যুক্ত থেকে চীনের ভেতরেও আমলাসহ প্রভাবশালী একটি গোষ্ঠী তখন বিপুল অর্থ উপার্জন করেছে।

ইংল্যান্ডের মুক্তবাণিজ্যের প্রবক্তাদের একাংশের চাপে ১৮৩৪ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যের অবসান ঘটে এবং আরো অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এতে যোগ দেয়। একপর্যায়ে মার্কিন ব্যবসায়ীরাও আফিম ব্যবসায় যুক্ত হয়। মার্কিনিরা এর জোগান বাড়াতে থাকে তুরস্ক থেকে। ব্রিটিশ ও মার্কিন ব্যবসায়ীদের প্রতিযোগিতায় আফিমের দাম কমে যায়, তবে তার বিক্রি বাড়ে উল্লেখযোগ্য মাত্রায়। এ ব্যবসায়ীদের তখন প্রয়োজন এ বাণিজ্যের ওপর বিদ্যমান সব বিধিনিষেধ ও নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহার। এ বিষয়ে চাপ থেকেই ক্রমে যুদ্ধ শুরু। আর এতে পরাজয়ের মধ্য দিয়ে চীনের শাসন ব্যবস্থাতেও একের পর এক ফাটল আসতে থাকে। পরে আমরা দেখি এ পশ্চিমা বিশ্বেই চীনাদের পরিচয় তৈরি হয় আফিমখোর হিসেবে!

যা-ই হোক, উনিশ শতকে শুধু বাইরের আক্রমণ নয়, চীনের ভেতরেও কিং সাম্রাজ্যের শাসকদের ক্রমবর্ধমান বিদ্রোহ মোকাবেলা করতে হয়।

[পর্ব ২: উনিশ শতকের চীন]

আনু মুহাম্মদ

অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়