সিলেট ৫ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২০শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ১:৪৫ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ৩১, ২০২২
নিজস্ব প্রতিবেদক | ঢাকা, ৩১ জানুয়ারি ২০২২ : দেশের গ্যাস বিতরণ কোম্পানি এবং বিপিডিবি কমিশন নির্ধারিত ছকে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়েছে। এই প্রস্তাবের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে গত ২৬ জানুয়ারি এক জরুরি বৈঠক করে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)।
বৈঠকের আলোচনা নানামুখী হলেও চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি কমিশন। ফলে কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই বৈঠকটি শেষ হয়েছে। তবে গত দশ বছরে ৪ দফায় গ্যাসের দাম ৩৬১ শতাংশ বৃদ্ধির ফলে মানুষের জীবনযাপন কঠিন হয়ে পড়ছে। আর গত দুই বছর ধরে বৈশ্বিক মহামারি করোনার প্রভাবে অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত সাধারণ মানুষ। এই অবস্থায় আবার গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির বিষয়টি মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এর ফলে মানুষের জীবন আরো দুর্বিষহ হয়ে উঠবে।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাবগুলো আরও যাচাই-বাছাই করতে হবে। কারণ পেট্রোবাংলার চিঠিতে ঘাটতি রয়েছে। সেজন্য কমিশন তাদের কাছে পর্যাপ্ত তথ্য চাইবে।
এ বিষয়ে কমিশনের এক সদস্য সাংবাদিকদের বলেন, আমরা ছয়টা গ্যাস বিতরণ কোম্পানির গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব পেয়েছি। তাদের প্রস্তাব এবং গ্যাস সঞ্চালন কোম্পানি জিটিসিএলের সঞ্চালন চার্জ বৃদ্ধির প্রস্তাব পর্যালোচনা করছি। তবে পেট্রোবাংলা তাদের চিঠিতে যে তথ্যগুলো দিয়েছিল- সেটার সাপোর্ট হিসেবে রেকর্ডপত্র দলিলাদি চেয়েছে কমিশন।
গত বৃহস্পতিবার পেট্রোবাংলাকে সেই চিঠি পাঠানো হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এরপরে আমরা বসব।
তবে এই মুহূর্তে গ্যাসের দাম বাড়ানো উচিত কিনা, তা নিয়ে মতভিন্নতা রয়েছে জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের মধ্যে। তারা বলছেন, বর্তমানে প্রতিদিন তিন হাজার ৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস বাংলাদেশে সরবরাহ করে বিতরণ কোম্পানিগুলো। তার মধ্যে ২ হাজার ৩০০ ঘনফুট গ্যাস দেশীয় উৎস থেকে সরবরাহ করা হয়। বাকি ৭৫০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি গ্যাস আমদানী করা হয়। তার মধ্যে ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস কেনা হয় ১০ বছরের দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে ৬ থেকে ১০ ডলার মূল্যে। স্পট মার্কেট থেকে বাকি ১০০ থেকে ১৫০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি গ্যাস কেনা হয়, যেটির দাম ওঠানামা করে। ফলে এই স্বল্প পরিমাণ গ্যাসের জন্য এখনই এতো বেশি মূল্যবৃদ্ধি অযৌক্তিক বলে মনে করছেন তারা।
এবিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বি ডি রহমতউল্লাহ বলেন, এখন গ্যাসের দাম বাড়ানো একেবারেই যৌক্তিক নয়। দেশের ভেতরে যে গ্যাস রয়েছে, সেটা সরকার তোলে না। বরং বিদেশ থেকে আমদানির ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। একটা চক্রকে ব্যবসা পাইয়ে দিতে, বিশেষ সুবিধা দিতেই এটা করা হচ্ছে। কেন কোম্পানিগুলো দুইগুণ-তিনগুণ বাড়াতে চাইছে, আমরা সেটা জানি না। হয়তো সরকারকে তারা পরোক্ষভাবে আগামীতে যে এলপিজি আসবে, সেই দামকে সাপোর্ট করার জন্য তারা দামটা বাড়িয়ে নিচ্ছে।
গ্যাসের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে ধানমণ্ডির একজন বাসিন্দা সুলতানা মাহমুদের সঙ্গে বাংলাদেশ জার্নালের কথা হয়। তিনি পাইপলাইনের গ্যাসে দুই চুলা ব্যবহার করেন। এজন্য প্রতিমাসে তাকে ৯৭৫ টাকা দিতে হয়। নতুন করে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রায় অভিন্ন যে প্রস্তাব করেছে বিতরণ কোম্পানিগুলো, তাতে আবাসিক গ্রাহকদের ঘনমিটার প্রতি ৯ টাকা ৩৬ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ২০ টাকা ৩৫ পয়সা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। অর্থাৎ সুলতানাকে দুই চুলার জন্য দিতে হবে দুই হাজার ১০০ টাকা।
তিনি বলেন, বাজারে এমনিতেই সব জিনিসের দাম বেড়ে গেছে। এখন যদি গ্যাসের দামও এতো বেড়ে যায় তাহলে তো রান্নাবান্নাই বন্ধ করে দিতে হবে।
এদিকে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির যে তোড়জোড় চলছে, তা বাস্তবায়ন হলে জনজীবন, সমাজ ও অর্থনীতিতে ব্যাপক বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে বলে মনে করছেন বিরোধী রাজনৈতিক দলসহ দেশেরে বিশিষ্ট নাগরিকরা। তারা বলেছেন, বাণিজ্যিক ও আবাসিক উভয় ক্ষেত্রে গ্রাহকের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া দেশের অর্থনীতি এবং জনজীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। কারণ করোনা মহামারিতে কাজ হারিয়ে অনেক মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। অর্থনৈতিক সংকটের চিত্র সমাজ অর্থনীতির সব পর্যায়ে বিদ্যমান। সুতরাং এই পরিস্থিতিতে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রক্রিয়া উৎপাদন-বণ্টনসহ মানুষের জীবনকে আরো দুর্বিষহ করে তুলবে।
গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রসঙ্গে নাগরিকরা বলছেন, ভুল নীতি, অব্যবস্থাপনা, সিস্টেম লস ও দুর্নীতি দূর করার কার্যকর উদ্যোগ না নিয়ে গ্রাহক পর্যায়ে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া জনবিরোধী এবং সরকারকে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির এ প্রক্রিয়া থেকে সরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
করোনা মহামারির কারণে জনজীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে উল্লেখ করে গ্যাসের মূল বৃদ্ধিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে ২১ নাগরিক বিবৃতি দিয়েছেন। তারা বলছেন, প্রতি ঘনমিটারে গড়ে ১১৭ শতাংশ বাড়ানোর যে প্রক্রিয়া চলছে, তাতে জনজীবন, সমাজ ও অর্থনীতিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে। কারণ সম্প্রতি বিতরণ কোম্পানিগুলো এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি) পৃথকভাবে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে। এ প্রস্তাব অনুসারে, আবাসিক গ্যাসের দাম দুই চুলার মাসিক বিল হবে ২ হাজার ১০০ টাকা, যা বর্তমানে ৯৭৫ টাকা এবং এক চুলার বিল হবে ২ হাজার টাকা, যা বর্তমানে ৯০০ টাকা। আর শিল্পে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম বর্তমানে ১০ টাকা ৭০ পয়সা, যা বাড়িয়ে ২৩ টাকা ৮৫ পয়সা করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। বাণিজ্যিক ব্যবহারের গ্যাস শিল্প-কারখানার নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহূত হয়, তার দাম প্রস্তাব করা হয়েছে ৩০ টাকা, যা বর্তমানে ১৩ টাকা ৮৫ পয়সা।
অন্যদিকে লাভজনক হওয়া সত্ত্বেও সঞ্চালন কোম্পানিগুলোর গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবকে অযৌক্তিক বলে মনে করে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ)। তারা বলছে, এর ফলে রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্প ব্যাপক আকারে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর আমদানিনির্ভর হয়ে পড়বে নিট ও গার্মেন্ট শিল্প।
এবিষয়ে বিটিএমএ সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, করোনায় বস্ত্রখাত রুগ্ণ হয়ে পড়ে। প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রণোদনা পাওয়ায় গত এক বছরে বস্ত্র খাত কিছুটা আরোগ্য লাভ করেছে। কিন্তু পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠেনি। এ অবস্থায় মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসাবে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি হলে বস্ত্র খাত টিকতে পারবে না।
এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) সমালোচনা করে খোকন বলেন, অতীত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, গ্যাসের দাম বৃদ্ধির স্ক্রিপ্ট রেডি থাকে। শুনানিতে কে কী বলল সেটা গুরুত্ব পায় না। সর্বশেষ ২০১৯ সালের শুনানিতে ব্যবসায়ীদের যুক্তিতর্ক আমলে নেয়ার পরও অস্বাভাবিক হারে দাম বাড়ানো হয়েছে। আর করোনায় কারখানা বন্ধ থাকলেও তিতাসকে শিল্প মালিকদের সারচার্জ দিতে হয়েছে। যেখানে অন্য সব খাত ব্যবসায়ীদের সহায়তায় চেষ্টা করেছে। গত দুই বছরে তিনবার ব্যবস্থাপনা পরিচালক পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমানে যিনি আছেন, তিনি ফোন ধরছেন না। তাহলে ব্যবসায়ীরা সমস্যার কথা জানাবে কিভাবে।
এবিষয়ে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গণমাধ্যমকে বলেন, সরকার যে গ্যাস আমদানি করছে, সেখানে গ্যাসের দাম প্রচণ্ডভাবে বেড়ে গেছে। সরকারকে হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। সেজন্য ফাইন্যান্স (অর্থ মন্ত্রণালয়) থেকে বলা হয়েছে, দাম সমন্বয় করতে হবে। আর বিইআরসিতে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। তারা শুনানি করে সিদ্ধান্ত নেবে যে, গ্যাসের দাম বাড়ানো হবে নাকি হবে না।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইজাজ হোসেন বলেন, বাংলাদেশের নিজস্ব যে গ্যাস রয়েছে, তার বড় একটি অংশ সরকার বিদ্যুৎ ও সার শিল্পে ব্যবহার করে। ফলে আবাসিক ও বেসরকারি খাতে যে গ্যাসের চাহিদা রয়েছে, সেটা মেটাতে হচ্ছে বেশি দামে আমদানি করা গ্যাস দিয়ে।
সম্পাদক : সৈয়দ আমিরুজ্জামান
ইমেইল : rpnewsbd@gmail.com
মোবাইল +8801716599589
৩১/এফ, তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০।
© RP News 24.com 2013-2020
Design and developed by M-W-D